তুরস্কের বিরুদ্ধে ক্রুসেড : সফল হবেন কি ম্যাক্রন?
ম্যাক্রনের ক্রুসেড সফল হবে? - ছবি সংগৃহীত
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রন হঠাৎ করে ক্রুসেডের মনোভাব নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন ভূ-মধ্যসাগরে। গাদ্দাফির যুগের সেনা জেনারেল খলিফা হাফতারকে লিবিয়ার রাজধানী দখল করার জন্য জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি সহায়তা করে এসেছেন। সম্প্রতি, বৈরুত উদ্ধারের আওয়াজও তুলেছেন তিনি। রহস্যজনক বিস্ফোরণে ব্যাপক প্রাণহানি ও সম্পদ ধ্বংসের ঘটনার পর এমানুয়েল ম্যাক্রন বলেছেন : ‘ফ্রান্স যদি ভূমিকা পালন না করে তবে ইরানি, তুর্কি এবং সৌদিরা লেবাননে হস্তক্ষেপ করবে, এতে লেবাননে তার অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
এর মধ্যে ফরাসি যুদ্ধজাহাজগুলো সাইপ্রাসের বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে গ্রিকদের সাথে যৌথ মহড়া দিচ্ছে। ম্যাক্রোন চলতি সপ্তাহে কর্সিকায় এক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠানের আগে সাংবাদিকদের বলেন, ‘তুরস্ক আর এই অঞ্চলে অংশীদার নয়, ইউরোপীয়দের অবশ্যই এরদোগানের সরকারের ব্যাপারে ‘স্পষ্ট ও দৃঢ়’ থাকতে হবে। ইউরোপীয় দেশগুলোর তুরস্কের সাথে ‘লাল রেখা’ তৈরি করা উচিত।
ম্যাক্রন বলেছেন, তার বিরোধ তুরস্কের সাথে নয়, এরদোগানের সাথে। এই কৌশলটি আগেও গ্রহণের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। সমস্যা হলো, লিবিয়ায় সংযুক্ত আরব আমিরাত-সমর্থিত বাহিনীর মুখোমুখি হওয়া বা জেরুসালেমে ফিলিস্তিনের অধিকারকে সমর্থন করা বা ইরাকে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টিকে নিষ্ক্রিয় করা অথবা সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বাহিনীকে শায়েস্তা করা- এসব পদক্ষেপে এরদোগানের নীতির প্রতি তুর্কি সেনাবাহিনী এবং প্রধান তুর্কি রাজনৈতিক দলগুলোর পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।
এরদোগানের রক্ষণশীল ইসলামপন্থী ভিত্তি ভাঙার জন্য সক্রিয় একটি নতুন দলের প্রধান ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আহমেদ দাভুতোগলু ম্যাক্রনের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি বলেছেন : ‘ম্যাক্রনকে অবশ্যই তার সীমানা মেনে চলতে হবে এবং তুরস্ক ও এর প্রেসিডেন্টকে অপমান করা বন্ধ করতে হবে। ম্যাক্রনের অহঙ্কারী বক্তব্যগুলো তার ঔপনিবেশিক মানসিকতার পরিচয় দেয় এবং তুরস্কের গণতন্ত্র এবং জনগণের স্বাধীন ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে।’
এরদোগান তুরস্ককে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, যার সশস্ত্র বাহিনী সিরিয়া ও লিবিয়ায় রাশিয়ান বাহিনীর মুখোমুখি হতে সক্ষম, তবে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে আলোচনার টেবিলেও তিনি তার দেশের স্বার্থ রক্ষাকারী ভূমিকা রাখতে পারেন। তুরস্কের অর্থনীতি এবং এর সামরিক বাহিনী স্বাবলম্বী। ইসরাইল ও আমেরিকা সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানালেও উচ্চ প্রযুক্তির ড্রোন উৎপাদন শুরু করে আঙ্কারা।
তুরস্ক যখন কৃষ্ণসাগরে গ্যাস আবিষ্কার করেছে, তুর্কি সংস্থাগুলোর কাছে গ্যাসক্ষেত্রগুলো বিকশিত করার এবং দেশীয় বাজারে সরবরাহ করার প্রযুক্তি রয়েছে। দেশটি মিসরের মতো ব্রিটিশ, ইতালিয়ান এবং মার্কিন সংস্থাগুলোর ওপর নির্ভরশীল নয়। এই নির্ভরতার অর্থ হলো, তারা গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে প্রাপ্ত সম্পদের একটি বড় অংশকে কেটে নেয়।
এসব কিছুর কারণেই ফ্রান্স তুরস্কের ব্যাপারে কিছুটা আগ্রাসী হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে ব্লুমবার্গের মূল্যায়নটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ব্লুমবার্গ ম্যাক্রনের নতুন চেষ্টার ব্যাপারে বলেছে, তার জন্য দ্বিতীয় গিঁটটি কড়া নাড়ছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট পূর্ব ভূ-মধ্যসাগরের অভ্যন্তরে বিপর্যয় নিয়েই তুরস্কের ব্যাপারে বাকবিতণ্ডা আরো একবার বন্ধ করেছেন। তার বক্তব্য এরদোগানের মেরুদ- দুর্বল করছে না, আর ম্যাক্রন আর্থিক হাতিয়ার ব্যবহারের জন্য বিশ্ব ঐকমত্য গঠনের জন্য যে লড়াই করছেন, তুরস্কের পশ্চাদপসরণ ঘটানোর জন্য নৌবহর পাঠানোর মতোই তার কার্যকারিতা হবে অনেক কম। ফরাসি প্রেসিডেন্টের ভারী কথাগুলো ইতোমধ্যে পুনরাবৃত্তি হওয়া থেকে এটি নিশ্চিত হওয়া যায় যে তিনি ভুল জায়গায় পা ফেলেছেন।
কেবল কয়েক সপ্তাহ আগে, ম্যাক্রন দাবি করেছিলেন যে ইতোমধ্যে এক বেগুনি রেখা তিনি এঁকে ফেলেছেন। আর গর্ব প্রকাশ করে বলেন, তুর্কিরা কথাকে নয়, পদক্ষেপকে সম্মান করবে। তবে এ পর্যন্ত ম্যাক্রনের অনলাইন শীর্ষ সম্মেলনের মধ্যে নৌবাহিনী ওয়ার্কআউটে সহযোগিতা করা বা না করার মতো পদক্ষেপগুলো আঙ্কারায় তাকে পুরোপুরি বাড়তি উপহাসের পাত্র বানিয়েছে।
ফ্রান্স তার ন্যাটো সহযোগীদের কাছ থেকে নৌসহায়তার আশা করতে পারে না। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাইপ্রাসের কাছে অস্ত্রের বিক্রয় নিয়ে দীর্ঘদিনের আমেরিকান নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেছে। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দিক থেকে এরদোগানের বিরোধিতা করে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের সম্ভাবনা বেশি নয়। ম্যাক্রন তার কুৎসাপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে এরদোগানের বিরোধিতা বজায় রাখতে পারবেন। তবে এগুলো ইতোমধ্যে নিষ্ফল হয়ে তার কাছে ফিরে আসতে শুরু করেছে। গ্রিক ও সাইপ্রিয়টরা দ্রুতই ফরাসি সংহতির অভিব্যক্তি নিয়ে ক্লান্ত বোধ করবে এবং আঙ্কারা সম্ভবত প্যারিসের সাথে অতিরিক্ত বাক্যযুদ্ধে আহ্লাদ অনুভব করবে।