নতুন চশমা : কয়েকটি জরুরি পরামর্শ
নতুন চশমা : কয়েকটি জরুরি পরামর্শ - ছবি সংগৃহীত
চশমা অনেকেরই নিত্যসঙ্গী। বছরের পর বছর ধরে চশমা পরেন অথচ কোনো অস্বস্তি বা বিড়ম্বনা অনুভব করেননি এমন ব্যক্তি খোঁজে পাওয়া দুষ্কর। বিশেষ করে যারা নতুন চশমা পরছেন অথবা নিয়মিত চশমা পরেন কিন্তু দীর্ঘ বিরতিতে নতুন পাওয়ারে চশমা বানিয়েছেন তাদের বেলায় সমস্যাটি প্রায়ই অনুভব করতে দেখা যায়। চশমা পরার সাথে সাথে মাথা ঝিম ঝিম করে; ঝাপসা অনুভূত হয়; চোখ জ্বালা পোড়া বা চোখ ব্যথা; মাথা ব্যথা অনুভূত হয়।
অনেক সময় নিচে তাকালে এক ধরনের উঁচু-নিচু অনুভূত হয় যার দরুন ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটে। অনেক সময় বস্তুর ইমেজ মনে হয় যেন একদিকে ঢালু অথবা প্রান্তিক অংশ মনে হবে যেন উঠে আসছে। যদিও এ ক্ষেত্রে সোজাসুজি তাকালে কোনো ধরনের অসুবিধা হয় না। এগুলো আসলে চশমা অ্যাডজাস্ট না হওয়ার উপসর্গ। চশমা অ্যাডজাস্ট না হওয়ার জন্য প্রধানত দু’টি বিষয় দায়ী। একটি চশমার ভুল পাওয়ার অন্যটি ফ্রেম অথবা ফিটিং সংক্রান্ত ত্রুটি।
প্রথমেই চশমার পাওয়ারের বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করে নিলে বিষয়টি অনুধাবন করতে সুবিধা হবে। চশমার পাওয়ার নির্ধারণ অনেক সময় ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে। চশমায় কতটুকু পাওয়ার প্রয়োজন হবে এটি নির্ধারণ করতে দু’টি ধাপ অনুসরণ করা হয়। প্রথমতো পাওয়ার ক্যালকুলেশন যেটি অটোরিফ্রেক্টোমিটারের (সাধারণভাবে কম্পিউটার হিসেবে সমধিক পরিচিত) মাধ্যমে অথবা রেটিনোস্কোপির মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়।
দ্বিতীয় ধাপে ক্যালকুলেশন বা পরিমাপ করা পাওয়ারের লেন্স চোখে দিয়ে চার্ট পড়ানোর মাধ্যমে এটিকে ভেরিফাই করা হয়। ক্যালকুলেশন করা পাওয়ারকে একটু কমবেশি করে দেখা হয় কোন পাওয়ারটিতে ভালো বোধ হয় সেই পাওয়ারটি ওই ব্যক্তির জন্য চূড়ান্ত করা হয়। প্রথম ধাপে ত্রুটি থাকলে দ্বিতীয় ধাপে সেটি শুধরে যায়। এভাবেই একটি চশমার প্রেশক্রিপশন চূড়ান্ত হয়। একটি সঠিক পাওয়ারের প্রেসক্রিপশন পেতে হলে পাওয়ার ক্যালকুলেশনের পাশাপাশি ব্যক্তির পর্র্যবেক্ষণও জরুরি।
আবার চশমার গ্লাসে পাওয়ার প্রস্তুত করার সময়ও সঠিক পাওয়ারটি নিশ্চিত করা জরুরি। চশমার গ্লাস প্রস্তুত করার সময় বা চোখ পরীক্ষা করার সময় পাওয়ারের হিসাবে গরমিল হয়ে থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে চশমার গ্লাস পরীক্ষা করলে এবং প্রয়োজনে চোখের পাওয়ার দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করলে বিষয়টি শনাক্ত হয়ে যাবে এবং সেই মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে হবে।
যদি এমন হয় পাওয়ার ক্যালকুলেশন এবং প্রস্তুতকৃত চশমা বা লেন্সে পাওয়ার ঠিক থাকে এবং চশমা ব্যবহার আরামদায়ক না হয় বা কোনো ধরনের অস্বস্তি যেগুলো ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো থাকে তবে বুঝতে হবে এটি অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রবলেম।
অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রবলেমের অনেকগুলো কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো- ফ্রেম সংক্রান্ত ত্রুটি; প্রথমবার চশমা ব্যবহার; দীর্ঘ বিরতিতে পাওয়ার তথা চশমা পরিবর্তন; প্রথম প্রথম বাইফোকাল বা প্রগ্রেসিভ
চশমা ব্যবহার : হঠাৎ নতুন করে সিলিন্ড্রিক্যাল পাওয়ার ব্যবহার; ব্যবহারজনিত অজ্ঞতা ইত্যাদি। অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রবলেম অস্বাভাবিক কিছু নয়। ২-৩ সপ্তাহ চশমা ব্যবহারে ধীরে ধীরে এটি অ্যাডজাস্ট হয়ে যায়। চশমা ব্যবহারে অ্যাডজাস্টমেন্ট সমস্যা এড়াতে বা দ্রুত অ্যাডজাস্টমেন্টের জন্য কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে।
ফ্রেম : ফ্রেম নির্বাচনে খেয়াল রাখতে হবে যেন ফ্রেমটি মুখাবয়বের সাথে মানানসই হয়; অধিকতর পাওয়ারের বেলায় রিম বা গ্লাস বড় না হওয়া বাঞ্ছনীয়; বাইফোকাল বা প্রগ্রেসিভ গ্লাসের বেলায় গ্লাস বা রিম স্বাভাবিক বা একটু বড় হওয়াই যুক্তিযুক্ত; সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ফ্রেমটি খুব সহজে নাকের ওপর এমনভাবে বসতে হবে যেন রিমের উপরিভাগ চোখের লেভেলের চেয়ে একটু উপরে থাকে এবং কানের পাশে সামান্যতম চেপে থাকা চলবে না। ভারী ফেসে মোটা বা ভারী ফ্রেম মানানসই হলেও অ্যাডজাস্টমেন্ট সমস্যা থাকলে হালকা ফ্রেমই ভালো। গোলাকৃতি মুখমণ্ডলে স্কয়ার মানানসই হলেও অন্যদের ক্ষেত্রে গোলাকৃতি চশমাই ভালো। প্রগ্রেসিভ পাওয়ারের ক্ষেত্রে বিশেষ করে যাদের সিলিন্ড্রিক্যাল পাওয়ার আছে তাদের বেলায় রিমলেস চশমা পরিহার করা ভালো।
গ্লাস : গ্লাসের ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে গ্লাস যেন হালকা এবং পাতলা হয় বিশেষ করে যাদের পাওয়ার বেশি। এ ক্ষেত্রে হাই ইনডেক্স গ্লাস ভালো। যাদের গ্লেয়ার সমস্যা বা রোদে সমস্যা হয় তাদের জন্য ভালো ফটোক্রোমিক গ্লাস বা এন্টিরিফ্লেক্টিভ গ্লাস ব্যবহার করা। প্রগ্রেসিভ পাওয়ারের চশমা ব্যবহারকারীদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো গ্লাস বা রিমের সাইজ। কারণ প্রগ্রেসিভ পাওয়ারে ওপর থেকে নিচ তিনটি স্তরে পাওয়ার বিন্যস্ত থাকে। সবচেয়ে ওপরের অংশ দূরে দেখার জন্য; একদম নিচের অংশটি একদম কাছে অর্থাৎ পড়াশুনা ফাইল ওয়ার্ক করার জন্য এবং মধ্যবর্তী অংশটি মধ্যবর্তী দূরত্ব যেমন কম্পিউটার ইত্যাদির স্ক্রিন অথবা ড্রাইভিংয়ে লুকিং গ্লাসে দেখার জন্য। প্রগ্রেসিভ গ্লাসের সাইজ এমন হতে হবে যেন তিনটি স্তর সুন্দরভাবে বিন্যস্ত করার সুযোগ থাকে এবং নিচের অংশটি যেন চোখের লেভেল থেকে অনেক নিচে নেমে না যায়। কম্পিউটারে যারা দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয় তাদের জন্য ব্লুফিল্টার গ্লাস ব্যবহার করা ভালো।
চশমার পাওয়ার : চশমা ব্যবহারে নতুন পাওয়ার এবং পুরনো পাওয়ার একসাথে ব্যবহার করা যাবে না যদিও মনে হবে যেন পুরনো পাওয়ার আরামদায়ক। যত বেশিক্ষণ চশমা ব্যবহার করা হবে তত দ্রুত চশমা অ্যাডজাস্ট হবে। বাইফোকাল ও প্রগ্রেসিভ পাওয়ারে কোনো অংশ দূরের জন্য কোনো অংশ কাছের বা মধ্যবর্তী দূরত্বের জন্য এটি একটু খেয়াল রাখতে হবে। অ্যাডজাস্টমেন্ট সমস্যা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সময়ের সাথে সাথে এটি অ্যাডজাস্ট হয়ে যাবে। এই সময়টুকু অবশ্যই ধৈর্য ধারণ করতে হবে। বেশি সমস্য মনে করলে এই সময়টুকুতে ড্রাইভিং, সিঁড়িতে ওঠানামায়, রাস্তা পারাপারে, ঝুঁকিপূর্ণ মেশিনে কাজকর্মে একটু অতিরিক্ত সতর্কতা প্রয়োজন।
ডিজিটাল স্ক্রিন : বর্তমান ডিজিটাল স্ক্রিনের যুগে স্ক্রিন যথাযথভাবে ব্যবহার না করাও চশমা ব্যবহারে অস্বস্তির অন্যতম কারণ। কম্পিউটার স্ক্রিনে কাজ করার সময় খুব জরুরি একটি বিষয় হলো কম্পিউটার স্ক্রিন সব সময় চোখে লেভেলের সমান্তরাল বা তার একটু নিচে থাকতে হবে কোনোভাবেই ওপরে থাকতে পারবে না। সঠিক দূরত্বে স্ক্রিন ব্যবহারও একটি অত্যাবশ্যকীয় কাজ বিশেষ করে যারা প্রগ্রেসিভ চশমা ব্যবহার করেন। স্ক্রিন লেভেল চোখের লেভেলের ওপরে হলে এবং দীর্ঘ সময় ও দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকলে অস্বস্তি হওয়া অবধারিত।
এ ছাড়াও যাদের রক্তে সুগার ওঠানামা করে বা রক্তচাপ ও কোলেস্টেরোলের মাত্রা বেশি থাকে তাদের চশমা ব্যবহারে কিছুটা অস্বস্তি কাজ করে। চশমা ব্যবহারে যাদের অস্বস্তি হয় তাদের উচিত তাড়াহুড়া না করে ধীরে সুস্থে সার্বিক বিষয়ে একটু সতর্কতা অবলম্বন করা।
লেখক : চক্ষুবিশেষজ্ঞ ও সার্জন, সহযোগী অধ্যাপক (অব:), কনসালট্যান্ট, আইডিয়াল আই কেয়ার সেন্টার,
রিং রোড, শ্যামলী, আদাবর, ঢাকা
মোবাইল : ০১৯২০৯৬২৫১২