মার্কিন অর্থনীতির পিছুটান
ট্রাম্প - ছবি সংগৃহীত
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে চলছে এক ধরনের পিছুটান। কোভিড-১৯-এর কারণে মার্কিন অর্থনীতির এই পিছুটান নয়। বরং কোভিড-১৯ নিশ্চিতভাবে সহায়তা করেছে দেশটির অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে ব্যাপকভাবে এগিয়ে নেয়ায় বিজারক হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে কখনোই ২০০৮-০৯-এর অর্থনৈতিক মন্দা থেকে পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করা যায়নি। তখন ফেডারেল ব্যাংক (আসলে এটি একটি প্রাইভেট ব্যাংক) ব্যবস্থা ও অন্য করপোরেশনগুলোতে জোগান দিয়েছে ট্রিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডলার, যাতে এগুলো দেউলিয়া হয়ে না পড়ে। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে ফেডারেল ব্যাংক আবার ব্যাংক ব্যবস্থায় শত শত কোটি ডলার দিতে শুরু করে, যাতে ব্যাংকগুলোর নগদপ্রবাহ ভালোভাবে চলে। কোভিড-১৯-এর সময়ে অর্থনীতির বৃহত্তম অংশের শাটডাউনের (এর অভ্যন্তরীণ ভাগ ছিল ৭০ শতাংশ) ফলে একে সচল রাখতে প্রয়োজন তিন-চার ট্রিলিয়ন ডলার। এর বড় অংশই যায় ‘টপ ওয়ান পার্সেন্টারদের’ কাছে; অন্য কথায় শীর্ষ ধনীদের হাতে। সামান্য পরিমাণ ডলার পায় শ্রমিক শ্রেণী। এর পরও অর্থনীতিকে সহায়তা করতে ফেডারেল ব্যাংককে আরো ট্রিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডলার দিতে হবে, অর্থনীতিতে পুঞ্জীভূত বিপুল ঋণের সাথে ভারসাম্য আনার প্রয়োজনেই তা করতে হবে।
তাহলে করণীয় কী? এর সংক্ষিপ্ত উত্তর হচ্ছে- অপেক্ষা করতে হবে যতক্ষণ না যুক্তরাষ্ট্র হাইপারইনফ্লেশন ও লোকসানের মধ্য দিয়ে বিপর্যস্ত হয় ও এর পরাশক্তির ক্ষমতা হারায়। এটি হতে পারে একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। কিন্তু ইতিহাসের সব ক্ষমতাধর মুদ্রা শেষ পর্যন্ত ফিরে যায় এর সত্যিকার মূল্যে, অর্থাৎ ‘নাথিং’-এ। রাশিয়া ও চীন ইতোমধ্যেই এগিয়ে যাচ্ছে মার্কিন ডলারবিহীন একটি অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে। তাদের বাণিজ্য চলবে স্থানীয় মুদ্রায়। নিজস্ব ঋণ-ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে চলবে তাদের ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং এই ব্যবস্থা তারা সম্প্রসারণ করবে আগ্রহী বৈশ্বিক অংশীদার দেশেও। ডলার নিয়ে আসল অভ্যন্তরীণ হুমকিটা থেকে গেছে পাশ্চাত্যে করপোরেটের চালু থাকার ওপর। কারণ, বিপুল ঋণের জন্য প্রয়োজন আরো আরো ডলার। যুক্তরাষ্ট্র যখন হাইপারইনফ্লেটেড হবে, এটি হারাবে পরাশক্তি হিসেবে এর গুরুত্ব। আর একবার সে গুরুত্ব হারিয়ে ফেললে, তা ওয়্যার ডিপার্টমেন্টের অনেক প্রভাব খাটানোকেই অসম্ভব করে তুলবে। তখন ওয়্যার ডিপার্টমেন্ট চাইলেও পারবে না যেখানে-সেখানে অস্ত্র কিংবা ঘুষ সরবরাহ করতে, আকর্ষণীয় বেতনে কাউকে নিয়োগ করতে; তাদের হয়ে কাজ করার জন্য। হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র তখন বর্তমানের মতো ডলার সরবরাহ বন্ধ করে ‘নতুন কিছু’ চালু করবে।
দ্বিতীয় সমাধানের উপায় নিয়ে সোরেনসেন বলেছেন- ওয়্যার ডিপার্টমেন্টের সব ক্ষেত্রে কম্পিউটারের ব্যবহার দিন দিন আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ওয়্যার ডিপার্টমেন্টে ই-মেইল থেকে শুরু করে এনক্রিপশনের মাধ্যমে যোগাযোগ, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, সেন্সর, সার্ভিল্যান্স ইকুইপমেন্ট, ব্যাংকের লেনদেন, আরো অনেক কিছুতে কম্পিউটার প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমেই বাড়ানো হচ্ছে। সোরেনসেন উল্লিখিত বিষয়গুলোর মধ্যে একটি বিষয় হচ্ছে- একটি সুসংহত একক ব্যাপক নেটওয়ার্ক এবং এক সেট সলিড ডাটা পেতে ওয়্যার ডিপার্টমেন্টের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ, যাতে করে যেকোনো ডিপার্টমেন্ট অন্য একটি ডিপার্টমেন্টে যোগাযোগ করে সহসাই তথ্য দিতে ও নিতে পারে।
সাধারণভাবে গুগল, ফেসবুক, মাইক্রোসফট, অ্যাপল ও অন্যান্য কমিউনিকেশন ওরিয়েন্টেড কোম্পানি এই প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটিয়ে চলেছে। কিন্তু বড় পশ্চাৎপদতা নিহিত সেইসব উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সমাধানগুলোর মধ্যেই, যা এরা প্রমোট করছে। সব কিছুরই রয়েছে একটি অন্তর্নিহিত দুর্বলতা। এরা যত বেশি কানেকটেড হচ্ছে, তত বেশি ভঙ্গুরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এভাবেও আসতে পারে ওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি অবসানের কাক্সিক্ষত একটি সমাধান। তবে এটিও অপেক্ষায় থেকে দেখার মতো সমাধান। আমরা আশা করতে পারি, বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর ত্বরান্বিত টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে ঘটতে পারে সত্যিকারের লড়াই ও এর বিস্ফোরণ। কারণ, হয়তো এমন কেউ কোনো এক স্থানে বসে আছে, যার সক্ষমতা আছে ওই সব ইলেকট্রনিক যোগাযোগ একটি বোতাম টিপে বন্ধ করার এবং এটা কার্যকরভাবে বন্ধ করে দিতে পারে যাবতীয় লড়াই। ইলেকট্রনিক ওয়্যারফেয়ার এবং তথাকথিত ‘ভিজিবিলিটি রিডাকশন টেকনিকস’ সম্পর্কিত একটি রিসার্চ সেন্টার সংযুক্ত রয়েছে ‘রাশিয়ান এয়ারফোর্স অ্যাকাডেমি’র সাথে। এই সেন্টারের ডিরেক্টর ভ্লাদিমির বেলিবাইন বলেছেন- ‘রেডিও ইলেকট্র্রনিক সিস্টেম যত বেশি জটিল, তত বেশি সহজ ইলেকট্রনিক ওয়্যারফেয়ার ব্যবহার করে তা অকার্যকর করে দেয়া’।
এর পরও প্রশ্ন আসে, ওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি কি এভাবে কোনো এক সময় বিধ্বস্ত হওয়ার পর এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে? ঘটবে কি এর রিপ্রাইজেল? কারণ, ওয়্যার ডিপার্টমেন্টের রয়েছে ব্যাপক বিস্তৃতি ও আকার। যুক্তরাষ্ট্রের সব অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি এর আওতার মাঝে। মিলিটারি, করপোরেশন ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এর রিভলভিং ডোর অ্যাকশন নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে দিকনির্দেশনা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, ক্ষমতা, লোভ এবং সেই সাথে জাতিকে সার্বিক নিয়ন্ত্রণ রাখার ব্যাপারে। এটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির সবকিছুর সাথে সংশ্লিষ্ট। যতদিন না এর মুনাফার মনোভাব না থামবে, ততদিন সত্যিকারের শান্তিপূর্ণ সহযোগিতামূলক বিশ্ব পরিবেশ অসম্ভব।
সোরেনসেনের বইটি সঠিক উপায়ে ওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে জানা-বোঝার ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ। বইটিতে এ সম্পর্কে আছে প্রচুর তথ্য। সুষ্ঠু গবেষণার মাধ্যমে এসব তথ্য তিনি তুলে এনেছেন। তার রয়েছে মিলিটারি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল-কংগ্রেশনাল (এমআইসি) নেটওয়ার্র্ক সম্পর্কে বিস্তর জ্ঞান। এমআইসি সম্পর্কে জনগণকে জ্ঞানদানের প্রয়াস এর আগেও চলেছে। কিন্তু এসব প্রয়াসের মধ্যে এই বইটি সর্বোত্তম বলতে হবে। এটি যুদ্ধবিরোধী শান্তিপ্রিয় বিবেকী মানুষদের কাছে সমধিক জনপ্রিয়তা পাবে। বিশ্বব্যাপী ওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি তথা যুদ্ধ অর্থনীতির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে সোরেনসেনের এই বইটি নিশ্চিত ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। তবে সোরেনসেন যে কথাটি না বলেও বলতে চেয়েছেন তা হলো- এই ওয়্যার ইন্ডাস্ট্রির বিরূপ প্রভাব বিশ্বের ৯৫ শতাংশ দেশের মানুষের ওপর। সেসব দেশ ও দেশের নেতৃত্ব এবং সাধারণ মানুষ সচেতন না হলে ওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি অবসানে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের অপেক্ষায়ই থাকতে হবে। সেই সাথে প্রস্তুত থাকতে হবে সে পর্যন্ত দুর্ভোগকে মেনে নেয়ার ব্যাপারেও।