করোনা কি সত্যিই নিয়ন্ত্রণে!

সৈয়দ আবদাল আহমদ | Sep 13, 2020 05:56 pm
করোনাভাইরাস

করোনাভাইরাস - ছবি সংগৃহীত

 

ক্ষুদ্র এক অদৃশ্য ভাইরাস সারা পৃথিবীকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। মহাশক্তিধর রাষ্ট্র, ধনী রাষ্ট্র, পারমাণবিক অস্ত্রে সমৃদ্ধ রাষ্ট্র কিংবা গরিব ও দুর্বল রাষ্ট্র- কেউই এই ভাইরাসের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ভাইরাসটির কাছে পৃথিবীর মানুষ একরকম অসহায়ই বলা যায়। এটি ‘করোনাভাইরাস’ বা কোভিড-১৯।

করোনাভাইরাসের আনুষ্ঠানিক নাম বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন সার্স-সিওভি-২। এটি ফুসফুসে আক্রমণ করে মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করে। এর প্রধান উপসর্গ- শুষ্ক কাশি ও জ্বর, শরীর ব্যথা, গলা ব্যথা ও খুশখুশ, মাথাব্যথা, কখনো পেট খারাপ। সাধারণত শুষ্ক কাশি ও জ্বরের মাধ্যমেই শুরু হয় উপসর্গ। পরে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয়। উপসর্গ প্রকাশ পেতে চার-পাঁচ দিন সময় নেয়। ভাইরাসটির ‘ইনকিউবেশন পিরিয়ড’ ১৪ দিন। এটি এত বড় পরিসরে প্রদাহ তৈরি করে যে, শরীর পুরো ভেঙে পড়ে এবং একসাথে একাধিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ব্যর্থ হয়।

একেবারে অবুঝ শিশু ছাড়া এখন পৃথিবীর এমন কোনো মানুষ নেই, যারা কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস নামটি জানেন না। বলা যায়, পৃথিবীর সাতশ’-আটশ’ কোটি মানুষের প্রায় সবাই একবাক্যেই কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের আদ্যোপান্ত চেনেন। চীনের উহানে ভাইরাসটির উৎপত্তি কিংবা জন্ম। সেখানকার সামুদ্রিক মাছ ও বন্যপ্রাণী বিক্রির একটি পাইকারি বাজার থেকে বাদুড়, বনরুই কিংবা অন্য কোনো বন্যপ্রাণীর মাধ্যমে এটি মানবদেহে ছড়িয়েছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। উহানে গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর এটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। শতাধিক দেশে ছড়িয়ে পড়ার পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) মধ্য এপ্রিলে কোভিড-১৯ তথা করোনাভাইরাসকে ‘প্যানডেমিক’ বা ‘বৈশ্বিক মহামারী’ ঘোষণা করে। করোনায় ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিশ্বে ৯ লাখ ৩৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা দুই কোটি ৭৮ লাখ ২২ হাজার ৯৭৩ জন। সুস্থ হয়েছেন ৮০ লাখ।

৯ মাস ধরে মারাত্মক ছোঁয়াচে এই ভাইরাসের সংক্রমণ চলছে দেশে দেশে। এ পর্যন্ত বিশ্বের ১৮৭টি দেশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। বিচ্ছিন্ন কয়েকটি দ্বীপদেশ ছাড়া আর কোনো দেশ বাকি নেই, যেখানে করোনাভাইরাস নেই। এ ভাইরাসটির কারণে লকডাউন, কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, সামাজিক দূরত্ব, টেস্ট, করোনা পজিটিভ, নেগেটিভ প্রভৃতি শব্দ এখন মানুষের মুখে মুখে।

করোনাভাইরাসের উৎপত্তি চীনের উহানে হলেও চীন মাত্র দুই মাসের মাথায় রোগটি নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। চীনে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করোনায় মারা গেছে চার হাজার ৭৩৩ জন। সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ৯০ হাজার ১০০ জন। করোনা সংক্রমণে প্রথম দিকে ইউরোপের ইতালি, স্পেন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং উপসাগরীয় দেশ ইরানের অবস্থা খুব খারাপের দিকে গেলেও শেষ পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র সবাইকে ছাড়িয়ে যায়। আমেরিকা করোনা ভাইরাসে মৃত্যু এবং সংক্রমণ উভয় দিকে এক নম্বর। করোনায় আমেরিকায় ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক লাখ ৯০ হাজার ৩৩৪ জন লোকের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা ৬৩ লাখ ২৩ হাজার ৯৭৮ জন। করোনায় মৃত্যুর দিক দিয়ে দ্বিতীয়তম দেশ হচ্ছে ব্রাজিল। সেখানে এ সময়ে করোনায় মারা গেছে এক লাখ ২৮ হাজার ৫৩৯ জন। সংক্রমণের শিকার ৪১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৮৯ জন। আক্রান্তের দিক দিয়ে দ্বিতীয়তম দেশ হচ্ছে ভারত। এ সময়ে ভারতে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৪৪ লাখ ৬৫ হাজার ৮৬৩। ভারতে মৃত্যুর সংখ্যা ৭৫ হাজার ৬২। এরপর রয়েছে মেক্সিকো ৬৯ হাজার মৃত্যু, ব্রিটেন বা যুক্তরাজ্যে ৪১ হাজার ৫৯৪ জনের মৃত্যু, ইতালিতে মৃত্যু ৩৫ হাজার ৫৭৭ জন। করোনা মোকাবেলায় কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়ে প্রশংসিত হয়েছে নিউজিল্যান্ড, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশ।

কারোনা বাঘ এখন বিড়াল!
করোনাভাইরাসে প্রথম নাস্তানাবুদ হওয়া দেশ ইতালির স্যান মার্টিনো জেনারেল হাসপাতালের সংক্রামক রোগের প্রধান গবেষক অধ্যাপক ডা: মাত্তিও বাসিত্তি গত জুনের তৃতীয় সপ্তাহে ভাইরাসটি নিয়ে তার এক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, করোনাভাইরাস শক্তি হারিয়ে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। প্রতিষেধক ছাড়াই এটি নির্মূল হবে। মার্চ থেকে মে পর্যন্ত এটি হিংস্র বাঘের মতো আচরণ করেছে। কিন্তু জিনগত পরিবর্তনের ফলে এটি এখন বুনো বিড়ালে পরিণত হয়েছে। ভাইরাসটির প্রাণঘাতী ক্ষমতা অনেক হ্রাস পেয়েছে। একসময় দেখা যাবে, এটি সাধারণ বিড়ালে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আগের চেয়ে করোনা রোগীরা অনেক দ্রুত সেরে উঠছেন।’

ডা: বাসিত্তির সাথে তখন অনেক বিশেষজ্ঞই ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। তার পর্যবেক্ষণ এখন অনেকটা সত্যে পরিণত হচ্ছে। মনে হচ্ছে, করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী তার থাবা গুটিয়ে আনছে। ভাইরাসের আগ্রাসী ভাবটা এখন আর অতটা নেই। ধীরে ধীরে দেশগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস অ্যাধানম গেব্রেইয়েসুসও বলেছেন, এই ভাইরাস আপনা আপনি হয়তো যাবে না। এর সাথেই বসবাস করতে হবে। তবে দুই বছরের মধ্যে করোনা মহামারী বহুলাংশেই শেষ হবে। অবশ্য তিনি বলেছেন, বর্তমান বিশেষ উন্নত প্রযুক্তি ভাইরাসটিকে আটকে দেবে। অর্থাৎ তিনি কার্যকর টিকার দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রধান এ প্রসঙ্গে আরো বলেন, স্প্যানিশ ফ্লু দুই বছরের মধ্যে শেষ হয়েছিল। ১৯১৮ সালের ওই ফ্লুতে পাঁচ কোটি লোক মারা যায়।

নজর এখন করোনা টিকায়
করোনার ভ্যাকসিন বা টিকার দিকে মানুষ এখন চাতক পাখির মতো চেয়ে আছে। কবে করোনা টিকা পাওয়া যাবে- এটিই সবাই জানতে চায়। কার আগে কে বাজারে টিকা সরবরাহ করবে, এ নিয়ে একটা প্রতিযোগিতাও আছে। কারণ করোনা টিকাকে কেন্দ্র করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যের বিষয়ও আছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিভিন্ন দেশে করোনার ১৭৬টি সম্ভাব্য টিকা নিয়ে কাজ চলছে। এর মধ্যে ৩৪টি টিকা মানবদেহে পরীক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। যুক্তরাজ্যের ওষুধ প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকার সহযোগিতায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় গবেষকদের উদ্ভাবিত টিকাটি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে। মানবদেহে এ টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা চলছে। প্রাথমিক পরীক্ষায় এটি নিরাপদ ও কার্যকর বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। একজন স্বেচ্ছাসেবী অসুস্থ হয়ে পড়ায় এ টিকার পরীক্ষা স্থগিত করা হলেও সবাই আশাবাদী, দ্রুতই পরীক্ষার কাজ সম্পন্ন করে টিকা অনুমোদন করে বাজারে ছাড়া হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না, মার্কিন প্রতিষ্ঠান ফাইজার ও জার্মান প্রতিষ্ঠান বায়োএনটেক এবং চীনের সিনোভ্যাকের উদ্ভাবিত সম্ভাব্য টিকাগুলোরও তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা চলছে।

রাশিয়া ইতোমধ্যে তাদের করোনা ভ্যাকসিন ‘স্পুটনিক-৫’ নামের টিকার অনুমোদন দিয়েছে। নাগরিকদের জন্য টিকার প্রথম ব্যাচ উন্মুক্ত করা হয়েছে। মেডিক্যাল জার্নাল ‘দ্য ল্যানসেটে’ গবেষকদের নিবন্ধে বলা হয়েছে, রাশিয়ার টিকাটি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এ গবেষণায় অংশ নেয়া ব্যক্তিদের শরীরে টিকা দেয়ার পর অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. অ্যান্থনি ফাউসি রাশিয়ার টিকা কতটা নিরাপদ ও কার্যকর হতে পারে এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, আশা করি তারা এর নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা প্রমাণ করতে পেরেছেন। তার মতে, টিকা থাকা আর টিকা নিরাপদ ও কার্যকর হওয়া আলাদা বিষয়। আমাদের একডজন টিকা আছে। আমরা যদি কার্যকর টিকা দিতে চাই, সে সুযোগ রয়েছে। চাইলে আগামী সপ্তাহেই টিকা আনা যায়। তবে কাজটা এভাবে করা ঠিক নয়। যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) বলছে, ৫০ শতাংশ প্রয়োজন পূরণ করতে পারলেই তারা টিকা অনুমোদন দেবেন। ড. ফাউসি বলেন, করোনাভাইরাস একেবারে হয়তো নির্মূল করা যাবে না। তবে আবিষ্কৃত টিকা করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবে। তিনি জানান, ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বে কার্যকর টিকা পেয়ে যাব। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যাকসিনই হবে অধিকতর নিরাপদ।

বিভিন্ন দেশ আগেভাগে টিকা পাওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছে। কারণ করোনার সংক্রমণ নিয়ে তারা আর অনিশ্চয়তার থাকতে চান না। অস্ট্রেলিয়া সরকার তাদের সব নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে টিকার ব্যবস্থা করছে। এ জন্য বড় ফান্ডের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ চীনের টিকা ও ভারতের মাধ্যমে অক্সফোর্ডের টিকা সংগ্রহের চেষ্টায় আছে। দেশে মানুষ আশা করছে, সরকার বিনামূল্যে নাগরিকদের টিকা দানের ব্যবস্থা করবে। এ ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে ফান্ড জোগাড় করা যায়।

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের ছয় মাস পার হয়েছে। দেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তিন লাখ ৩১ হাজার। সুস্থ হয়েছেন দুই লাখ ৩৩ হাজার ৫৫০ জন। এ পর্যন্ত করোনা টেস্ট হয়েছে ১৬ লাখ ৯০ হাজার ১১ জনের।

দেশে প্রথম করোনায় মৃত্যু রেকর্ড হয়েছিল গত ১৮ মার্চ। ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনায় মারা গেছে চার হাজার ৫৯৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ তিন হাজার ৫৮২ জন, যা মোট মৃত্যুর ৭৮ শতাংশ। আর নারী মারা গেছেন এক হাজার ১১ জন। বেশির ভাগ মৃত্যুই ৬০ বছরের বেশি বয়সী রোগীদের। তাদের মোট সংখ্যা দুই হাজার ৩০০। এ ছাড়া ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সের এক হাজার ২৪৭ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সের ৬০১ জন, ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সের ২৭৭ জন, ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সের ১০৯ জন, ১১ থেকে ২০ বছর বয়সের ৩৯ জন এবং ১০ বছরের কম বয়সী ২০ জন মারা গেছেন। করোনাভাইরাসে যারা মারা গেছেন, তাদের বেশির ভাগই আগে থেকে একাধিক জটিল ব্যাধি যেমন- হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি সমস্যা, ফুসফুসের রোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার বা অন্য কোনো সমস্যায় ছিলেন। শনাক্ত রোগীর সংখ্যার ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম, আর মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে ২৯তম। ছয় মাসের মাথায় করোনা সংক্রমণের গতি কিছুটা ধীর হয়েছে। সংক্রমণের গড় হার এখন পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৯০ শতাংশ। কমিউনিটি ইনফেকশন বা সামাজিক পর্যায়ে সংক্রমণ থাকায় সংক্রমণের হার বেশি বলে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা কেন্দ্র (আইইডিসিআর) বিশেষজ্ঞরা জানান।

রাজধানী ঢাকায় করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। আইইডিসিআর তথ্য মতে, ২৭ মে পর্যন্ত ৫৪ শতাংশ রোগী ছিলেন ঢাকায়। গত ২৫ আগস্ট সেটি ছিল ৩৫ শতাংশ এবং ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ সংখ্যা ৩৪ শতাংশ। ঢাকার পরে রয়েছে ফরিদপুর, রাজবাড়ী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে। করোনা সংক্রমণের চতুর্থ মাস জুনে সবচেয়ে বেশি, এক হাজার ২৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।

গত এক সপ্তাহে বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৪০-এর নিচে, তার আগের সপ্তাহে ৪০ এর উপরে। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার আবার মৃত্যু ৪১ জন করে হয়েছে। জুন, জুলাই, আগস্ট এই তিন মাসেই সংক্রমণ সর্বোচ্চ মাত্রায় দেখা গেছে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস টেস্ট বা পরীক্ষার জন্য ৯৩টি ল্যাব রয়েছে। তবে এ পরীক্ষা আশানুরূপ হয়নি। প্রতিদিন গড়ে যেখানে ন্যূনতম ৩০ হাজার পরীক্ষা হওয়া দরকার ছিল, সেখানে এখন ১০ হাজার থেকে ১২ হাজারের বেশি হচ্ছে না। সর্বোচ্চ এক দিনে টেস্ট ১৮ হাজার পর্যন্ত হয়েছে। অর্থাৎ বিপুলসংখ্যক মানুষের কোভিড-১৯ পরীক্ষা হয়নি। দেশের ৩৮ জেলায় তো এখনো পরীক্ষা কেন্দ্রই নেই। এখন পর্যন্ত যে পরীক্ষা হয়েছে তাতে দেখা গেছে, বস্তিবাসী ও শ্রমজীবী গরিব মানুষের সংক্রমণ হয়েছে কম।

করোনার হালনাগাদ পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করে ওয়েবসাইট আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটার তথ্য অনুযায়ী, পরীক্ষার চেয়ে সংক্রমণে শনাক্তের হার বেশি- এমন দেশের তালিকায় এখনো শীর্ষ দশে আছে বাংলাদেশ। এখানে পরীক্ষা কম হলেও শনাক্তের হার ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি প্রায় ২০ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে সেটি ৭.৩৮ ও ভারতে ৮.৪৯ শতাংশ। আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা: মুশতাক হোসাইন বলেন, ‘বাংলাদেশে করোনাভাইরাস তার বৈশিষ্ট্য বদলাচ্ছে বা জিন পরিবর্তন করছে ঠিকই। কিন্তু বিপদ কমছে, বলা যাচ্ছে না। সংক্রমণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে আসতে আরো সময় লাগবে। ১০০ জন পরীক্ষা করে যদি পাঁচজন শনাক্ত হয় এবং এই হার পরপর তিন সপ্তাহ বজায় থাকে তবেই সংক্রমণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছাবে।’

বিচিত্র সব কাণ্ড ছয় মাসে!
করোনা মোকাবেলায় সরকার যেন হাল ছেড়ে দিয়েছে। মানুষও জীবন-জীবিকার তাগিদে করোনাকে অগ্রাহ্য করছে। করোনাভীতি এখন আর নেই। ‘যা হওয়ার তাই হবে’- মানুষের এ ধরনের মনোভাব এখন করোনাভাইরাস নিয়ে।

অথচ কিছু দিন আগেও এই করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে কত বিচিত্র ঘটনা এবং তেলেসমাতি কাণ্ডই না ঘটেছে বাংলাদেশে! করোনার কারণে পরিবারকে দূরে ঠেলে দেয়া হয়েছে, আত্মীয় হয়ে গেছেন পর, পড়শিরা একে অপরের সাথে স্বার্থপর আচরণ করেছেন। যে বাড়িতে করোনা রোগী আছে খবর পাওয়া গেছে, সে বাড়ি অনেকটা একঘরে করে রাখা হয়েছে। বিদেশফেরত কারো খবর ফেলে সে বাড়িতে টানিয়ে দেয়া হয়েছে লাল নিশান; যেন নিষিদ্ধ বাড়ি। করোনা রোগী বা রোগীর পরিবারকে বাসা থেকে উচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। ডাক্তার বা নার্সকে বাসা ভাড়া দেয়া হয়নি, অথবা ভাড়া বাসা ছাড়তে বলা হয়েছে।

করোনা রোগী নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে ঘুরে আরেক হাসপাতালে গিয়েও ভর্তি করানো যায়নি। চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে। টাঙ্গাইলের সখীপুরে করোনা আক্রান্ত মাকে ছেলেরা জঙ্গলে ফেলে গেছে। তেমনি বোন, ভাই বা অন্য স্বজনকে করোনা হওয়ায় দূরে ফসলের ক্ষেতে রেখে আসার ঘটনাও ঘটেছে। করোনায় মৃতদের জানাজা পড়তে দেয়া হয়নি, কবরে লাশ দাফনে বাধা দেয়া হয়েছে। ঢাকার খিলগাঁও তালতলা কবরস্থানে করোনায় মৃতদের দাফনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে এর বিরুদ্ধে এলাকাবাসী বিক্ষোভ করেছে। দাফনে বাধা দেয়া হয়েছে। বাবা-মা কিংবা সন্তানের জানাজায় পর্যন্ত একে অপরে অংশ নেননি।

অন্য দিকে করোনা থেকে সুরক্ষার এন-৯৫ মাস্ক, পিপিই ও অন্যান্য চিকিৎসাসামগ্রী কেনা ও বিতরণ নিয়ে হয়েছে নজিরবিহীন কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতি। কোভিড-১৯ পরীক্ষায় প্রতারণা, ভুয়া রিপোর্ট দেয়ার জালিয়াতির ঘটনায় বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা ধুলায় মিশেছে। ইতালি থেকে বাংলাদেশী যাত্রীদের এবং ফ্লাইট ফেরত পাঠানো হয়েছে। করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট দিয়ে রিজেন্টের সাহেদ, জেকেজির ডা: সাবরিনা কোটি কোটি টাকা কামাই করে ধরা পড়েছেন। অথচ এই সাহেদ টিভি টকশোতে গিয়ে নীতিকথার খই ফুটিয়েছেন এত দিন।

করোনায় প্রবাসী বাংলাদেশীরাও ভয়াবহ সঙ্কটে পড়েছেন। দুই থেকে আড়াই লাখ প্রবাসী বাংলাদেশী দেশে এসেছিলেন। তারা এখন যেতে পারছেন না। অনেকের চাকরি চলে গেছে। বিদেশে ২০টি দেশে ১৮২৯ জন বাংলাদেশী করোনায় মারা গেছেন। এর মধ্যে সৌদি আরবে মারা গেছেন ৭৮৮ জন।
করোনাভাইরাসের ক্ষত সহজে শুকাবে বলে মনে হয় না। মানুষ অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে পড়েছে। সামাজিক সঙ্কট বেড়েছে। শিক্ষাব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। রাজধানী ছেড়ে গেছে ১৬ শতাংশ দরিদ্র মানুষ।
করোনায় অমানবিক ঘটনার বিপরীতে মানবিক আচরণেরও উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। আল মারকাজুল ইসলামী, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, রহমতে আলম ফাউন্ডেশন, আল রশিদ ফাউন্ডেশন, আল মানাহিল ফাউন্ডেশন, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা করোনায় মৃতদের দাফন ও সৎকারে এগিয়ে আসে। করোনায় সাড়ে চার হাজার এবং করোনা উপসর্গ নিয়ে প্রায় দুই হাজার লাশকে এসব সংস্থার মাধ্যমে ভালোভাবে শেষ বিদায় জানানো সম্ভব হয়েছে।

গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র করোনা কিট উদ্ভাবন করলেও সরকারি অনুমোদন পায়নি আজো। করোনা মহামারী নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নানা বেসামাল মন্তব্য মানুষের বিরক্তির সৃষ্টি করেছে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, করোনাভাইরাসের ভয়ে মানুষ ঘরে প্যারাসিটামল, অ্যান্টিবায়োটিক, বিভিন্ন ভিটামিন, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক-পিপিইসহ বিভিন্ন ওষুধের মজুদ গড়ে তোলে। তেমনি গরম পানির ভাপ নেয়া, আদা তেজপাতা, লবঙ্গ, এলাচ সহযোগে গরম পানি পান, গড়গড়া করা, মধু, খেজুর, তুলসী, পুদিনাপাতা, কালিজিরাসহ দেশজ চিকিৎসার চর্চায় ব্যস্ত থাকে করোনা থেকে বাঁচার আশায়।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us