রেমিট্যান্স নিয়ে কী হচ্ছে

খন্দকার হাসনাত করিম | Sep 13, 2020 05:43 pm
রেমিট্যান্স নিয়ে কী হচ্ছে

রেমিট্যান্স নিয়ে কী হচ্ছে - ছবি সংগৃহীত

 

২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ নাগাদ বাংলাদেশে আগত রেমিট্যান্সের পরিমাণ ধরা হয়েছিল ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সরকার রেমিট্যান্সকে উৎসাহিত করতে ২ শতাংশ হারে ইনসেনটিভ (প্রণোদনার) কথাও ঘোষণা করেছিলেন। গত অর্থবছরে পরপর দু’টি ঈদ উৎসবের সময় রেমিট্যান্স হঠাৎ কিছু বৃদ্ধির ফলে মোট রেমিট্যান্সের প্রত্যাশা বেড়ে যায়। কিন্তু ঈদের ব্যতিক্রম পার হওয়ার পরই রেমিট্যান্সে আবার মন্দাভাব শুরু হয়। মধ্যপ্রাচ্যে নির্মাণ ও ভারী-অবকাঠামোগত প্রকৌশল প্রকল্পের কাজ কমে যাওয়ার ফলেই এই মন্দা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০১৮ ফলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় ছয় লাখ ৮৪ হাজার ৯৬২ জন বাংলাদেশী চাকরি পান, যা আগের বছরে ছিল ছয় লাখের মতো। মোট রেমিট্যান্স প্রবাহ কমার একটা বড় কারণ, আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বাংলাদেশীদের জন্য রুদ্ধ হয়ে যাওয়া।

সরকারি প্রণোদনায় অবৈধ পথের (হুন্ডি) রেমিট্যান্সের পরিবর্তে বৈধ বা ব্যাংকিং মাধ্যমে টাকা দেশে পাঠানোর একটা সুস্থ প্রবণতা পরিলক্ষিত হলেও ‘হুন্ডি’ ব্যবসায়ীরাও বসে নেই। তারা তাদের গুপ্তপথের সুপ্ত ব্যবসা ঠিকই রমরমা গতিতে চালিয়ে যায়। মানুষও চায় নগদ সুবিধা ও দ্রুত গতির আর্থিক লেনদেন। কর্মস্থল থেকে ব্যাংকের দূরত্ব এবং ছুটির অভাবজনিত কারণেও ‘হুন্ডি’ কারবারিরা সেই সুযোগ গ্রহণ করেছেন পূর্ণমাত্রায়।

করোনাকালের বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক অভিঘাতের বিরাট শিকার হয়েছে শ্রমশক্তি ও দক্ষতা রফতানিকারক দেশগুলোর ‘রেমিট্যান্স’ প্রবাহ। সমৃদ্ধ দেশগুলোর অর্থনীতি সঙ্কুচিত হওয়ায় নির্মাণ, শিল্প, অবকাঠামো ও সেবা খাতে সর্বত্র সঙ্কোচন ঘটেছে প্রবাসী বা অভিবাসী শ্রমিক-কর্মী-কর্মচারীদের কর্মসংস্থান। তাদের নিয়োগকর্তারা হাত গুটাতে শুরু করেছেন। ফলে প্রবাসী শ্রমজীবী ও দক্ষ জনশক্তি সবারই রুটিরুজির ওপর নেমে এসেছে নিদারুণ অনিশ্চয়তা। চাকরি যদিও বা বহাল আছে, কোথাও কোথাও বেতন-মজুরি কমে গেছে।

এর প্রতিক্রিয়া ঘটেছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিদেশমুখী শ্রমবাজারে। নতুন বাজার তো সৃষ্টি হয়ইনি, ঐতিহ্যবাহী শ্রমবাজারগুলোতেই চলেছে ছাঁটাই এবং বিদায়ের বিষাদময় পরিণতি। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কার মতো প্রবাসী শ্রমশক্তি রফতানির দেশগুলোর ‘রেমিট্যান্স’ খাতে মন্দা চলছে। বিমান চলাচলে করোনার প্রভাবের কারণে শ্রমিক-কর্মীদের দেশে ফিরে আসার ধারা থমকে থাকলেও বেকারত্বের অনিশ্চয়তায় খুবই অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন ধনী দেশগুলোয় কর্মরত উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রবাসী শ্রমিক-কর্মীরা। এই মন্দার ঢেউ থেকে বিশেষজ্ঞ বা বিশেষায়িত কর্মসংস্থানের সুযোগ ভোগকারী কারিগরি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষও রেহাই পাচ্ছেন না। স্কুল-কলেজ-প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষক এবং হাসপাতালগুলোতে কর্মরত ডাক্তাররাও বেকার হতে চলেছেন। যে প্রবাসী শ্রমিক-কর্মীরা তাদের দেশে ও সমাজে সচ্ছলতার একটা তুলনামূলক শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার ছিলেন, এখন তারা ফিরে যাচ্ছেন দারিদ্র্যের দিকে।

জনশক্তি রফতানিকারক দেশগুলোর প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো ‘রেমিট্যান্স’ কেবল তাদের পরিবার-পরিজন-পোষ্যদেরই জীবনমান উন্নত রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখতো না; তাদের ‘রেমিট্যান্স’ থেকে জনশক্তি রফতানিকারক দেশগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনও ছিল ক্রমবর্ধমানহারে সন্তোষজনক। সেই সন্তুষ্টি আজ হতাশার আঁধারে বিপন্ন। নতুন কর্মসংস্থানের পরিবর্তে এখন এসব দেশ তাদের ‘সোনার ডিম’ হারানোর বিপদ মোকাবেলা করছে।

সবচেয়ে বড় শঙ্কার বিষয়টি হচ্ছে- বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের এ বিরাট খাতটির বিপর্যয়, যার ওপর বহু দেশের অর্থনীতির একটা বড় অংশ নির্ভরশীল এবং ‘রেমিট্যান্সের’ সুফল সমাজের বহুমাত্রিক উপকারের যে কাঠামো গড়ে তুলেছিল, করোনা-মহামারীতে তা মুখ থুবড়ে পড়তে বসেছে। কত পরিবার যে প্রত্যক্ষভাবে ‘রেমিট্যান্স’ মন্দার শিকার হয়েছে, তা অনুমান করা যায় দেশগুলোর আর্থসামাজিক কর্মপ্রবাহে সৃষ্ট অচলাবস্থা থেকে।

অভিবাসী ও তাদের পোষ্যদের জীবনমান রক্ষায় প্রধান ভূমিকাই পালন করছিল তাদের কষ্টার্জিত রেমিট্যান্স। প্রবাসী শ্রমিক-কর্মীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা অর্থনীতির প্রান্তস্থিত জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার সুরক্ষায় আসলেই এক মস্তবড় Bastion বা নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তুলেছিল। মহামারী করোনা সেই নিরাপত্তা বেষ্টনীর গাঁথুনিকে ধসিয়ে দিতে বসেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ‘রেমিট্যান্স’ প্রবাহ ইতিহাসের সবচেয়ে মন্দ অবস্থায় পড়তে পারে।

বিশ্বব্যাংকের আশঙ্কা, ২০২০ সালে ৪৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিশ্ব রেমিট্যান্স প্রবাহের এক-পঞ্চমাংশ কমে যেতে পারে। পৃথিবীতে বর্তমানে প্রবাসীদের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী দেশের সংখ্যা ৬৬। দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এই বৈশ্বিক রেমিট্যান্স চিত্রটি বেশি প্রাসঙ্গিক এ জন্য যে, এখানে দারিদ্র্য প্রকট এবং প্রবাসীদের উপার্জনের ওপর এসব দেশের নির্ভরতা ব্যাপক। করোনা মহামারীর আগের বছর (২০১৯) শুধু ভারতেরই রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। নেপালের জিডিপির ২৮ শতাংশ এবং পাকিস্তানের জিডিপির ৮ শতাংশ আসে তাদের ‘রেমিট্যান্স’ থেকেই। রেমিট্যান্সের ভূমিকা জনশক্তি রফতানিকারক দেশগুলোর ক্ষেত্রে এতই ব্যাপক যে, এই বৈধ পন্থার প্রবাসী উপার্জনে মন্দার প্রতিক্রিয়ায় দেশগুলোর সমগ্র অর্থনীতিতে এই মন্দার ব্যাপক আঘাত হানতে শুরু করেছে। এটি নিতান্তই একটি চেইন রি-অ্যাকশনের মতো। প্রবাসে শ্রমবাজারের মন্দার সরাসরি প্রতিক্রিয়া ঘটেছে জনশক্তি রফতানিকারী দেশগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন খাতে। এর স্থানীয় ভূমিকা বা প্রতিক্রিয়া আরো বড় এবং বহুমাত্রিক।

প্রবাস থেকে প্রবাসী শ্রমশক্তির স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দেশগুলোর কর্মজগতে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে এবং আরো করবে। যত বেশি প্রবাসী দেশে ফিরবেন, এ চাপ তত প্রকট আকার ধারণ করবে। ২০২১ সালে মন্দা কাটিয়ে ওঠার আগে ২০২০ বা চলতি বছরে দক্ষিণ এশিয়ায় রেমিট্যান্সের পরিমাণ ২২ শতাংশ কমে যাবে বলে বিশ্বব্যাংকের ধারণা, শ্রমশক্তি রফতানিকারী দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ধারণা রেমিট্যান্স গড়ে কমবে ২৫ শতাংশ। ফলে এসব দেশের দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি জোগানে যে অগ্রগতি চলছিল, তা আবার পিছিয়ে পড়বে। রেমিট্যান্স উপার্জনকারী দেশগুলোর সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এখনই প্রতিবিধানমূলক ব্যবস্থা না নিলে এই মন্দা আরো দীর্ঘায়িত হতে পারে। এ জন্য চাই সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় এবং স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us