এবার জামিন হবে, নেমে পড়ুন
এবার জামিন হবে, নেমে পড়ুন - ছবি : সংগৃহীত
যে অবিশ্বাস্য নজিরবিহীন ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল পিরোজপুর থেকে। ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর দুর্নীতির অভিযোগে পিরোজপুর-১ আসনের সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল ও তার স্ত্রী, পিরোজপুর জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি লায়লা পারভিনের বিরুদ্ধে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক আলী আকবার বাদি হয়ে তিনটি মামলা দায়ের করেন। মধ্যে একটিতে আউয়াল ও তার স্ত্রীকে আসামি করা হয়েছে। বাকি দু’টি মামলার আসামি এককভাবে এম এ আউয়াল। মামলা দায়েরের পর তারা গত ৭ জানুয়ারি হাইকোর্টে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন জানালে একটি বেঞ্চ তাদের ৮ সপ্তাহের আগাম জামিন দেন। সে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর গত ৩ মার্চ তারা পিরোজপুরের জেলা জজ আদালতে জামিনের আবেদন করেন। জেলা জজ জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিলেন।
ওই ঘটনায় জেলা বারের আওয়ামী আইনজীবীরা আদালত বর্জনের ঘোষণা দিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। কিংবা নামিয়ে আনা হয়। এরপর সরকারের তরফ থেকে ঘটানো হলো সেই ন্যক্কারজনক ঘটনা। সরকার চায়নি। আউয়াল ও তার স্ত্রী যত বড় দুর্নীতিই করুন না কেন, তাদের গ্রেফতার করা যাবে না। ফলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো খুব দ্রুত। বিচারক মো: আবদুল মান্নানকে হঠাৎ রিলিজ করে দিয়ে ওএসডি করা হলো। বিকেলে তার স্থলাভিষিক্ত করা হলো তার জুনিয়র নাহিদ নাসরিনকে ভারপ্রাপ্ত জেলা জজ ও দায়রা জজ হিসেবে। আবদুল আউয়াল দম্পতির একই মামলা আবার উঠল নাহিদ নাসরিনের আদালতে এবং এ দম্পতির জামিন মঞ্জুর হলো।
এ নিয়ে দৃশ্যপটে চলে এলেন স্বয়ং আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। ধারণা করি, আইনমন্ত্রী পিরোজপুরের আদালতে হাজির ছিলেন না। তারপরও তিনি ঢাকায় সাংবাদিকদের বললেন, পিরোজপুরের জেলা ও দায়রা জজ মো: আবদুল মান্নান অত্যন্ত অশালীন ও রূঢ় ব্যবহার করায় তাকে তাৎক্ষণিকভাবে বদলি করা হয়েছে। পাশাপাশি, উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এ কে এম এ আউয়াল ও তার স্ত্রী লায়লা পারভিনকে জামিন দেয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের ওই নেতাকে কারাগারে পাঠানো ওই বিচারককে তাৎক্ষণিক বদলির আদেশ আইনের শাসনের ব্যত্যয় কিংবা বিচারিক কাজে হস্তক্ষেপ নয় বলেও দাবি করেন আইনমন্ত্রী। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ওই ঘটনায় জেলা বারের সবাই আদালত বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। এই পরিস্থিতিতে গণ্ডগোল চলছিল। রাস্তায় লোকজন বেরিয়ে পড়ছিল। সেটিকে কন্ট্রোল করার জন্য বিচারককে স্ট্যান্ড রিলিজ করে আদেশ দেয়া হয় আইন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে। জামিন দেয়া না দেয়া সম্পূর্ণভাবে আদালতের এখতিয়ার; কিন্তু আদালত যদি এমন ব্যবহার করে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন, যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও আইনের শাসন রক্ষা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তখন একটা ব্যবস্থা নিতে হয়। সেই অবস্থার আলোকে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পরদিন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘জেলা ও দায়রা জজের অত্যন্ত রূঢ় অশালীন ব্যবহারে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, বারের সকলে আদালত বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন।’
দ্বিতীয় কাণ্ড আরো চমৎকার। তার নায়ক ‘বিশাল’ ঠিকাদার যুবলীগ নেতা জি কে শামীম। তার ইঙ্গিত ছাড়া গণপূর্তের কোনো কাজ ছাড় হতো না। টেন্ডারগুলো এমনভাবে সাজানো হতো, যাতে শুধু শামীমের ঠিকাদারি কোম্পানিই টেন্ডার দিতে পারে। সেভাবে সরকারের প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার কাজ করছিলেন। শামীম দাবি করেছেন, তিনি গণপূর্তের এক নির্বাহী কর্মকর্তাকেই দেড় শ’ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন। তার বাসায় র্যাবের অভিযানে পাওয়া গেছে ডজন ডজন বোতল বিদেশী মদ, অস্ত্র, রংমহল। সেখানে প্রভাবশালীদের ডেকে এনে মদ ও নারীর আড্ডা বসাতো শামীম। তবে দেড় শ’ কোটি টাকা ঘুষ যদি নির্বাহী প্রকৌশলীকে দিয়ে থাকেন, তবে নির্বাহী প্রকৌশলী নিশ্চিয়ই সে টাকা একা খাননি। আরো বহু প্রভাবশালীকে ভাগ দিয়েছেন। ফলে সমাজে তিনি একা নন। তারও শুভানুধ্যায়ী, শুভাকাক্সক্ষীরা আছেন। গ্রেফতারের সময় তিনি র্যাবকেও বিপুল অঙ্কের ঘুষ সেধেছিলেন।
তেমনিভাবে ক্যাসিনো কাণ্ডের হোতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটও হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধ পথে উপার্জন করেছিলেন। তার ভাগ তিনি কাকে দিতেন, কিভাবে খরচ করতেন, তা এখন বলতে গেলে, কারো অজানা নেই। যারা তার টাকার সুবিধাভোগী তারা শাসক দলে আছেন বহাল তবিয়তে। দু-একজনকে লোক দেখানোর জন্য পদচ্যুত করা হলেও বাকিরা আছেন নিজ নিজ পদেই, সরকারের ভেতরেই। এখন ক্যাসিনো কাণ্ডের হাজার হাজার কোটি টাকার ভাগিদাররা সক্রিয়। সম্রাট আটক হয়েছেন বটে, কিন্তু নিশ্চয়ই প্রভাবশালী কোনো কোনো মহলে যোগসাজশে তিনি মাসের পর মাস আছেন পিজি হাসপাতালের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে, রাজার হালে। এসব সম্রাটের নাম এখন আর উচ্চারিত হয় না। বারবার কুমির ছানার মতো আমাদের দেখানো হয় এনু ও রূপনকে। শত শত কোটি টাকা আছে তাদের সিন্দুকে। কেজি কেজি সোনা আছে। শত শত ফ্ল্যাট আছে। আর যেন কারো কিছু নেই। আর যেন কেউ জড়িত নয়। অপেক্ষায় আছি, যেকোনো দিন হয়তো শুনব, ‘স্বাস্থ্যগত কারণে’ মুক্তি দেয়া হয়েছে সম্রাটসহ আটক অন্যদেরও। অথচ দুর্নীতির সাম্রাজ্যে তারা গুটিকয় নামমাত্র।
বলছিলাম, জি কে শামীমের কথা। যে শামীম সরকারের কাছ থেকে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন, তিনি তো আর এক হতে পারেন না। তার সুবিধাভোগীরা সরকারের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ফলে কী দারুণ কৌশল করে তারা শামীমের দুই মামলায় জামিন করিয়ে নিয়েছিল। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে তার নাম জালিয়াতি করে এই জামিন নেয়া হয়েছিল।
অনেকটা গোপনে হাইকোর্ট থেকে মাদক ও অস্ত্রের দুই মামলায় জামিন নেন বিতর্কিত ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম। তার জামিন আদেশের প্রায় এক মাস পর বিষয়টি গণমাধ্যমে উঠে আসে। ফলে নড়েচড়ে বসেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। মূলত নাম বিভ্রাটকে কেন্দ্র করেই জি কে শামীম আদালত থেকে জামিন পান বলে যুক্তি তুলে ধরে রাষ্ট্রপক্ষ। নিকেতনের নিজ কার্যালয় থেকে বিদেশী মদ, অস্ত্র ও বিপুল অঙ্কের নগদ টাকাসহ গত বছর ২০ সেপ্টেম্বর র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন জি কে শামীম। এ ঘটনায় শামীমের বিরুদ্ধে অস্ত্র, অর্থপাচার ও মাদক আইনে মামলা হয়েছে।
এর মধ্যে অস্ত্র ও মাদক মামলায় হাইকোর্টের পৃথক দু’টি বেঞ্চে শামীমের জামিনের আবেদন করা হয়। এরপর গত ৪ ও ৬ ফেব্রুয়ারি মামলায় শামীমকে জামিন দেন হাইকোর্ট; কিন্তু টাকা পাচারসহ আরো দু’টি মামলা থাকায় ওই সময় জামিনে মুক্তি পাননি জি কে শামীম।
এ দিকে বিষয়টি অনেকটা গোপনে হওয়ায় প্রায় এক মাস ধরে এ নিয়ে কোনো তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে ওই জামিনের বিষয়ে আদালতের লিখিত আদেশ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কোর্টের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এ বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। জি কে শামীমের বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর ৮ মার্চ জামিনের আদেশ রিকল করেন হাইকোর্ট।
শুনানিকালে রাষ্ট্রপক্ষের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফজলুর রহমান খান আদালতকে বলেন, আসামির নাম গোলাম কিবরিয়া ওরফে জি কে শামীম; কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের কার্যতালিকায় আছে এস এম গোলাম- এভাবেই তথ্য গোপন করা হয়েছে। আর আমাদের জামিন আবেদনের কোনো কপি দেয়া হয়নি।
এ দিকে জি কে শামীমকে এক বছর জামিন দেয়ার আবেদনটি রিকল করেন বিচারপতি রেজাউল হক ও বিচারপতি বিশ্বদেব চক্রবর্তীর হাইকোর্ট বেঞ্চ। এখানে শুনানিকালে নাম বিভ্রাটের কথাটি তুলে ধরেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জান্নাতুল ফেরদৌস রূপা। শুনানি শেষে মাদক মামলাতেও শামীমের জামিন বাতিল করেন হাইকোর্ট। তবে আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে সংযুক্ত জি কে শামীমের আইনজীবী মমতাজউদ্দিন মেহেদী বলেন, জি কে শামীম হওয়ার কারণেই আজ তার জামিন প্রত্যাহার করা হয়েছে। জামিন শুনানিকালে আদালত আইনের বই দেখেই জামিন দিয়েছেন। শুধু জি কে শামীম হওয়ার কারণেই রাষ্ট্রপক্ষের মাথাব্যথা। এ রকম মামলায় যেকোনো ব্যক্তিরই জামিনের হয়ে থাকে। শামীমের কাছ থেকে যে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে, তা লাইসেন্স করা। এটা মামলার এজাহারেই বলা হয়েছে।
কিন্তু এখানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একেবারে ভোল পাল্টে ফেললেন। তিনি বললেন, শামীমের জামিনের বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। আইনে স্পষ্ট আছে, জামিনের ব্যাপারে দুইপক্ষকে শুনতে হবে। এখানে যদি তার ব্যত্যয় হয়ে থাকে, তাহলে সেটিও অত্যন্ত দুঃখজনক। আর যদি ব্যত্যয় না হয়ে থাকে, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল যে বলছিলেন, তিনি জানতেন না, সেটিরও তদন্ত করতে হবে। মার্চ গড়িয়ে এখন সেপ্টেম্বর, কী তদন্ত হলো, জনগণ জানতে পারেনি। আবার জি কে শামীম কেমন করে এস এম গোলাম’ হয়ে জামিন পেল, আইনমন্ত্রীরই তো জবাব দেয়ার কথা। ছয় মাসেও তিনি রা করলেন না কেন?
তারও আগের ঘটনা বালিশ কাণ্ড ও পর্দা কাণ্ড। সাত হাজার টাকার বালিশ আর সাড়ে ৩৭ লাখ টাকার পর্দা নিয়ে অনেক কথা ও কাণ্ড ঘটে গেছে। বালিশ কাণ্ডের সর্বশেষ ঘটনা এই যে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের এই বালিশ কাণ্ডের অন্যতম হোতা ঠিকাদার শাহাদাত হোসেন ২৭ আগস্ট প্রায় গোপনে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
এর আগে দুদক জানিয়েছেন পাবনা গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুর রহমান ও অন্যদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে পাবনার রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের আসবাবপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী অস্বাভাবিক দামে কেনা দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান করা হবে।
ওই প্রকল্পের আবাসিক ভবনের জন্য ১৬৯ কোটি টাকার কেনাকাটায় পদে পদে দুর্নীতি হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এতে বলা হয়, গণপূর্ত অধিদফতরে কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন জোনভিত্তিক যে কেনাকাটা হয়ে থাকে, তার বার্ষিক একটি পরিকল্পনা থাকে। সে ক্ষেত্রে ৩০ কোটি টাকার নিচে কেনাকাটা হলে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের অনুমোদন লাগে না, স্থানীয় পর্যায়েই করা যায়। এর সুযোগ নিয়ে ১৬৯ কোটি টাকার কাজ ছয়টি প্যাকেজে ভাগ করা হয়। ফলে প্রতিটি কাজের মূল্য ৩০ কোটি টাকার নিচে হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের প্রয়োজন পড়েনি।
সেখানে প্রতিটি বালিশ কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে পাঁচ হাজার ৯৫৭ টাকা। আর প্রতিটি বালিশ আবাসিক ভবনের খাটে তোলার মজুরি দেখানো হয়েছে ৭৬০ টাকা। কভারসহ কমফোর্টারের (লেপ বা কম্বলের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত) দাম ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৮০০ টাকা যদিও এর বাজারমূল্য সাড়ে চার হাজার থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৩ হাজার টাকা। একইভাবে বিদেশী বিছানার চাদর কেনা হয়েছে পাঁচ হাজার ৯৩৬ টাকায়। এর বাজারমূল্য তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা।
পাঁচটি ২০তলা ভবনের জন্য এসব কেনাকাটা হয়েছে। প্রতিটি তলায় রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। প্রতিটি ফ্ল্যাটের জন্য কমফোর্টার শুধু বেশি দামে কেনাই হয়নি, কেনার পর দোকান থেকে প্রকল্প এলাকায় পৌঁছাতে আলাদা ট্রাক ব্যবহার করা হয়েছে। মাত্র ৩০টি কমফোর্টারের জন্য ৩০ হাজার টাকা ট্রাকভাড়া দেখানো হয়েছে। আর একেকটি কমফোর্টার খাট পর্যন্ত তুলতে ব্যয় দেখানো হয়েছে দুই হাজার ১৪৭ টাকা। কমফোর্টার ঠিকঠাক মতো খাট পর্যন্ত তোলা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য তত্ত্বাবধানকারীর পারিশ্রমিক দেখানো হয়েছে প্রতিটির ক্ষেত্রে ১৪৩ টাকা। ঠিকাদারের ১০ শতাংশ লাভ ধরে সম্পূরক শুল্কসহ সব মিলিয়ে প্রতিটি কমফোর্টারের জন্য খরচ দেখানো হয়েছে ২২ হাজার ৫৮৭ টাকা। শুধু কমফোর্টার নয়, চাদরের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। ৩০টি চাদর আনতে ৩০ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি ট্রাক ভাড়া করা হয়েছে। আর ভবনের নিচ থেকে খাট পর্যন্ত তুলতে প্রতিটি চাদরের জন্য মজুরি দেখানো হয়েছে ৯৩১ টাকা।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে আসবাব কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম খতিয়ে দেখার জন্য গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি তদন্তে প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ৩৪ জন কর্মকর্তার দুর্নীতি ও অনিয়মের সম্পৃক্ততা পেয়েছে। গত ২৭ জুলাই এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম।
ঘটনা তদন্তে দু’টি উচ্চপর্যায়ের কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে গণপূর্তমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, দু’টি কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়েছে, ৩৪ জন কর্মকর্তা বা ব্যক্তি এ ঘটনায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। এর মধ্যে ৩০ জন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের। চারজন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের।
তৎকালীন মন্ত্রী রেজাউল করিম জানান, এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অনিয়ম করে ৩৬ কোটি ৪০ লাখ ৯ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এই টাকা ফেরত নেয়া হবে। তাদের এখনো অনেক বিল পাওনা আছে, সেখান থেকে এই টাকা কেটে রাখা হবে।
প্রতিবেদনে ঠিকাদার সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চারটি ভবনে আসবাব ও ইলেকট্রনিক পণ্য সরবরাহের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সাজিন এন্টারপ্রাইজ, মাজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লিমিটেড এবং জিকেপিবিএল-পায়েল-এইচএল কনসোর্টিয়াম। সাজিনের সরবরাহ করা মালামাল সব থেকে নিম্নমানের। সাজিন একাই পেয়েছে ১৪৬ কোটি টাকার তিনটি কাজ। প্রতিবেদনে আর মাজিদ সন্স কনস্ট্রাকশনের সরবরাহ করা মালামাল সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘স্পেসিফিকেশন’ অনুযায়ী সরবরাহ করেনি। তবে জিকেপিবিএল-পায়েল-এইচএল কনসোর্টিয়ামের সরবরাহ করা মালামাল সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘অপেক্ষাকৃত ভালো’।
এদের মধ্যে সাজিন এন্টারপ্রাইজের মালিক শাহাদাত হোসেনের সাথে পাবনা সদর আসনের সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক খন্দকারের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। প্যাকেজে মোট ১৪৬ কোটি টাকার মধ্যে সাজিন এন্টারপ্রাইজ তিনটি কাজ পেয়েছে। একটি কাজ পেয়েছে মজিদ সন্স লিমিটেড। সাজিন এন্টারপ্রাইজের তিনটি কাজের মধ্যে একটি ২৯ কোটি ১৪ লাখ টাকার বিল গত বছরের অক্টোবরে পরিশোধ করা হয়েছে। তহবিলসঙ্কটের কারণে অন্যরা বিল নিতে পারেনি। তবে ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়ে বিল দিতে নিষেধ করেছে।
জিকেপিবিএল সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া জি কে শামীমের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান।
বালিশ কাণ্ডের এই ঠিকাদারের মুক্তিতেও ঘুমিয়ে পড়া শিশুটির মতো ‘চুপটি করিয়া আছেন’ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তবে তার কথা থেকে পিরোজপুরের আবদুল আউয়ালের মামলায় সব দুর্নীতিবাজের জন্য জামিনের একটি পথ বের হয়ে আসতে পারে। তাহলো মামলা হলে, আটক হলে কিছু দুর্বৃত্তকে দিয়ে রাস্তায় মিছিল নামানো এবং গণ্ডগোল বাধিয়ে দেয়া। তা হলে ‘গণ্ডগোল’ মেটানোর স্বার্থে মুক্তি পাওয়া যায়।
অতএব, জি কে শামীম, মো: সাহেদ, আরিফুল হক চৌধুরী, সাবরিনা শারমিন, অনেক টাকা দুর্নীতি করেছেন। কিছু টাকা খরচ করুন। জজ বদল করে হলেও জামিন মিলে যেতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com