কার আধিপত্য থাকবে মধ্যপ্রাচ্যে?

ডেভিড হার্শ | Sep 12, 2020 07:52 pm
কার আধিপত্য থাকবে মধ্যপ্রাচ্যে?

কার আধিপত্য থাকবে মধ্যপ্রাচ্যে? - ছবি : সংগৃহীত

 

যে তিন ব্যক্তি একটি আরব রাষ্ট্রের মাধ্যমে ইসরাইলকে প্রথম স্বীকৃতিদানের সমান্তরাল রেখা অঙ্কন করেছিলেন তারা সবাই ২৬ বছর ধরে তাদের পারিবারিক জীবনে অশান্তিতে রয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বুঝতে পেরেছেন, যেকোনোভাবে আমেরিকানদের নভেম্বরের নির্বাচনে যথাযথভাবে ভোটদান থেকে বিরত রাখতে হবে- তাদের ভোট প্রদান বন্ধ করতে হবে। কারণ আমেরিকার বেশির ভাগ নাগরিক ভোট দিতে পারলে বর্তমান রেটিং অনুযায়ী নির্বাচনে তিনি হেরে যাবেন। ইসরাইলি বিক্ষোভকারীরা দুর্নীতির অভিযোগে এবং করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ব্যর্থতার জন্য, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বাসভবনের বাইরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। আবুধাবির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ (এমবিজেড) তুরস্কে তার প্রথম অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা, এরপর কাতার অবরোধ, শেষে তার বিশেষ বাহিনীর ত্রিপোলি দখলে ব্যর্থতার পর সযত্নে লালিত আরেকটি প্রকল্পের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন। তার আগের সবগুলো প্রচেষ্টা ভণ্ডুল হওয়ার পর তিনি নতুন প্রকল্পের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

প্রত্যেক ব্যক্তি যখন একটি কূটনৈতিক অভ্যুত্থানের প্রয়োজন বোধ করেন তখন তাদের মিডিয়া সেটিকে হয়তো ‘ঐতিহাসিক বিষয়’ বলে আখ্যায়িত করতে পারে। ক্ষমতা হারালে কী ঘটতে পারে তা তারা প্রত্যেকে জানেন। ক্ষমতা হারালে নেতানিয়াহু এবং ট্রাম্পের স্থান হতে পারে কারাগারে। এমবিজেডের পরিণতি হতে পারে প্রবাসজীবন অথবা মৃত্যু। ইসরাইলের সাথে তার ভালোবাসা হচ্ছে তার লাইফ ইন্স্যুরেন্স বা জীবনবীমা। তাদের ব্যক্তিগত ভাগ্য অসাধারণভাবে পরস্পর সম্পৃক্ত।

এমবিজেডের একজন বিকল্প আঞ্চলিক সাহায্যকারী বা পৃষ্ঠপোষক দরকার। সত্যিকারার্থে ট্রাম্পের পেছনে তিনি অনেক মূল্যবান বিনিয়োগ করেছেন। তিনি জানেন, ট্রাম্প হোয়াইট হাউজ ত্যাগ করলে সিআইএ এবং পেন্টাগনে তার অনেক শত্রু জন্ম নেবে। আর প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসা নিয়ে মার্কিন ‘ডিপস্টেট’ ফিরে আসবে।

প্রতিবাদ বিক্ষোভ এবং ক্ষয়িষ্ণু কোয়ালিশন থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজে একাকী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করার মতো একটি এক্সিট পলিসি খুঁজে বের করা নেতানিয়াহুর দরকার। তার ডানপন্থীদের দ্বারা বারবার বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে ফিলিস্তিনি ভূমি অবৈধভাবে দখল বন্ধ করার কারণে তিনি অস্বস্তিতে পড়েছেন। তাই এই অবস্থা থেকে তিনি মুক্ত হয়ে রাজনীতি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান।
তিনি একটি ভিডিও বার্তায় গর্বসহকারে টুইট করে বলেন, ‘দেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছি- যেটা শান্তির জন্যে শান্তি।’ ‘আমি এত দিন ধরে এই ধরনের প্রস্তাবের জন্য চেষ্টা চালিয়ে এসেছি। ভূখণ্ড হস্তান্তর না করে, জেরুসালেমকে বিভক্ত না করে এবং আমাদের ভবিষ্যৎকে বিপদাপন্ন না করে শান্তি অর্জন করা সম্ভব। মধ্যপ্রাচ্যে যারা শক্তিশালী, তারা টিকে থাকবে এবং শক্তিমান লোকেরাই শান্তির পথ রচনা করবে।’

পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে চমক সৃষ্টি তথা স্ট্যান্টবাজির জন্য ট্রাম্পের একটি স্বাক্ষরের প্রয়োজন, যাতে তিনি তার ইহুদি জামাতা কুশনারের আহ্বানের একটি প্রতিদান হিসেবে সব রাজনৈতিক নেতাকে রাজধানীতে এ ব্যাপারে আহ্বান জানাতে পারেন।

তথাকথিত ‘ডিল অব সেঞ্চুরি’ সবসময়ের জন্য একটি মৃত বিষয়ে পরিণত হতে যাচ্ছে। কিন্তু ট্রাম্পের জন্য এটাকে বোধগম্য ও বাস্তবে প্রয়োগযোগ্য করা দরকার। কিন্তু এই চুক্তিকে মরক্কো, বাহরাইন, ওমান এবং সৌদি আরব সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। অথচ এই চুক্তির সাথে ইসরাইলের সাথে মিসর অথবা জর্দানের স্বাক্ষরিত চুক্তির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়ে গেছে। জর্দান ও মিসরের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তির আগে ব্যাপক আলাপ আলোচনা এবং ফিলিস্তিনিদের সাথে বিরোধ ও সঙ্ঘাতের একটি ন্যায়সঙ্গত সমাধানের আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।

কিন্তু আমিরাত-ইসরাইল চুক্তির ব্যাপারে কোনো আলোচনা হয়নি। প্রাসাদের ‘বাইরের খেলোয়াড়’রা এতে জড়িত রয়েছেন। এই চুক্তির ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনি কোনো পক্ষের সাথে কোনো আলোচনা করা হয়নি। এর অর্থ হলো, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে পূর্ব জেরুসালেমকে পরিত্যাগ করা হয়েছে এবং ১৯৬৭ সালের আগের ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ও সীমান্ত ফিরিয়ে দেয়ার ভিত্তিতে কোনো আলোচনা হয়নি। শান্তির জন্য এই চুক্তি করা হয়নি। অথচ আগে আরব নেতৃবৃন্দ ইসরাইলি নেতাদের সাথে নিয়মিত বৈঠকে বসেছেন। জর্দানের বাদশাহ আবদুল্লাহ (১) ইহুদি নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে বসেছেন ১৯৪৮ সালের আগে এবং তার নাতি বাদশাহ হোসেন ওই ঐতিহ্য অনুসরণ করেছেন। ইসরাইলি প্রতিপক্ষের সাথে বাদশাহ হোসেনের ৪২ বার বৈঠকে বসার কথা জানিয়েছেন তার জীবনীকার। মরক্কোর বাদশাহ হাসান তার বিরোধী পক্ষকে দমন করার জন্যে ‘মোসাদ’কে ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু দুই শত্রু পক্ষের মধ্যে এসব যোগাযোগ সত্ত্বেও আরব জনগণ ইসরাইলকে প্রত্যাখ্যান করার অবস্থান থেকে একটুও সরে আসেনি। ইসরাইলকে আমিরাতের স্বীকৃতি ফিলিস্তিন-ইসরাইল সঙ্ঘাত অবসানে কিছুই করতে পারবে না।

এই চুক্তি স্বৈরাচার এবং দখলদার- আরব স্বৈরশাসক এবং ইসরাইলি দখলদারদের মধ্যে একটি নতুন আঞ্চলিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস। যেহেতু আমেরিকা আঞ্চলিক আধিপত্য বা কর্তৃত্ব ছেড়ে দিচ্ছে- সে ক্ষেত্রে শূন্যস্থান পূরণ করতে ইসরাইল এবং আমিরাত এগিয়ে এসেছে। ইসরাইল এবং তার উপসাগরীয় ধনী প্রতিবেশীদের মধ্যে এই স্বীকৃতির মাধ্যমে বাণিজ্য, অব্যাহত টেলিকম, ভ্রমণ ইত্যাদি ‘নতুন সত্য’ হিসেবে আবির্ভূত হবে। আর এর পরিকল্পনাকারীরা মনে করেন, এর মাধ্যমে তারা ফিলিস্তিনি গ্রামগুলো এবং বসতির বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারবেন। সুতরাং ‘কোনো আলোচনার প্রয়োজন নেই। কেবল প্রয়োজন পরাজয় মেনে নেয়ার সাদা পতাকা।’ আমি দৃঢ়ভভাবে বিশ্বাস করি, ফিলিস্তিনিরা কখনো পরাজয় বরণ করার সাদা পতাকা উত্তোলন করবে না। গত সাত দশক ধরে তারা ইসরাইলি আধিপত্য ও জবরদখল মেনে নেয়নি। তারা টাকার বিনিময়ে রাজনৈতিক অধিকার বিসর্জন দেবে না। কিন্তু গাজা ও পশ্চিমতীরে এই চুক্তির বিরুদ্ধে জোরালো কোনো প্রতিবাদ বিক্ষোভ পরিলক্ষিত হয়নি। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্তকে ফিলিস্তিনি জনগণ, জেরুসালেম এবং আল আকসা মসজিদের জন্যে ‘নিন্দনীয়’ এবং ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে উল্লেখ করেছে। অবশ্য ফিলিস্তিনিদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে আরব জনগণের প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হয়েছে। ইসরাইলকে কূটনৈতিকভাবে স্বীকৃতিদানের বিরুদ্ধে আরবদের মনোভাব মোটেই কমেনি বরং বেড়েছে। আরব জনমত জরিপ অনুযায়ী, ২০১১ সালে এই বিরোধিতা ছিল ৮৪ শতাংশ এবং ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৭ শতাংশ।

এই চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে ফাতাহ ও হামাসের মধ্যকার তিক্ত বিরোধের অবসান ঘটবে। মাহমুদ আব্বাস আগে কখনো ফিলিস্তিন শাসনের ক্ষেত্রে হামাসের অংশগ্রহণকে মেনে নেননি। কিন্তু এখন ফাতাহর সেক্রেটারি জেনারেল জিবরিল রাজব হামাসের সেকেন্ড ইন কমান্ডের সাথে একত্রে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। জনাব রাজব সম্প্রতি তার সাথে এক যৌথ টেলিকনফারেন্সে প্রেস ইন্টারভিউয়ে বলেছেন, ‘আমরা একত্রে আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। ১৯৬৭ সালের আগের সীমান্তের ভিত্তিতে এবং আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্তের আলোকে শরণার্থী ইস্যু সমাধানের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা একত্রে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও যুদ্ধ চালিয়ে যাবো।’

আগে ফাতাহ নেতা দাহলান হামাস ও ফাতাহর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির জন্য চাতুর্যের সাথে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। আমিরাতের সাথে ইসরাইলের চুক্তির বিষয়টি ঘোষণা করার আগে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ‘এটা আমাদের আঞ্চলিক অর্থনীতি এবং আমাদের ভবিষ্যতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি বলেন, আমিরাত যে বিনিয়োগ করবে তাতে ইসরাইলি অর্থনীতি জোরদার হবে।’

জর্দান ও মিসরের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তির চেয়েও দ্রুত এই কালো ‘ভিশন’ ব্যর্থ হবে। ওই দু’টি দেশের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তি ছিল ‘বালির বাঁধ’। আমিরাত-ইসরাইল চুক্তি আরো সঙ্ঘাতের সৃষ্টি করবে। এই চুক্তি হচ্ছে পরাজয়ের নামান্তর। শুধু ফিলিস্তিন নয় গোটা আরব বিশ্বে আগামীতে যে নতুন জনপ্রিয় বিপ্লব শুরু হতে যাচ্ছে, তাতে এই চুক্তি ফাঁকা বেলুনের মতো উড়ে যাবে। ইতোমধ্যে হয়তো এই বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে। হ
লেখক : ‘মিডলইস্ট আই’য়ের প্রধান সম্পাদক

মিডলইস্ট আই থেকে

ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us