মোদি কি ট্রাম্পের হাতছাড়া হয়ে যাবেন?
মোদি ও ট্রাম্প - ছবি : সংগৃহীত
আমেরিকা তাদের হাতের কার্ড দেখিয়ে ফেলেছে। আমেরিকা কী করতে চায় বা কী আশা করে- তা আর্টিকেল লিখে প্রকাশ করে ফেলেছে। অনেকে এ পর্যন্ত এটা-সেটা বলে পেটের কথা বাইরে আনতে চেষ্টা করেছে বিভিন্ন সময়ে। ফাইনালই তারা এখন উপস্থাপনের একটাই ভাষ্য ঠিক করেছে। গুছিয়ে থিতু হয়ে বলা সেই ভাষ্যটা হলো- এশিয়ার দেশগুলো কোনদিকে যাবে; চীনের বেল্ট-রোডে নাকি আমেরিকান ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে, সেটা তাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাংলাদেশের চ্যানেল২৪ টিভি একটা নিউজ প্রচার করছে, তাতে বাংলাদেশে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত মিলার বাংলাদেশ এটা না ওটা নেবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে এখানে ‘চোঙ্গা ফুকতে’ দেখা গেল। তবে কোনোটাই না নেয়ার অপশন আছে কি না স্পষ্ট বোঝা যায়নি। ফলে যারা ভেবেছিলেন বাংলাদেশে ‘চীনা প্রভাব’ ছুটানোর জন্য ভারতীয় সর্বাত্মক তৎপরতা চীন-ভারত লাদাখ সীমান্ত সংঘর্ষের কারণে হাজির হয়েছে, তাদের অনুমান ‘ভুল’। বিষয়টা হলো- এশিয়ার চীনের বিরুদ্ধে একটা শেষ লড়াই লড়ার খায়েশ এখন আমেরিকার দুই দলেরই (বাই-পার্টিজান) খায়েশ, এই হলো বাস্তবতা। খালি তফাত এটুকুই যে, ট্রাম্প জিতলে একটু কৌশলে ভিন্নতা থাকবে যেটা বাইডেন জিতলে তুলনামূলকভাবে সফট কৌশল হবে। অর্থাৎ এশিয়ার চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকান লড়াইয়ের চেষ্টা হবে আসন্ন আমেরিকান নির্বাচনের পরের বিজয়ী প্রশাসনের হাত দিয়ে। কিন্তু লড়াই একটা কমবেশি হবে সেটা নিশ্চিত।
সেটা হলেও এটাকে শেষ লড়াই বলছি এ জন্য যে, ঠিক এটাই ওবামার প্রথম টার্মে চেষ্টা করা হয়েছিল ২০১১ সালে ‘এশিয়া পিভোট’ নাম দিয়ে যা ওবামার সেকেন্ড টার্মেও বিস্তৃত থাকলেও বোঝা গিয়েছিল যে, এটা অকেজো, কাজ করছে না; মানে ভুয়া চেষ্টা। ব্যাপারটা সার কথায় বললে, ‘পিভোটে’ অনুমানে ধরে নেয়া হয়েছিল এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো মনে করে, চীন এক আগ্রাসী শক্তি। আর তাই এই শক্তির বিরুদ্ধে এশিয়ার দেশগুলোকে একটা চীনবিরোধী জোটে আমেরিকা শামিল করতে পারবে বলে ধরে নিয়েছিল। কিন্তু এই অনুমান সঠিক ছিল না। তাই এটা ফেল করে যায়, কারণ এশিয়ার দেশগুলো বলতে চায়- চীনের অনেক কিছুতেই তাদের বিরোধিতা বা অপছন্দ থাকলেও সে জন্য আমেরিকান নেতৃত্বে কোনো চীনবিরোধী জোটে বা যুদ্ধজোটে তাদের ঢুকতেই হবে, এটি হবে আত্মঘাতী। এতে ‘ওভার অ্যাক্ট’ করা হয়ে যাবে। এর চেয়ে চীনের সাথে যদি কোনো দেশের সীমান্তবিরোধ থাকে তা নিয়ে আপত্তির কথা নিয়মিত বলে যাওয়া ও ডায়ালগের চেষ্টা করে যেতে হবে।
আর একই সাথে, উঠতি অর্থনীতির চীনের সাথেই অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা হবে নিজ দেশ পরিচালনার সঠিক কৌশল। কোনো যুদ্ধের সম্ভাবনার মধ্যে নিজ দেশকে ফেলে দেয়ার মানে হবে অর্থনৈতিকভাবে নিজ দেশকে শেষ করে দেয়া। কাজেই ওই আমেরিকান কৌশলে প্রায় কেউই নামেনি। তাই ওবামার শেষ বছর, পুরো ২০১৬ সালটাই ছিল আসলে তার ‘পিভোট’ গুটানোর বছর। কিন্তু পরের ট্রাম্প আমলে নিজের টার্মে চীনবিরোধিতাও তিনি অবশ্যই করেছেন, কিন্তু নিজে জাতিবাদী আমেরিকান হিসেবে কোনো জোট গড়তে অনাগ্রহী থাকেন। এতে ট্রাম্প প্রশাসনের পেন্টাগন আগে ‘চীন ঠেকানোর’ রাজনৈতিক তৎপরতার ধারা জারি রাখা বা আমেরিকান থিঙ্কট্যাংকগুলোর গাইড হিসেবে যে ভূমিকা রাখছিল সে কাজ থেকে পেন্টাগনকে প্রত্যাহার করে নিতে হয়। এ কারণে গত দুই বছর ধরে কিছু আমেরিকান থিঙ্কট্যাঙ্ক আবার নিজেরাই ‘চীন ঠেকানোর’ লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছিল। এবারের এই মিশনের মুখ্য ভূমিকায় আছে থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘আটল্যান্টিক কাউন্সিল’। এর ভূমিকাটা হলো, প্রায় সর্বক্ষণ মোদি সরকারের সাথে যোগাযোগ রাখছে জয়শঙ্করের মাধ্যমে। এ ছাড়া ভূমিকা রাখছিল থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘কার্নেগি অ্যান্ডোমেন্ট’।
এই অ্যান্ডোমেন্ট সেই বুশের আমলে ২০০৬ সাল থেকে ভূমিকা রাখছে। তখন থেকে যার রেজিস্ট্রার্ড ইন্ডিয়ান শাখা আছে। ভারতের চীনবিরোধী বয়ান ভাষ্য যা আমরা ভারতে দেখি বিশেষত সব ভারতীয় থিঙ্কট্যাংকের যে কমন অবস্থান, এটাকে সাজিয়ে দিয়েছে এই কার্নোগি অ্যান্ডোমেন্ট। যেমন চীন ভারতকে মুক্তমালার মতো ঘিরে ফেলছে বা চীনা ঋণের ফাঁদে সবাইকে ফেলছে ইত্যাদি। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর নিজের জাতিবাদী রাজনীতি হাজির করার আগে পর্যন্ত অ্যান্ডোমেন্ট প্রবলভাবে ভারতে নিজের ফান্ড ঢেলে তৎপর ছিল। নিয়মিত তরুণদের মাস্টার্স বা পিএইচডির জন্য স্কলারশিপ বরাদ্দ করেছে আর ওসব বয়ান মুখে তুলে দিয়েছে। কিন্তু ট্রাম্পের অবস্থান তাদেরকে এর পর থেকে তৎপরতা ছোট করে আনতে বাধ্য করেছিল। এই কার্নেগি অ্যান্ডোমেন্টের পক্ষ থেকে এশলে জে তাল্লিস আমেরিকান আগামী সম্ভাব্য অবস্থানের ডকুমেন্টটা তৈরি করেছেন। এই লেখাকে কার্নেগি অ্যান্ডোমেন্টের পক্ষ থেকে সাম্প্রতিক পলিসি ব্রিফিং হিসেবে উল্লেখ করে হিন্দুস্তান টাইমসে একটি আর্টিকেল ছাপানো হয়েছে। লিখেছেন মঞ্জরি চ্যাটার্জি মিলার, যিনি বোস্টন ইউনিভার্সিটির প্যাড্রি স্কুলের অধ্যাপক। তিনি নিজের লেখাটা পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন এভাবে- ‘আমেরিকার দীর্ঘ দিনের এক খায়েশ, ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে এশিয়ায় কাউন্টার-ওয়েট হিসেবে কাজে লাগায়। ভারত কী তা করবে?’
ওই পুরো লেখাতেই গুরুত্বপূর্ণ শব্দ হলো এই ‘কাউন্টার-ওয়েট’, বাংলায় চীনের পাল্টা ওজনের বাটখারা। অধ্যাপক মঞ্জরি এশলের এই লেখাটা ছাড়াও আরেকটা লেখার কথা তুলেছেন। তা হলো- ড্যানিয়েল টেনরিরোর লেখা; যার শিরোনাম ‘এশিয়ায় চীনের পাল্টা বাটখারা হিসেবে ইন্ডিয়া’।
ড্যানিয়েলের লেখাতে পরিষ্কার যে, ভারতকে চীনের কাউন্টার-ওয়েট হিসেবে এশিয়ায় পাওয়া- এর প্রয়োজনটা ভারতের না, খোদ আমেরিকার ও ড্যানিয়েলের মতো স্ট্র্যাটেজিস্টদের। তাই ড্যানিয়েল বা মঞ্জরি আশা রাখছেন, ভারত কি আমেরিকার হয়ে এই ভূমিকায় নামবে? কিন্তু কেন?
কারণ তাদের চাহিদা হলো- চীনের পাল্টা ওজনদার রাষ্ট্রটাকে হতে হবে আমেরিকার হাতের পুতুল। চীনের মতো না হলেও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় হতে হবে। আর মি. এশলে কোনো লাজলজ্জার বালাই না রেখে বলেছেন, ভারত বা সেই পাল্টা ওজনদার রাষ্ট্রটাকে দু’টি শর্ত মানতে হবে- ‘ইকোনমিক অগ্রগতি’ ফেরত আনতে হবে আর ‘লিবারেল বৈশিষ্ট্যের’ হতে হবে।
কিন্তু কেন এশলেকে ভারতের নাম শর্ত আকারে বলতে হলো? এশলে লেখাটার শিরোনাম হলো ‘বড় লিগে যোগ দিতে হলে ভারতের রাস্তা’। আসলে এশলে তার লেখাটা শুরুর আগেই বুঝে গেছেন, ভারত তাদের পেয়ারের কাম্য চীনের পাল্টা হবু ওজনদার দেশ হচ্ছে না। তাই তিনি আসলে লিখতে বসেছেন- কেন ভারতকে দিয়ে হবে না। সে কারণে উল্টা করে লিখতে বসেছেন কোন শর্ত পূরণ করলে হবে। যেখানে এশলে জানেন, এই শর্ত ভারত পূরণ করতে পারবে না। তাই তিনি শর্ত লাগিয়ে বলছেন।
আবার সমালোচকের চোখ দিয়ে দেখে বললে, এশলে অ্যান্ড গং-এরা চীনের কাউন্টার-ওয়েট বলে কাউকে খুঁজেই পাবে না যদিও ভারতের প্রবল আর বিশেষ ‘খামতি’ আছে। কিন্তু ভারতের খামতি না থাকলেও এশলেরা ভারতকে বেছে নিতে পারতেন না। কেন?
কারণ আমেরিকার দরকার এমন এক ভারত যাকে সে চীনবিরোধী তাদের মডেল দেশ হিসেবে তুলে ধরতে পারে। চীন খারাপ, চীন আদর্শ না, চীন কথিত লিবারেল দেশ নয়, ইত্যাদির বিপরীতে যেন তারা ভারতকে তুলে ধরতে পারে- ভারত আমেরিকার চোখে আদর্শ দেশ, এভাবে। আবার ভারতকে এমন আদর্শ দেশ বলে ফুলানোর কী দরকার? দরকার এ জন্য যে, ভারত লিবারেল- এই প্রশংসা করে এর বিনিময়ে ভারতের ওপর মাতব্বরি করতে চায় আমেরিকা, তাদের বিপুল বিনিয়োগ আর লাভালাভের কেন্দ্র বানাতে চায় ভারতকে। সে জন্য ভারতে তাদের ইচ্ছামতো একটা সংস্কার করে সাজিয়ে নিতে চায়। যেমন- এশলের লেখায় আরো দু’টি বিশেষ শব্দ আছে- ‘ফাস্ট-গ্রোয়িং ‘ফ্রি মার্কেট ডেমোক্র্যাসি’। এর মধ্যে সোনার পাথরের বাটিটা হলো ‘ফ্রি মার্কেট ডেমোক্র্যাসি’। এখানে ‘ফ্রি মার্কেট’ শব্দের সাথে ‘ডেমোক্র্যাসি’ শব্দের কী সম্পর্ক? এসবের অর্থহীন কথা ও শব্দের ভেতর দিয়ে তারা বুঝাতে চায়- ভারতকে আমেরিকার ডমিনেটেড বাজার ব্যবস্থা করে গড়ে পেতে চায় তারা। কিন্তু জবাব দিতে চায় না ভারত কেন এটা তাদেরকে দেবে?