মোদি-জয়শঙ্করের নতুন হিসাব
মোদি-জয়শঙ্কর - ছবি : সংগৃহীত
বাস্তবতা ভারতের সাথে আমেরিকার ‘চীন ঠেকানো’ কাউন্টার ওয়েট হিসেবে ভারতকে ব্যবহারের কোনোই সম্পর্ক কার্যকর হচ্ছে না; যদিও এমন ভাব নেয়া অঙ্গভঙ্গি সম্ভবত জীবিত থাকবে। অনেক সময় প্রমাণিত সত্য জিনিস মেনে নিতে কষ্ট হয়। তেমন অবস্থার উদ্ভব হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর মোদির কাছে প্রমাণিত যে, চীন তার হিন্দুত্বের রাজনীতির জন্য তুলনামূলক ভালো বিকল্প। তবু চীনের বেলায় যেটুকু সঙ্ঘাত বারবার সামনে এসে পড়বেই সেটা বারবার এড়িয়ে হলেও মোদি চলতে পারবেন। কিন্তু যেটা সহসা চীন-ভারত সম্পর্ককে আগের জায়গায় ফিরতে দেবে না তা হলো- সারা ভারতে ‘চীন আমাদের শত্রু’ বলে যে ক্যাম্পেইন ভারত চালিয়েছে তা সহসাই লোপ পাবে না।
আবার অন্য দিকে, আমেরিকা ও তার বন্ধুরা যেটাকে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক জোট’ বলে ড্রাম পিটাচ্ছে এই প্রপাগান্ডা সহসাই থেমে যাবে না; ভারতের সাথে সম্পর্ক হোক আর নাই হোক তা জারি থাকবে। দ্বিতীয়ত, এর আরেকটা নাম আছে এশিয়ান-ন্যাটো। মানে ইউরোপে যেমন ১৯৪৫ সালের পরে সোভিয়েতবিরোধী সবাইকে ন্যাটো সামরিক জোটে জড়ো করা হয়েছিল, সেই ন্যাটোই যেন এবার এশিয়ায় জাগতে যাচ্ছে এমন ভাব শুরু করেছে। মোদির প্রো-আমেরিকান মন্ত্রী জয়শঙ্কর তাই একবার বলেন, ভারত জোটনিরপেক্ষ দেশ; আরেকবার বলেন, এশিয়ান ন্যাটোর কথা। ব্যাপারটা নিয়ে জয়শঙ্করের সবচেয়ে বড় সমালোচক হলেন প্রচণ্ড ক্ষেপা এমকে ভদ্রকুমার, তিনি এক সিনিয়র সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক রাষ্ট্রদূত ও কলাম লেখক।
তামাশার দিকটি হলো- এই জয়শঙ্করই আবার মস্কোতে সাংহাই করপোরেশনের মিটিংয়ে হাজির হওয়ার উছিলায় চীন-ভারত মস্কোর মধ্যস্থতায় যে পাঁচ দফা আপস সমঝোতা করল সেখানে ভারতের প্রতিনিধি। জয়শঙ্করের গা থেকে তখনো আমেরিকান কোনো ডিনারের ঢেঁকুর উঠছিল হয়তো। রয়টার্সই একমাত্র এর ব্যাপক রিপোর্টিং করেছে। তাতে তারা দু’টি ছবি ছেপেছে যেখানে রাশিয়া, চীন ও ভারতের তিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পোজ দিয়ে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু তিনজনই ‘ফানি’ভাবে নানা অঙ্গভঙ্গি করে ছবি তুলেছেন, যেটা অবশ্যই কূটনৈতিক আচরণ নয়; যেন আমেরিকাকে তিনজনে ঠাট্টা করতে এসব করেছেন। এর বটম লাইনটা হলো, চীন-ভারতের সম্পর্ক সহসাই আগের লেভেলে ফিরে যাচ্ছে না। আর দ্বিতীয়ত, চীন ঠেকানোর কাজে ভাটা পড়লে আমেরিকার কাজের অভাবেই মারা যাবে! একমাত্র একটু ভরসা, নির্বাচনে বাইডেন যদি জিতেন। সে ক্ষেত্রে চীনের থেকে বাণিজ্যে অনেক বড় ছাড় আনতে পারবেন তিনি।
ফলে ট্রাম্প আমলের বাণিজ্যযুদ্ধের অনেকটাই স্মৃতিতে পেছনে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু হিউম্যান রাইট ইস্যুতে বাইডেন অনেক বেশি চীনকে ঘায়েল করবেন। এ ব্যাপারে ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার সেক্রেটারি অব ডিফেন্স মার্ক এস্পারের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোনকল তাৎপর্যপূর্ণ। ঢাকার অভ্যন্তরীণ মিডিয়া ‘রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সহায়তার’ ওপর জোর দিলেও ঢাকার দূতাবাসের বিবৃতিতে ‘একটি অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিকের প্রতি তাদের যৌথ প্রতিশ্রুতির’ ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এর অভ্যন্তরীণ আমেরিকান মেসেজটা হলো- যেন বলতে চাচ্ছে, আমরা চীন ও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে হিউম্যান রাইট ইস্যুতে শক্তভাবে চেপে ধরতে আসছি। ফলে আমরাও আপনার কাছে গুরুত্ব চাই। ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যুতে তাই আমাদের ক্যাম্পে আসুন। অর্থাৎ ভারতকে আমেরিকা পাচ্ছে না, আপাতত এটাই সারকথা মনে হলেও মিয়ানমার বা ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যুতে বাংলাদেশের জন্য এগুলো ডমিনেটিং বিষয় হতে যাচ্ছে সম্ভবত। তবে বাংলাদেশের সাথে আমেরিকান প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা অথবা ইন্দো-প্যাসিফিক জোট কোথায় সম্পর্কিত তা এই ফোনকল স্পষ্ট করতে পারেনি।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com