অসুস্থ ব্যক্তির শুশ্রূষা : ইসলামি বিধান
অসুস্থ ব্যক্তির শুশ্রূষা : ইসলামি বিধান - প্রতীকী ছবি
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তার ইবাদতের জন্য। ভূপৃষ্ঠে কেউই স্থায়ীভাবে থাকতে পারবে না। তাই প্রত্যেক বান্দার কাজ হচ্ছে দুনিয়া থেকেই পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করা। মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে তাঁর দরবারে হাজির হওয়া। মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য আল্লাহ তায়ালা অনেক ধরনের বিধান দিয়েছেন। এর মাঝে এমন কিছু আমল রয়েছে যা আমল করা অনেক সহজ কিন্তু তার সওয়াব অপরিসীম। একটু আগ্রহ ও মনোভাব থাকলে এ সওয়াব অর্জন করা যায়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘ইয়াদাতুল মরিজ’ বা অসুস্থ ব্যক্তির শুশ্রূষা। মানবিকভাবেই অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া আমাদের কর্তব্য। এর সাথে যদি সওয়াবের নিয়তে দেখতে যায় তার জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার। রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, এক মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের হক পাঁচটি- সালামের জবাব দেয়া, রোগীকে দেখতে যাওয়া, জানাজায় শরিক হওয়া, দাওয়াত কবুল করা, হাঁচির জবাব দেয়া। (বুখারি, হাদিস-১৫২৪)
হজরত বারা ইবনে আজিব রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: আমাদের সাতটি কাজের নির্দেশ দিয়েছেন- প্রথম, রোগীর শুশ্রূষা করা; দ্বিতীয়, জানাজার পশ্চাতে চলা। তৃতীয়, হাঁচিদাতার জবাবে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলা; চতুর্থ, দুর্বল মানুষের সাহায্য করা। পঞ্চম, নিপীড়িত ব্যক্তিদের সাহায্য করা; ষষ্ঠ, সালামের প্রচার-প্রসার ঘটানো; সপ্তম, কসমকারীর কসমকে পুরা করতে সাহায্য করা। (বুখারি, হাদিস-৫৬৩৫)
অসুস্থতা কত বড় যন্ত্রণা যে ভুক্তভোগী সেই অনুধাবন করতে পারে। মহান আল্লাহ তায়ালা তাই অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়ার ফজিলত রেখেছেন, যা আমাদের নবী কারিম সা: সবিস্তারে আমাদের সামনে রেখে গেছেন।
আল্লাহর সাথে থাকা : যতক্ষণ পর্যন্ত সে অসুস্থ ব্যক্তির কাছে থাকে ততক্ষণ সে আল্লাহর সাথেই আছে। হাদিসে কুদসিতে বলা হয়েছে, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে যাওনি।’ বান্দা বলবে, আপনি তো বিশ্বজাহানের প্রতিপালকÑ আমি আপনাকে কিভাবে দেখতে যেতে পারি? আল্লাহ বলবেন, ‘আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল। তুমি তাকে দেখতে গেলে সেখানে আমাকে পেতে।’ (সহিহ মুসলিম-২১৬২)
ইমাম নববী রহ: বলেন, তাঁর কাছে আমাকে পেতে অর্থ হচ্ছে, আমার পক্ষ থেকে সওয়াব ও রহমতপ্রাপ্ত হতে।
ফেরেশতারা তাঁর জন্য দোয়া করে : আলী রা: বললেন, রাসূলুল্লাহ সা:কে আমি বলতে শুনেছিÑ কোনো মুসলমান যদি অন্য কোনো মুসলিম রোগীকে সকাল বেলা দেখতে যায় তাহলে ৭০ হাজার ফেরেশতা তার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত দোয়া করতে থাকে। সে যদি সন্ধ্যায় তাকে দেখতে যায় তবে ৭০ হাজার ফেরেশতা ভোর পর্যন্ত তার জন্য দোয়া করতে থাকে এবং জান্নাতে তার জন্য একটি ফলের বাগান তৈরি হয়।
আল্লাহর অবারিত রহমতে ডুবে থাকে : জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা: বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘যে রোগীর খোঁজখবর নিলো সে আল্লাহর রহমতে ডুবে গেল আর সে যখন বসল তখন সে তার মধ্যে স্থির হয়ে গেল।’ (আল আদাবুল মুফরাদ, হাদিস-৫২২)
জান্নাতে বিচরণ : সাওবান রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘যখন কোনো মুসলিম তার (অসুস্থ) মুসলিম ভাইয়ের সেবায় নিয়োজিত হয়, সে ফিরে আসা পর্যন্ত জান্নাতের ফলবাগানে (তার ছায়ায়) অবস্থান করতে থাকে।’ (সহিহ মুসলিম-২৫৬৮)
পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবদের কেউ অসুস্থ হলে তার খোঁজখবর নেয়ার ব্যাপারে অবহেলা করা উচিত নয়। যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে রোগীকে সাহস জোগাবে, তার মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করার চেষ্টা করবে।
ইসলামী শরিয়তে অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখার কিছু শিষ্টচার রয়েছে, যা আমরা অনেক সময় নিজের অগোচরেই লঙ্ঘন করি। যে সওয়াবের কথা বলা হয়েছে তা তখনি আমরা পাবো যখন এ আদবগুলোর প্রতি যতœবান হবো। অন্যথায় সওয়াবের পরিবর্তে পাপের বোঝা ভারী করার সম্ভাবনাই বেশি।
উপযুক্ত সময়ের প্রতি লক্ষ রাখা : কেউ অসুস্থ হয়েছে এ কথা শুনা মাত্রই চলে যাওয়া ঠিক হবে না। বরং রোগীর প্রতি লক্ষ রাখবে, তিনি কি করছেন। প্রয়োজনে কারো কাছ থেকে জেনে নেবে।
দোয়া পড়া : রোগী দেখার পর আমাদের রাসূল সা: আমাদের কিছু চমৎকার দোয়া শিখেয়েছেন রোগীর সামনে এগুলো পড়া। এক হাদিসে এসেছে দোয়া পাঠ করা : আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: রোগী দেখে সাতবার এই দোয়া পাঠ করতেন (উচ্চারণ) ‘আসআলুল্লাহাল আজিমা রাব্বাল আরশিল আজিমি আই-ইয়াশফিয়াকা’ (অর্থ) আমি মহান আল্লাহর কাছে যিনি মহা আরশের প্রতিপালক তোমার সুস্থতা কামনা করছি।’ (সুনানে তিরমিজি-২০৮৩)
রোগীকে সান্ত্বনা দেয়া : যত বড় রোগ হোক তাকে ধৈর্যধারণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া। আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যধারণকারীদের জন্য বিশাল পুরস্কার রেখে দিয়েছেন। নবী সা:-এর সহধর্মিণী আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘মুসলমান ব্যক্তির ওপর যে সব বিপদ-আপদ আপতিত হয় এর দ্বারা আল্লাহ তার পাপ মোচন করে দেন। এমনকি যে কাঁটা তার শরীরে বিদ্ধ হয় এর দ্বারাও। ’ (সহিহ বুখারি-৫৪৫)
রোগীর কাছ থেকে দোয়া চাওয়া : যেকোনো রোগীর কাছে নিজের জন্য দোয়া চেয়ে নেবে। কারণ, হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: তাঁকে বলেন, ‘যখন তুমি কোনো রোগীর কাছে যাবে, তাকে বলবে তোমার জন্য দোয়া করতে। কেননা, তার দোয়া ফেরেশতাদের দোয়ার মতো।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ-১৪৪১)
সর্বোপরি রোগীর কষ্ট হয় এমন সব আচরণ থেকে বিরত থাকা, তাকে অপ্রয়োজনীয় ও বিরক্তিকর প্রশ্ন না করা। ডাক্তার ও হাসপাতালকর্মীরা একটি মহান পেশায় নিয়োজিত। একটু বিশুদ্ধ নিয়ত তাদের আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দা হওয়ার সুযোগ।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, জামিয়া বাবুস সালাম, বিমানবন্দর ঢাকা-১২৩০