আফগানিস্তানে যেভাবে কোণঠাসা ভারত
আফগানিস্তানে যেভাবে কোণঠাসা ভারত - ছবি : সংগৃহীত
২০১৫ সালের গ্যালাপ জরিপ অনুযায়ী ভারত ছিল আফগানিস্তানে সবচেয়ে জনপ্রিয় দেশ, যাদের গ্রহণযোগ্যতার হার ছিল ৬২ শতাংশ। পাঁচ বছর পরে ভারতের গ্রহণযোগ্যতা এখনো বজায় থাকলেও তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাসের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এর কারণ দুটি : ভারতে ইসলামবিদ্বেষ বৃদ্ধি, এবং বলিউডে মুসলিম ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের চরিত্র হননের অপতৎপরতা।
বর্তমান আফগানিস্তান আর ভারতের মধ্যে লেনদেনের সম্পর্ক বহু শহস্রাব্দের। দৃশ্যপটে ইসলাম আসারও অনেক আগে থেকেই দখলদারিত্ব আর বিনিময় চলে আসছে। উত্তর ভারতে গজনবী আর ঘোরিদের অভিযানেরও অনেক আগে অমুসলিম কুশান আর হেফথালাইটরা আফগানিস্তান থেকে এসে উত্তর ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল।
কুশান আর হেফথালাইটদের আগে আবার বিহারের মৌরিয়ান সাম্রাজ্য আফগানিস্তানে তাদের প্রভাব বিস্তার করেছিল। মৌরিয়ান সাম্রাজ্যের সময়েই ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্ম আফগানিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে, এবং আফগানিস্তান হয়ে চীনে প্রবেশ করে। এর এক সহস্রাব্দেরও পরে আফগানিস্তান দিয়ে উত্তর ভারতের বিরাট অংশ জুড়ে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে।
ভারত স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত ভারতের মুসলিমরা আফগানিস্তানের মুসলিমদের সাথে জোরালো সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। আফগানিস্তানে গত ৪২ বছরের যুদ্ধ চলাকালে ভারত সবসময় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আফগান সরকারের পক্ষ নিয়েছে। সেখানে ভারতের জনপ্রিয়তার পেছনে এটা অন্যতম কারণ।
ভারতের জনপ্রিয়তা সত্বেও আফগানরা এখন ভারতে ইসলামবিদ্বেষের বিস্তার নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। ভারতে গরুর মাংস খাওয়া বা অন্যান্য তুচ্ছ কারণে মুসলিমদের হত্যার বিষয়টির নিন্দা জানিয়েছে আফগানরা।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দিল্লীদের মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতার পর আফগানিস্তানের কাবুল, হেরাত এবং বামিয়ানে ভারতীয় মুসলিমদের পক্ষে বিক্ষোভ করেছে আফগানরা। ভারতের পতাকাও পুড়িয়েছে বিক্ষোভকারীরা। বামিয়ানে এমনকি নরেন্দ্র মোদির ছবিও পোড়ানো হয়।
ভারতীয় মুসলিমরা ভারতের নাগরিক হলেও অধিকাংশ আফগান আর তাদের ধর্ম অভিন্ন। ভারতীয় মুসলিমদের ব্যাপারে উদ্বেগ জানানোকে ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ মনে করে না আফগানরা। দুই দেশের মুসলিমদের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্কটা এতটাই জোরালো যে, সেটাকে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই।
তাছাড়া সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট করে ভারত নিজেও আফগানিস্তানের হিন্দু ও শিখদের ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়েছে। আফগান হিন্দু আর শিখদের ব্যাপারে ভারতের আগ্রহ নিয়ে কোন আফগান এ পর্যন্ত আপত্তি জানায়নি।
আফগানরা বলিউডের চলচ্চিত্র পছন্দ করে। কিন্তু বলিউড যদি ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা করে, মুসলিমদের উপর হিন্দুদের শ্রেষ্ঠত্ব দেখানোর চেষ্টা করে, তাহলে সেটা ভারত-আফগান সম্পর্ককে জটিল করে তুলবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় পদ্মাবৎ, কেসারি ও পানিপথের মতো ছবিগুলোতে মুসলিমদের বর্বর হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, যেগুলো আফগানদের ক্ষুব্ধ করেছে।
পানিপথ ছবিতে আধুনিক আফগানিস্তানের জনক আহমেদ শাহ দুররানিকে টাক মাথার শয়তানি চরিত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে, যেটা আফগানিস্তানের সব শ্রেণীর মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে। আফগান সরকার পর্যন্ত এমনকি ভারত সরকারকে এই ছবির ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে।
ছবিতে ১৭৬১ সালের পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধকে মুসলিম আর হিন্দুদের মধ্যকার যুদ্ধ হিসেবে দেখানো হয়েছে, যেটা সত্য নয়। প্রথমত, মারাঠা ক্যাম্পে দশ হাজার মুসলিমের বাহিনী ছিল, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন পশতুন মুসলিম জেনারেল ইব্রাহিম খান গার্দি। দ্বিতীয়ত, জয়পুর আর মারওয়ার রাজপুত হিন্দু শাসকরা মারাঠাদের বিরুদ্ধে আহমেদ শাহ দুররানির সাহায্য চেয়েছিলেন, কারণ মারাঠারা রাজপুতদের সীমানার কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। বলিউডকে কাউকে যদি কুচক্রি বলতে হয়, তাহলে রাজপুতদেরকেই বলতে হবে।
আফগানিস্তানে গত ৪০ বছরের সঙ্ঘাতকালে আফগান সমাজের একটা অংশ ধর্মীয় চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এই অংশটি ভারতের এমনকি ছোটখাটো ঘটনাকেও ইন্দো-আফগান সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর বানিয়ে তুলতে পারে। আফগানিস্তানের সাধারণ প্রত্যাশা হলো ভারত যাতে দুই দেশের সম্পর্ক নষ্টের সুযোগটা এই চরমপন্থীদের হাতে তুলে না দেয়।
পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতির অংশ হিসেবে আফগানিস্তানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় ভারত। ২০০১ সাল থেকে সেখানে বহু বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগও করেছে ভারত। আফগানদের সহায়তার পাশাপাশি এই অর্থ ভারতকেও প্রতিদান দিয়েছে। আফগানরা এখন অন্য যে কোন দেশের চেয়ে ভারতকে বেশি পছন্দ করে। এই ইতিবাচক মনোভাবের কারণে কোভিড-১৯ এর আগেও প্রতি মাসে হাজার হাজার আফগান চিকিৎসার জন্য ও পর্যটক হিসেবে ভারত আসতো।
আন্তরিক ইন্দো-আফগান সম্পর্ক দু্দেশের জন্যই ইতিবাচক। ভারতের অর্থনৈতিক সহযোগিতা আফগানিস্তানের প্রয়োজন। আর উদীয়মান শক্তি হিসেবে নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য আফগানিস্তানের অবস্থানগত সহযোগিতা ভারতের দরকার। লৌহ আকড় ও লিথিয়ামের যে চাহিদা রয়েছে ভারতের, আফগানিস্তানের বিপুল অনাবিষ্কৃত খনিজ সম্পদ সেটার চাহিদাও মেটাতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু, ইসলামবিদ্বেষ আর বলিউডে মুসলিমদের নেতিবাচকভাবে তুলে ধরা হলে আফগানিস্তানে ভারতের সুনামও নষ্ট হবে, আর ভারত-আফগানিস্তান সম্পর্কেরও অবনতি হবে।
সূত্র : আফগানিস্তান টাইমস/এসএএম