মাওলানা ভাসানী ও চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক
মাওলানা ভাসানী ও চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক - ছবি সংগৃহীত
ভদ্রলোককে চিনতাম না। কোনোকালে তার নামও শুনিনি এবং সামনাসামনি দেখিওনি। তার সাথে আমার মাত্র একবার ফোনে কথা হয়েছে- তাও প্রায় ঘণ্টা দুয়েক ধরে। তার কণ্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারলাম যে, তিনি যথেষ্ট বয়স্ক এবং লেখাপড়া জানা আধুনিক মানুষ। পরিচয়ের প্রথমেই তিনি জানালেন, আমার ব্যাপারে তার প্রবল আগ্রহ রয়েছে। সুদূর কানাডাতে বসে তিনি নিয়মিত আমার লেখা পড়েন, টকশো দেখেন এবং সাম্প্রতিককালে আমি যে ইউটিউব চ্যানেল করেছি সেখানে আপলোড করা ভিডিওগুলোও তিনি নিয়মিত দেখেন। ভদ্রলোক যেভাবে আমার ব্যাপারে তার আগ্রহের কথা বললেন তাতে আমার খুশি হওয়ার কথা ছিল। অন্য দিকে, আমার মতো যারা ‘হাভাতে লেখক কাম দুর্ভিক্ষকবলিত বুদ্ধিজীবী’ তারা যদি কদাচিত কারো প্রশংসা পান তবে হঠাৎ করে খুশির জোয়ারে ভাসতে শুরু করেন এবং গর্বের বাতাসে ব্যাঙের মতো নিজের পেট ফুলিয়ে ‘মহামানব’ সাজার ভান করেন।
ভদ্রলোকের প্রাথমিক কথা শোনার পর আমিও পেট ফোলানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু তার একটি প্রশ্নে প্রথমে একটু ধাক্কা খেলাম এবং নিজের নির্বুদ্ধিতা ও জ্ঞানের স্বল্পতা বুঝতে পেরে একেবারে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলাম। আমার কাছে মনে হলো- ভদ্রলোকের সাথে কথা না বলে নীরবে তার কথাগুলো শুনলে উপকার হবে। তার যে প্রশ্ন শুনে ধাক্কা খেলাম সেটা হলো আওয়ামী লীগের ‘আওয়াম’ শব্দের অর্থ কী! আমি যখন বললাম- এটার অর্থ ‘জনগণ’. তখন তিনি কিছুটা ভর্ৎসনার স্বরে বললেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা যদি মওলানা ভাসানী, আওয়াম শব্দের অর্থ ও ইতিহাস এবং ১৯২০ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক ঘটনাসমূহের বিচার বিশ্লেষণ করতে না জানেন তবে তারা কারো দালাল অথবা তাঁবেদার হয়ে ক্ষণেকের তরে কিছু মধু মেওয়া হাসিল করতে পারবেন বটে- কিন্তু রাজনীতিবিদ হতে পারবেন না।
ভদ্রলোকের কথা শুনে আমি রীতিমতো খামোশ হয়ে গেলাম। তার আলোচনায় জানতে পারলাম যে, তিনি বাংলাদেশে থাকাকালে অধ্যাপনা করতেন এবং পুরো ষাটের দশক তো বটেই, মাওলানা ভাসানীর মৃত্যু অবধি তার সাথে ছায়ার মতো ছিলেন। গত ৩০ বছর ধরে তিনি কানাডাতে রয়েছেন এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির ওপর একাধিক গবেষণা করেছেন। বাংলাদেশের তুলনামূলক রাজনীতি এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতির ভূতভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি যেসব কথাবার্তা বললেন তা শুনে আমি রীতিমতো তাজ্জব বনে গেলাম। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে চীনাদের যে ইদানীংকালের আগ্রহ তা চীনা বিপ্লবের পরপরই শুরু হয়েছিল। মাও সেতুং, চৌ এন লাই প্রমুখের মতো কিংবদন্তি চৈনিক নেতারা প্রথম থেকেই বাংলাদেশের ব্যাপারে অতিমাত্রায় আগ্রহী ছিলেন। তারা যেভাবে মাওলানা ভাসানীর সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন অমনটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য কোনো দেশের রাজপথের রাজনৈতিক নেতার সাথে করেননি।
চীনের সাথে পাকিস্তানের ঐতিহাসিক সম্পর্ক ছিল এ রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর থেকেই। কিন্তু তার পরও চীন চাইত, পূর্ব বাংলা স্বাধীন হোক। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে চীন পাকিস্তানের জন্য দ্বৈত পররাষ্ট্র নীতি চালু করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য চীন একদিকে যেমন সর্বময় ঝুঁকি নেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল, ঠিক তেমনি পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ববাংলা স্বাধীনতা লাভ করুক তার জন্য একটি মাস্টারপ্লান তৈরির পর পূর্ব বাংলায় মাওবাদী আন্দোলনে মদদ দিতে আরম্ভ করে। চীন আশঙ্কা করেছিল যে, পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত পূর্ব বাংলা ধরে রাখতে পারবে না এবং সে ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলায় যদি স্বাধীনতার আন্দোলন সুতীব্র না হয়, তাহলে পূর্ব বাংলাকে ভারত অনায়াসে দখল করে নেবে। এজন্য তারা ১৯৫৭ সালেই মওলানা ভাসানীকে দিয়ে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার ব্যাপারে ঘোষণা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। আমরা প্রায় সবাই কমবেশি জানি, ভাসানীর এক সময়ের রাজনৈতিক সহকর্মী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তদানীন্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং সিআইএ’র মদদে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ‘পূর্ববঙ্গের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে’ ভারত-আমেরিকার দোসররূপে সোহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রী হওয়া আওয়ামী লীগের বিরাট অংশ যেরূপ মানতে পারেনি তদ্রূপ মওলানা ভাসানীর মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও তা মেনে নেননি।
উপরোক্ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সোহরাওয়ার্দী এবং তার দোসরদের দেশবিরোধী চক্রান্তের প্রতিবাদ জানানোর জন্য ১৯৫৭ সালের ৮ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টাঙ্গাইলের কাগমারিতে এক সম্মেলন আহ্বান করা হয়। মওলানা ভাসানী ঐতিহাসিক কাগমারি সম্মেলনে বলেন, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের দ্বারা শাসিত হতে থাকলে পূর্ববঙ্গবাসী তাদের ‘সালামু ওয়ালায়কুম’ জানাতে বাধ্য হবে। ভাসানীর এই বক্তব্যকেই আমাদের মহান স্বাধীনতার মূলমন্ত্র বা বীজ বলে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি কাগমারি সম্মেলনে আমেরিকার সাথে কৃত সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী এবং তার দোসররা সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করলে ভাসানী ১৯৫৭ সালের ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন।
নিজের হাতে গড়া আওয়ামী লীগকে ভাসানী পরিস্থিতির চাপে ভারতপন্থী এবং মার্কিনপন্থী নেতাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে আলাদা রাজনৈতিক দল গড়তে বাধ্য হন। তিনি লক্ষ করলেন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পরও পূর্ববঙ্গে সেই সরকারকে টিকিয়ে রাখা যায়নি কিছু নেতার দুর্নীতি, অপরিপক্বতা এবং সিনিয়র নেতাদের অর্ন্তদ্বন্দ্বের পাশাপাশি ‘সোহরাওয়ার্দীর উচ্চাভিলাষের কারণে’। পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্টের সরকারের পতন ঘটানো হলে সোহরাওয়ার্দীকে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য বি গ্রেড-সি গ্রেড নেতাকে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী বানানো হবে এমন লোভ দেখিয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকারের বারোটা বাজানো হয়। এখানে পূর্ববঙ্গের সর্বনাশ ঘটানোর জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক কর্তারা যেমন যুক্তফ্রন্টের একাংশকে মদদ দেন, তেমনি এই গ্রুপটি ভারত ও আমেরিকার মদদ লাভ করে পূর্ববঙ্গে চীনের প্রভাবকে কবর দিয়ে ভারতের জন্য একটি বলয় তৈরি করার মানসে উপরোক্ত অবস্থার প্রেক্ষাপটে সোহরাওয়ার্দী কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলেন বটে কিন্তু ভারত-মার্কিন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থের সমন্বয় করতে না পেরে কেবল ক্ষমতাই হারালেন না; বরং সব পক্ষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে রাজনীতিতে ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হতে শুরু করলেন। সোহরাওয়ার্দীর ব্যর্থতার কারণে পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ববাংলা একই সাথে উত্তাল ও টালমাটাল হয়ে পড়ে। ফলে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে চীন সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খানকে দিয়ে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেয়। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন।
আইয়ুব খান ‘চীনপন্থী’ হওয়া সত্ত্বেও মওলানা ভাসানীকে তার ক্ষমতার জন্য পূর্ববঙ্গে এক নম্বর শত্রু মনে করতেন এবং তিনি জানতেন যে, পূর্ববঙ্গের স্বার্থের প্রশ্নে ভাসানী কারো সাথেই আপস করবেন না। অধিকন্তু ১৯৫৭-৫৮ সালে সারা পূর্ববঙ্গে যে জনপ্রিয়তা এবং রাজনীতির ময়দানে প্রভাব প্রতিপত্তি ভাসানীর ছিল তার একাংশও অন্য কোনো নেতার ছিল না। শেরেবাংলা ফজলুল হকও জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু তার বার্ধক্য, যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন এবং পশ্চিম পাকিস্তান ভীতি ও ক্ষমতার লোভের কারণে শেষ বয়সে তিনি রীতিমতো ‘অথর্ব’ হয়ে পড়েছিলেন। ফলে বাংলার রাজনীতির ময়দানের সিংহ শার্দূল মওলানা ভাসানীই ছিলেন সামরিকজান্তার প্রধান টার্গেট। ফলে সামরিক শাসন জারির পাঁচ দিনের মাথায় অর্থাৎ ১৯৫৭ সালের ১২ অক্টোবর মওলানা ভাসানীকে মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করা হয় এবং দীর্ঘ চার বছর ১০ মাস কারাভোগের পর তিনি মুক্তি লাভ করেন।
ভাসানীকে মুক্তি দেয়ার জন্য পূর্ববাংলায় গণআন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। অন্য দিকে, চীনও আইয়ুব খানকে চাপ দিতে থাকে। ফলে ভাসানী মুক্তি লাভ করেন। অন্য একটি কারণেও আইয়ুব শাহী ভাসানীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। কারণ তিনি জেলে থেকে নিরাপদে যেমন রাজপথের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তেমনি জেলের অভ্যন্তরে অনশন ধর্মঘট করে সরকারকে বিব্রত করছিলেন। বিশেষ করে ১৯৬২ সালের ২৬ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি অনশন করেন বন্যাদুর্গতদের সাহায্য এবং পাটের ন্যায্যমূল্যসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ের জন্য। এ অবস্থায় সরকার তাকে নভেম্বর মাসের তিন তারিখে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। জেল থেকে বের হয়ে তিনি দেখলেন যে, সারা দেশে ভারতীয় এজেন্টরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এবং একের পর এক পূর্ববাংলা বিরোধী তৎপরতা চালিয়ে এই অঞ্চলকে ভারতীয় রাজ্য বানাবার নীলনকশার বাস্তবায়নে অনেকটা এগিয়ে গেছে। এই অবস্থায় চীনের পরামর্শে তিনি ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং সেপ্টেম্বর মাসে চীন ভ্রমণে গিয়ে প্রায় সাত সপ্তাহ কাটিয়ে দেশে ফেরেন।
মওলানা ভাসানী ১৯৬৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপকে পুনরুজ্জীবিত করেন এবং রাজপথের অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে একত্র করে ‘সম্মিলিত বিরোধী দল’ গঠন করেন, যাকে সংক্ষেপে ‘কপ’ বলা হতো। তিনি ১৯৬৪ সালে বুঝতে পেরেছিলেন যে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। কাজেই পূর্ববঙ্গে যদি প্রবল জাতীয়তাবোধের সংগ্রাম তীব্র করা না যায় তবে সম্ভাব্য যুদ্ধে পূর্ববঙ্গে ভারতীয় আধিপত্য ঠেকানো যাবে না। মওলানা ভাসানীর এই দূরদর্শিতার কারণে ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ সাল অবধি পূর্ববঙ্গের স্বাধিকার আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের দাবি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ নির্যাতন এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে পুরো দেশ এতটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে, ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ববঙ্গ অরক্ষিত থাকা সত্ত্বেও ভারত পূর্ববঙ্গে তৎপরতা চালাতে সাহস পায়নি।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, আইয়ুবের পতন এবং ইয়াহিয়া-ভুট্টোর উত্থানে পাকিস্তানের রাজনীতিতে কিছু দিনের জন্য চীনা কর্তৃত্ব হ্রাস পায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ধারণা করেন যে, মূলত আমেরিকা ও ভারতের কূটনৈতিক চালে আইয়ুব খানের পতন ঘটে এবং ভুট্টো গংদের আর্বিভাব হয়। পাকিস্তানের নয়া শাসকেরা পূর্ববঙ্গের ব্যাপারে এমন উদাসীনতা দেখান এবং ইঙ্গ-মার্কিন চক্রান্তের রূপরেখা অনুযায়ী এমন সব কুকর্ম আরম্ভ করেন যার ফলে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
মওলানা ভাসানী তার সুদীর্ঘকালের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার দরুন বুঝতে পারছিলেন, ১৯৭০ সাল থেকে পূর্ববঙ্গ নিয়তির খপ্পরে পড়ে গেছে যেখানে পরিস্থিতির শিকার হওয়া ছাড়া তার মতো রাজনীতিবিদের তখন কিছুই করার ছিল না। তবুও তিনি ১৯৭০ সালের প্রবল বন্যা সমস্যা সমাধানের দাবিতে অনশন শুরু করেন। ১২ নভেম্বর ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে বাংলাদেশের পুরো দক্ষিণ অঞ্চল তছনছ হয়ে পড়ে। এই অমানবিক অবস্থায় সাধারণ নির্বাচন সম্ভব নয়- এই কথা বলে তিনি নির্বাচনকে ‘আঁতাতের নির্বাচন’ আখ্যা দিয়ে তা বয়কট করেন। এরপর ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের বিরাট সমাবেশে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের দাবি পেশ করেন।
২৫ মার্চ ১৯৭১ সালের কালো রাতে মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইলের সন্তোষে তার নিজ গৃহে অবস্থান করছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, পাকিস্তান-ভারত-আমেরিকা এবং তাদের দোসররা তাকে ছাড়বে না। তাই তিনি সবার দৃষ্টি এড়িয়ে সন্ধ্যা রাতে সন্তোষ ত্যাগ করে সিরাজগঞ্জে চলে যান। হানাদাররা সন্তোষে গিয়ে তাকে না পেয়ে তার বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। হানাদাররা হন্যে হয়ে তাকে খুঁজতে থাকে। এ অবস্থায় তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং তার ব্যক্তিগত অনুরাগী, আসামের মইনুল হক চৌধুরীর হস্তক্ষেপে আসামের ফুলবাড়িতে আশ্রয় পান। সেখান থেকে ভারতীয় গোয়েন্দারা মওলানা ভাসানীকে কলকাতা নিয়ে যান এবং পার্ক রোডের কোহিনুর প্যালেসের পঞ্চম তলায় নজরবন্দী করে রাখেন। তিনি বাংলাদেশে ফেরেন ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি এবং একই বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক হক কথা নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি ঘোষণা দেন- ‘আসাম আমার, পশ্চিমবঙ্গ আমার, ত্রিপুরাও আমার। এগুলো ভারতের কবল থেকে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মানচিত্র পূর্ণতা পাবে না।’
মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপরোক্ত কথাগুলো প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে আরো সবিস্তারে শুনছিলাম আমার সেই প্রবাসী মুরুব্বির কাছ থেকে। আমি অধীর আগ্রহে বাকি ইতিহাস শোনার জন্য কান খাড়া করে রেখেছিলাম। কিন্তু কী কারণে যেন টেলিফোনের লাইনটি কেটে গেল। অনেক চেষ্টা করেও পুনঃসংযোগ পেলাম না। ফলে সেদিনের আলোচনা অসমাপ্তই রয়ে গেল।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য