চীন-ভারত-পাকিস্তান : ৩ পরমাণু শক্তি লড়াই
চীন-ভারত-পাকিস্তান : ৩ পরমাণু শক্তি লড়াই - ছবি সংগৃহীত
দ্বিতীয় মেয়াদে মোদির লোকসভা নির্বাচনের সময় পাকিস্তানবিরোধী গরম গরম বক্তব্য নির্বাচনী জলসা ও র্যালিতে প্রাধান্য লাভ করে। পাকিস্তান বিরোধিতা, ভারতে মুসলমানদের নাগরিকত্ব বাতিল, গো পূজা, গোমূত্র পান, রাম-মন্দির ইস্যু, ‘নয়া ভারত’ কর্মসূচি, ঘর ওয়াপসি আন্দোলন, রুটি-কাপড়া-মকান প্রকল্প, কৃষি প্রকল্প, হিন্দু ভারত প্রকল্প, আত্মনির্ভর ভারত প্রভৃতি হিন্দুদের মনে দারুণ উচ্ছ্বাস ও হিল্লোলের সৃষ্টি করেছে। মোদি উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী মনোভাবে জোয়ারের সৃষ্টি করতে পেরেছেন। এমন একটি উত্তপ্ত সময়ে চীনাদের হাতে লাদাখে চরম মার খাওয়ায় জাতীয়তাবাদী মনোভাবে পুষ্ট হিন্দুরাই মোদির সমালোচনা করতে থাকে। এরই মধ্যে কোভিড-১৯-এর আক্রমণে সে দেশের অর্থনীতি গত ৪০ বছরে সবচেয়ে নিচে নেমে আসে। অথচ এই অবস্থায় চীন ও পাকিস্তানকে মোকাবেলা করার জন্য ভারতকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনতে ও অস্ত্র উৎপাদন করতে হচ্ছে। ইকোনমিক টাইমস জানায়, রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সার্গেই সুইগু এবং ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের মধ্যে ৪ সেপ্টেম্বর, যে বৈঠক হয় সেখানে উত্তর প্রদেশের আমেথিতে রাশিয়ার একে-২০৩ অ্যাসল্ট রাইফেল তৈরির ফ্যাক্টরিরা জরুরি উৎপাদন শুরু করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। ভারতের অনুরোধে রাশিয়া পাকিস্তানকে ‘কোনো অস্ত্র সরবরাহ করবে না’ বলে জানিয়েছে। রাাশিয়া-চীন গোপন ও অপ্রকাশিত চুক্তির কারণে ভারতকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করার আবেদনও রাশিয়া রাখবে বলে মনে হয় না।
এখন বলা হচ্ছে, লাদাখের ঘটনা হিন্দু জাতীয়তাবাদী মনোভাবের ফসল। ১৯৬২ সালে চীনাদের হাতে পরাজয়ের গ্লানি ভারতীয়রা এখনো ভোলেনি। লাদাখের ঘটনা আলোচনায় নিষ্পন্ন না হয়ে দিন দিন তুষের আগুনের মতো জ্বল জ্বল করছে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বলে দেয়, এখানেই একটি রণাঙ্গন তৈরি হয়ে গেছে। চীন ও ভারত এ সুযোগে ঢিল পাটকেল মারছে। উভয় পক্ষ অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র, মাউনটেইন ডিভিশন ও কমান্ডোদের জড়ো করেছে লাদাখে। এর মধ্যে দ্বিতীয় দফা ভারত-চীন নতুন করে ২৯ আগস্ট ২০২০ তারিখে সংঘর্ষ হয়। তাতে ভারতের একজন তিব্বতি এসএফএফ সেনা নিহত এবং চীনের ৩০ জন সেনা আহত হয় বলে সংবাদ মাধ্যমে জানা যায়। ভুটানের দোকলামের ঘটনাও ভারতের ভোলার কথা নয়। ভারত দুশ্চিন্তায় পড়ে যখন ২০১৭ সালে চীনারা একটি রাস্তা দোকলাম পর্যন্ত বাড়াতে চায়। ওখানে তিব্বত, ভুটান ও ভারতের ভূখণ্ড মিশেছে। প্রয়োজনে চীনারা ভারতের কাছাকাছি ‘চিকেন নেকে’ সেনা নিয়ে আসতে পারবে, সেজন্য ভারত চায় না দোকলামে চীনা আধিপত্য কায়েম হোক।
নয়া দিল্লিতে কর্মরত প্রখ্যাত পাকিস্তানি ফ্রি ল্যান্সার সাংবাদিক ইরফান হোসেইন কাাশ্মির ও চীন-ভারত ১৯৬২ সালের যুদ্ধ নিয়ে একটি মজার তথ্য প্রকাশ করেছিলেন। যুদ্ধের চরম সময়ে ভারত কাশ্মির থেকে মাউন্টেন রেজিমেন্টের প্রায় সব সেনা প্রত্যাহার করে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেয়। ইসলামাবাদে চীনা রাষ্ট্রদূত প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাৎ করে জানতে চান, পাকিস্তান কেন এই সুযোগ গ্রহণ করে কাশ্মির দখল করল না? আইয়ুব খান এই তথ্যটি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের দূতাবাসে তাৎক্ষণিকভাবে পাঠিয়ে দিয়ে ওয়াশিংটন ও লন্ডন থেকে জরুরি মতামত জানতে চান। পরদিনই মতামত পাওয়া যায়, উভয়ে আইয়ুব খানকে অনুরোধ জানায় সেটি না করার জন্য তারা অঙ্গীকার করে যে, লড়াই শেষ হলে তারা জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে চাপ দেবেন জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাব মতে কাশ্মিরে ভোটের ব্যবস্থা করার জন্য। আইয়ুব খান ও তার সহকর্মীরা মনে করলেন, একটি যুদ্ধে জড়ানোর চেয়ে জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ সমাধান উত্তম। কিন্তু তা আর হয়নি। এখন প্রতিশ্রুতির পর ৬০ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে। কাশ্মির নিয়ে জাতিসঙ্ঘের কোনো চিন্তাভাবনা আছে কি না সেটি গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরমাণু যুগে ছোটখাটো বোমা হামলাও বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। দুঃখজনক সত্যি হলো, কাশ্মিরের সাথে যে তিনটি দেশ সবচেয়ে বেশি জড়িত সে তিনটি দেশই পরমাণু বোমার অধিকারী। তাদের যেকোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত বড় বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে। তখন, উপমহাদেশে দারিদ্র্যবিমোচন ও উন্নয়নের যে প্রচেষ্টা চলছে সেগুলো আরো তিমিরে চলে যাবে। নস্যাৎ হয়ে যাবে মানুষের সুখস্বপ্ন। ভারত-চীন সীমান্ত বিরোধে পাকিস্তান কোনো পক্ষ না হয়ে বিরোধ মীমাংসায় অংশ নিলে উপমহাদেশের পরিস্থিতি ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করত বলে ধারণা। কিন্তু ভারতের এনআরসি, এএসি প্রকল্প, কাশ্মির ও আসামে মুসলিম নির্যাতন ও মুসলিমবিরোধী অ্যাজেন্ডার কারণে পাকিস্তান কাছে ঘেঁষছে না। এর মধ্যে পাকিস্তান নতুন ম্যাপ প্রকাশ করে বিরোধে যেন ‘ঘি ঢেলে দিয়েছে’। পাকিস্তান ও চীন পানিকে ভারতের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। আসমা খান লোন তার সাম্প্রতিক ‘দি গ্রেট গিলগিট গেম’ বইতে লাদাখে ছোট ছোট বাঁধ নির্মাণ করে ‘কৌশলগত বন্যা’ সৃষ্টির কথা উল্লেখ করেছেন।