গাজায় সাংবাদিক হামিদ মিরের অভিজ্ঞতা

হামিদ মীর | Sep 10, 2020 05:20 pm
হামিদ মির

হামিদ মির - ছবি সংগৃহীত

 

এটা ২০০৯ সালের জানুয়ারির এক সকাল বেলার কথা। গাজার আলকুদস হোটেলের অভ্যর্থনা কক্ষে উপস্থিত বর্ষীয়ান ব্যক্তিকে বললাম, আমার ডলারের বিনিময়ে স্থানীয় মুদ্রা দরকার যাতে ট্যাক্সির ব্যবস্থা করতে পারি। এ বর্ষীয়ান ব্যক্তি আমার মতো সারা রাত জেগে আছেন। সারা রাত ইসরাইলের বিমান আলকুদস হোটেলের আশপাশে বোমাবর্ষণ করেছে। হোটেলে পেছনের অংশে যখন একটি বোমা পড়ল, তখন আমিও রুম ছেড়ে বাইরে চলে আসি। ওই সময় এ ব্যক্তি আমাকে নিয়ে একটি পরিখায় ঢুকে পড়লেন। ওই পরিখায় আগে থেকেই কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিক আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমরা সবাই গাজায় ইসরাইলি হামলায় তীব্রতা আসার পর মিসরের পথ ধরে গাজায় পৌঁছেছি। সারা রাত পরিখায় কাটিয়ে আমরা নিজ নিজ কাজে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমাকে খান ইউনুস যেতে হবে, যেখানে ইসরাইল একটি মসজিদে বোমাবর্ষণ করেছিল। খান ইউনুসের জন্য প্রয়োজন ছিল ট্যাক্সি। অভ্যর্থনা কক্ষে উপস্থিত ব্যক্তি ফিসফিস করে ভাঙা ভাঙা উর্দুতে বললেন, ‘হোটেল থেকে ডলার ভাঙ্গানোর পরিবর্তে ব্যাংকে চলে যান। ভালো রেট পাবেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি উর্দু কোথায় শিখলেন?

তিনি বললেন, বহু বছর আগে দুবাইয়ের একটি হোটেলে কাজ করতাম। সেখানে পাকিস্তানিদের সাথে সম্পর্ক ছিল।’ এ কারণে তিনি উর্দু শিখেছেন। কিন্তু পরে তাকে দুবাই থেকে বের করে দেয়া হয়। যাই হোক তিনি আমাকে ফিলিস্তিন ব্যাংকের রাস্তা বুঝিয়ে দিলেন। ফিলিস্তিন ব্যাংকের কাউন্টারে এক শ' ডলারের নোট রাখলাম। ভেতর থেকে আমার পাসপোর্ট চাওয়া হলো। আমি পাসপোর্ট দেখালাম। এরপর কাউন্টারের পেছন থেকে আমার হাতে যে নোট ধরিয়ে দেয়া হলো, তা ছিল ইসরাইলের শেকেল। থ হয়ে গেলাম। ফিলিস্তিন ব্যাংকের কাছে ফিলিস্তিনি মুদ্রা নেই। বরং তাদের কাছে রয়েছে ইসরাইলি মুদ্রা। আমি প্রথমবার অনুভব করলাম, গোলামি কাকে বলে এবং স্বাধীনতা কত বড় নেয়ামত। কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় ফিরে এলে অভ্যর্থনা কক্ষে উপস্থিত বর্ষীয়ান ব্যক্তি মুচকি হেসে বললেন, প্রিয়, আমি দুঃখিত। আমি জানতে চাইলাম, কী হয়েছে? তিনি বললেন, আপনি আমাদের মেহমান। কাল রাতে আপনি হোটেলের কক্ষের পরিবর্তে পরিখায় ছিলেন।
আমি বললাম, কোনো ব্যাপার নয়। এ কথা বলে আমি সামনে বাড়তেই, তিনি পেছন থেকে আবার বলে উঠলেন, প্রিয়, আমি দুঃখিত। জানতে চাইলাম, এখন আবার কী হলো? তিনি বললেন, ‘হতে পারে আপনাকে আজ রাতও পরিখায় কাটাতে হবে। এজন্য সাতটা বাজার আগেই খাবার খেয়ে নিবেন।’ ওই রাতও পরিখায় কাটাতে হয়েছে।

যখন থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ঘোষণা করেছে, তখন থেকে পাকিস্তানিদের বলা হচ্ছে, আবেগ পরিত্যাগ করো এবং বাস্তববাদিতার সাথে জীবন অতিবাহিত করা শেখো। আবেগকে ভর্ৎসনা করার পেছনে এ পরামর্শ লুকিয়ে থাকতে পারে, যদি মিসর, জর্দান ও আরব আমিরাত ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে পারে, তাহলে পাকিস্তানেরও স্বীকৃতি দেয়া উচিত। কেননা এতে পাকিস্তানের অনেক উপকার হবে। আমি যখন জিজ্ঞাসা করি, তুরস্ক তো ১৯৪৯ সালে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, তাহলে তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য পদ লাভ করেনি কেন? কোনো জবাব না থাকায়, নিজেরা নিজেদের বাস্তববাদী অভিহিতকারী বুদ্ধিজীবীরা বলেন, আপনি এতটা আবেগময় হচ্ছেন কেন?

ফিলিস্তিনিরা কাশ্মির বিষয়ে কখনো পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়নি, তাহলে আপনি ফিলিস্তিনিদের জন্য এতটা আবেগময় হচ্ছেন কেন? পাকিস্তান টেলিভিশনে ওয়াইস তাওহিদের অনুষ্ঠানে একজন সাবেক রাষ্ট্রদূত বারবার ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের বিরোধিতাকারীদের আবেগকে ভর্ৎসনা করছিলেন। আমি যখন জিজ্ঞাসা করলাম, আল্লামা ইকবাল ও কায়েদে আজমও কি আবেগের বশবর্তী ছিলেন? কেননা তারা উভয়েই ইসরাইলের কট্টর বিরোধী ছিলেন। তখন ওই রাষ্ট্রদূত চুপ হয়ে গেলেন। ইসরাইলের বিরোধিতার অর্থ, ইহুদিদের সাথে শত্রুতা নয়। বিশ্বে নোয়াম চমস্কিসহ বেশ কয়েকজন ইহুদি পণ্ডিত ইসরাইল রাষ্ট্রের সমালোচক। আমি ১৯৯৪ সালে সুইজারল্যান্ডের ডাভোস শহরে ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিমন পেরেজের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। কিন্তু ২০০৬ সালে লেবানন-ইসরাইল যুদ্ধ এবং ২০০৯ সালে গাজায় ইসরাইলের বোমাবর্ষণ কাছ থেকে দেখে এই ফলাফলে পৌঁছেছি যে, যদি ফিলিস্তিন সমস্যার ওপর জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবাবলিকে উপেক্ষা করা হয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে কখনো শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে না।

আর মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা না হলে সাধারণ মুসলমানদের সাথে পশ্চিমাদের সম্পর্ক ভালো থাকবে না। সংযুক্ত আরব আমিরাত ইরানের সাথে শত্রুতার কারণে ইসরাইলের সাথে ঐক্য স্থাপন করেছে। ইরানের সাথে পাকিস্তানের উদাহরণ দেয়ার মতো সম্পর্ক নেই। তবে এর উদ্দেশ্য এই নয় যে, আমরা কিছু আরব শাসককে খুশি করার জন্য আল্লামা ইকবাল ও কায়েদে আজমের দর্শনকে পরিত্যাগ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘ইয়েস ম্যান’ ‘জ্বি হুজুর’ হয়ে যাবো।

বেশি কথায় যাবো না। শুধু এতটুকু আরজ করতে চাই, ১৯৩৬ সালে যখন ফিলিস্তিনে গৃহযুদ্ধ শুরু হলো, তখন ব্রিটিশ সরকার একটি রয়েল কমিশন গঠন এবং ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করার প্রস্তাব উত্থাপন করে। রয়েল কমিশনের প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে আল্লামা ইকবাল ৩ জুলাই, ১৯৩৭ সালে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। ওই বিবৃতিতে ফিলিস্তিন ভাগকে প্রত্যাখ্যান করে আরবদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে, তারা তাদের শাসকদের ওপর যেন ভরসা না করে। কেননা এ শাসক-বাদশাহরা ফিলিস্তিন বিষয়ে কোনো সঠিক ফায়সালা করার যোগ্য নন। (শেখ আতাউল্লাহ কর্তৃক সংকলিত ‘মাকাতিবে ইকবাল’) ৭ অক্টোবর আল্লামা ইকবাল কায়েদে আজমের কাছে লেখা পত্রে জোর দেন, মুসলিম লীগের বৈঠকে ফিলিস্তিনের জন্য প্রস্তাব গৃহীত হোক। ওই পত্রে তিনি লিখেছেন, ‘এশিয়ার দরোজার ওপর একটি পশ্চিমা ছাউনি জোরপূর্বক স্থাপন করা ইসলাম ও ভারত উভয়ের জন্য বিপজ্জনক। আর আমি এ ব্যাপারে কারাগারে যেতে প্রস্তুত।’ কিছু দিন পর অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ

লাক্ষ্ণৌতে তাদের ২৫তম বার্ষিক সভায় ফিলিস্তিনিদের জন্য প্রস্তাব গ্রহণ করে। এমনই এক প্রস্তাব ২৩ মার্চ, ১৯৪০ লাহোরে গৃহীত হয়। ২৯ নভেম্বর, ১৯৪৭ জাতিসঙ্ঘ ফিলিস্তিন ভাগের প্রস্তাব গ্রহণ করলে কায়েদে আজম ৮ ডিসেম্বর, ১৯৪৭ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের কাছে পত্র প্রেরণ করেন। তিনি জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আপনি ফিলিস্তিন সম্পর্কে আপনার নীতির ওপর দ্বিতীয়বার নজর বুলাবেন। ইসরাইল যখন পাকিস্তানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের আবেদন করেছিল, কায়েদে আজম তখন এ আবেদন উপেক্ষা করেন। ১৯৫১ সালে ফিলিস্তিনের মুফতি আজম আমিন আল হুসাইনি পাকিস্তান আসেন এবং নিয়ন্ত্রণরেখায় (উরি সেক্টর) চৌধুরী গোলাম আব্বাসের সাথে দাঁড়িয়ে কাশ্মিরিদের সহায়তা করার ঘোষণা করেন। জাতিসঙ্ঘের যে প্রস্তাবকে কায়েদে আজম প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, আজ ইসরাইল ওই প্রস্তাবও বাস্তবায়ন করতে

প্রস্তুত নয়। আর ফিলিস্তিনিদের এমন এক রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়, যাদের কাছে নিজস্ব মুদ্রা আছে। যদি পাকিস্তান ফিলিস্তিন সমস্যার ওপর জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবাবলি উপেক্ষা করে, তাহলে কাশ্মিরের ওপর জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবের পরোয়া করবে কে? কমপক্ষে ফিলিস্তিনি ও কাশ্মিরিদের বলতে প্রস্তুত নই, ‘প্রিয়, আমি দুঃখিত।’

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ১৭ আগস্ট, ২০২০ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com

* লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট,

প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us