কেমন হতে পারে আগামী দিনের চীন-ভারত সম্পর্ক
মোদি ও শি - ছবি : সংগৃহীত
জওহেরলাল নেহরুর ভারতের স্বাধীনতা লগ্নে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট তার ঐতিহাসিক ট্রায়েস্ট উইথ ডেস্টিনি’ বক্তৃতাটি বিশ শতকের অন্যতম মহান বক্তৃতা হিসেবে পরিচিত। তিনি অবিস্মরণীয় এক কথা বলেছিলেন ওই বক্তৃতায় : মধ্যরাতের এই সময়ে বিশ্ব যখন ঘুমিয়ে আছে, ভারত তখন জীবন আর স্বাধীনতায় জাগছে।‘
গত শনিবার মধ্য রাতে, দেশবাসী যখন ঘুমিয়ে ছিল, ভারত তখন চুপিসারে করোনাভাইরাস শনাক্তের দিক থেকে বিশ্বে ব্রাজিলকে ছাড়িয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দেশে পরিণত হয়ে যায়। গার্ডিয়ানের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের যেকোনো স্থানের চেয়ে ১.৩ বিলিয়ন মানুষের দেশ ভারতে করোনা সংক্রমণের হার সর্বোচ্চ।
নিয়তির লিখন।মোদি সরকার এই ঘটনা উদযাপন করতে অস্বীকার করে। কাজটি ঠিকই হয়েছে। এর বদলে আরেকটি ঘটনা উদযাপনের দিকে নজর দিয়েছিল। সেটা হলো ভারতীয় সৈন্যরা পূর্ব লাদাখের পানগং সো লেকের দক্ষিণ তীরে শেনপাও পার্বত্য অঞ্চলে এক টিলা দখল করতে রওনা হয়েছিল।অ্যাড্রেনালিন প্রবাহিত হলো। কিন্তু সোমবার রাতে একটি পরাশক্তির স্মার্টনেসের কাছে কুপোকাত হলো ভারত।
কিন্তু ভাইরাস হাল ছাড়েনি। মনে হচ্ছে,ভাইরাসটি প্রবল সাফল্য লাভের জন্য মুখিয়ে আছে। সম্ভবত আর দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সে কোভিড-১৯ ট্রফি ছিনিয়ে নিয়ে লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবে।
তবে এই সাফল্যকে উদযাপনের কোনো ব্যবস্থা থাকলে নরেন্দ্র মোদি তা এড়িয়ে যাবেন। সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়, তার অধিনায়কত্বে এই প্রচণ্ড যুদ্ধে ভারত হেরে যাচ্ছে।
অবশ্য এ ধরনের ভয়াবহ পরাজয় এখনো ঘটেনি।আমরা এমন চিন্তা করতেও চাই না। কিন্তু তবুও ভাইরাসটি অপ্রতিহতভাবে উপমহাদেশজুড়ে প্রতিটি নগরী, শহরে প্রবেশ করছে। তারপর আছে অরক্ষিত গ্রামগুলো।
ভারতের টালমাটাল ইতিহাসে আর কখনো কোনো আমলে- মৌর্য, গুপ্ত, মারাঠা, সাতবাহন, মোগল ও এমনকি রাজকীয় ব্রিটিশ- এ ধরনের ভাইরাস এভাবে বিস্তৃত হওয়ার আশা করেনি কোনো ভাইরাস।
আবার যে আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছিল, তাও মরিচীকা হয়ে দেখা দিচ্ছে। কোনো ভ্যাকসিনই দৃশ্যপটে দেখা যাচ্ছে না।অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের প্রস্তুতকারীরা সম্প্রতি জানিয়ে দিয়েছে, তাদের টিকার কার্যকারিতার ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে লাগবে আরো ৫ বছর।
এর অর্থ হলো লাখ লাখ ভারতীয়ের জীবন সুতায় ঝুলছে। সাধারণভাবে বলা যায়, মহামারিটি আমাদের দৈনন্দিন জীবন, আমাদের সমাজ, আমাদের জাতির জন্য ‘নিউ নরম্যাল’ হয়ে পড়েছে। লাদাখের প্রত্যন্ত এলাকার অন্ধকারে কী ঘটছে, তা মানুষের জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ নয়। এই বিষয়টি আমরা যত দ্রুত বুঝতে পারব, ততই মঙ্গল।
ক্ষমতাসীন এলিটরা যাতে আমাদের বিভ্রান্ত করতে না পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। ভাইরাসটি হলো বাস্তবতা। প্রধানমন্ত্রী আমাদেরকে ভবিষ্যত সম্পর্কে প্রলুব্ধকর চিত্র দিচ্ছেন। হয়তো তিনি জানেনই না, ভবিষ্যত সামনে কী রেখেছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে কার্যকর ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে বলে যে প্রত্যাশা সৃষ্টি করা হচ্ছে, তা আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বিপজ্জনক বিভ্রান্তিতে পরিণত হয়ে যেতে পারে।
আমাদেরকে বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে,হলি বা বৈশাখী পর্যন্ত আগামী কয়েক মাস কোনোমতে কাটিয়ে দিতে পারলে তারপর টিকা এসে যাবে। এটি হবে সমাধান। আমরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারব, আমাদেরকে আরো কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবলেই চলবে।
অথচ যথার্থ পরিকল্পনাটি এভাবে হতে পারত যে আমরা একটি টিকা পাব, যেনতেন নয় বরং গেম-চেঞ্জিং টিকা, তবে তার জন্য অনেক দিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। যে টিকা সাত বছর পর্যন্ত সুরক্ষা দিয়ে থাকে ৭০ ভাগ কার্যকারিতাসহ, তাকেই বলা হয় গেম-চেঞ্জিং টিকা।
রাজনীতিবিদদের উচিত, সিলভার বুলেটের জন্য অপেক্ষা না করে সৃষ্টিশীল কোনো ব্যবস্থা গড়ে তোলা। মার্চে মাত্র কয়েক ঘণ্টার সময় দিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে কঠোর লকডাউন আরোপ করলেন, তা নজিরবিহীন ভোঁতা হাতিয়ার হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। সরকারি কার্যক্রমের ইতিহাসে এবং মানবজাতির ইতিহাসে এমন ভোঁতা হাতিয়ার সম্ভবত আর কোনো সময় ব্যবহৃত হয়নি। আর ক্ষতি হয়েছে সব মানুষের ও অর্থনীতির।
জিডিপি বা প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে শীতল পরিসংখ্যান কখনো আসল কাহিনী বলে না। সম্প্রতি বিখ্যাত অর্থনৈতিক ভাষ্যকার এম কে বেনু লিখেছেন যে ভারতীয় অর্থনীতির অনানুষ্ঠানিক খাতটি ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি এজন্য সরাসরি মোদির প্রশাসনকে দায়ী করেছেন।
আমি ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লব নিয়ে অনেক আগে লেখা একটি প্রতিবেদন পড়েছিলাম। ভ্লাদিমির লেনিন জার্মানিতে একটি বলশেভিক প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিলেন লিওঁ ট্রটস্কির নেতৃত্বে। তাদের মিশন ছিল, জার্মানি যাতে কোনোভাবেই রাশিয়া আক্রমণ না করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ওই চুক্তির নাম ছিল ব্রেস্ট লিটোভস্ক। সই হয়েছিল ১৯১৮ সালের মার্চে।
জার্মানরা যেসব শর্ত চাপিয়ে দিয়েছিল, তাতে পুরো পাশ্চাত্য বিশ্ব হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল। এতে বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর ওপর জার্মানির আধিপত্যের ব্যবস্থা ছিল, রাশিয়াকে সাউথ ককেশিয়া ছেড়ে দিতে হয়েছিল উসমানিয়াদের হাতে (তারা ছিল জার্মানির মিত্র), ইউক্রেনের স্বাধীনতাকেও রাশিয়াকে স্বীকৃতি দিতে হয়েছিল।
লেনিনকে ক্যাবল করে ট্রটস্কি চুক্তি সই অনুষ্ঠানে বর্জুয়া পোশাক পরার অনুমতি চেয়েছিলেন। কারণ এটি ছিল বিপ্লবের পর রাশিয়ার প্রথম চুক্তি। লেনিন জবাব দিয়েছিলেন, যদি প্রয়োজন পড়ে তবে বলশেভিক প্রতিনিধিদল পেটিকোটও পরতে পারে।
লেনিনের কাছে কী পরা হবে, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলশিকদের জন্য স্বস্তির সময় পাওয়া। কারণ রুশ গৃহযুদ্ধের (১৯১৭-১৯২২) কারণে দেশের অবস্থা তখন করুণ। আমেরিকাসহ ১৩টি হস্তক্ষেপকামী দেশকেও তাদের তখন ঠেকাতে হচ্ছিল।
মোদির উচিত হবে এই চুক্তিটি পাঠ করা। কোনো রাষ্ট্রনায়ক যখন জাতীয় অগ্রাধিকার বুঝতে অক্ষম হন, তখন দেশের অবস্থা শোচনীয় হতে বাধ্য। প্রত্যন্ত এলাকায় সামান্য এক টুকরা জায়গার দখল নিয়ে উদযাপনের চেয়ে অতিক্ষুদ্র ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কিন্তু সরকার তা বুঝতে পারছে না। সরকার উপলব্ধি করতে পারছে না যে এই মহামারির পর যে বিশ্ব সামনে দেখা যাবে, সেটি এখনকার মতো হবে না। বিশ্ব দেখবে পাশ্চাত্য খোঁড়াচ্ছে, আর চীন আরো সাহসী হয়ে ওঠেছে। বিশ্ব অর্থনীতির মূল প্রকৃতিই বদলে যাবে।
ধরে নেয়া যেতে পারে, মহামারির পর চীন তার শক্তি প্রদর্শন করবে। আগামী দিনে যে বিশ্ব দেখা যাবে, তাতে অপরিহার্য শক্তি হিসেবে সফল হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে চীন।
চীন এখন অনেক ফ্রন্টেই যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করতে আত্মবিশ্বাসী। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দেখছে যে তাদের শক্তির পার্থক্য কমে আসছে।
কোভিড-১৯ সব দেশের জন্যই সতর্কবার্তা। মোদি সরকার যদি জনগণের কল্যাণ কামনা করে, তবে তাদের উচিত হবে চীনের সাথে সহযোগিতা করা।
কিন্তু এর মানে এই নয় যে ভারতকে চীনা-নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যাবস্থাকে স্বীকার করে নেয়া। সহ-সভ্যতা হিসেবে চীন জানে যে ভারত কখনো অনুগত রাষ্ট্র হবে না। মূল কথা হলো, চীনও তার মডেলকে রফতানি করতে চায় না। সে চায় বৈচিত্র্যময় বহু মেরুর বিশ্ব দেখতে।
সূত্র : ইন্ডিয়া পাঞ্চলাইন