কেন হলো এমন?
ইউওনও ওয়াহিদা - ছবি সংগৃহীত
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটল বলেছেন, আপনি আপনার চেহারা ছোট আয়না দিয়েও দেখতে পারেন। আবার বড় আয়না দিয়েও দেখতে পারেন। এর মানে হচ্ছে, কোনো সমস্যাকে বুঝতে হলে ব্যক্তি বা তৃণমূল পর্যায়ে তাকানো যায়। আবার কেন্দ্রীয়ভাবেও অনুভব করা যায়। মুখ মনের আয়না। মুখ দেখে মনের কথা জানা যায়। ভালো-মন্দ সবটাই ফুটে ওঠে মুখে। অবশ্য মুখ ও মুখোশের কথা আছে। মুখোশ কিন্তু মুখ নয়। মুখে যদি ময়লা থাকে আয়না বলে দেয়। সংবাদপত্রকে বলা হয়, সমাজের আয়না। সংবাদপত্রের পরিসর পাল্টেছে। বলা হয়, ছাপার অক্ষর আর ছবির বর্ণনার কথা। অক্ষর আর ছবি মিলে নতুন নাম গণমাধ্যম। গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা সমাজদেহের রোগ-বালাইয়ের কথা জানতে পারি। সমস্যা ও অসুবিধা বুঝতে পারি। এই করোনা অভিশাপের মধ্যে আরো বেদনাবিধুর ঘটনা ঘটে। মর্মান্তিক মৃত্যুর মিছিল দেখেছি মসজিদে। কী কষ্টের কথা- জীবন নিরাপদ নয় মসজিদেও। ‘প্রতিদিন কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে’। কোনো কোনো খবর আনন্দ দেয়। আবার কোনো কোনো খবরে ভারাক্রান্ত হয় মন। সাম্প্রতিককালে ভালো খবর আর নেই। নিত্যদিন মৃত্যু আহাজারি আর বাড়াবাড়ি কত সওয়া যায়! ‘হৃদয় খুঁড়ে কে হায় বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’। ৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ এরূপ একটি ক্ষোভ ও বেদনার কথা ভেসে আসে সংবাদপত্রে।
রক্তে মাখা মশারি-বিছানা। মেঝেতে কালচে হয়ে ওঠা চাপ চাপ রক্ত। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা-ইউএনও ওয়াহিদা খানম নিজ ঘরে দুর্বৃত্তের আঘাতে মরণাপন্ন। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা প্রশাসন কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা ও কাজের পরিবেশ নিয়ে উত্থিত হয়েছে প্রশ্ন। স্থানীয় সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এটি কোনো ডাকাতির ঘটনা নয়। কারণ ঘরের কোনো মালামাল খোয়া যায়নি। তাকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যেই এ ঘটনা ঘটেছে বলে আমার ধারণা।’ ইউএনও ওয়াহিদার প্রশাসক হিসেবে সততা ও নিষ্ঠার সুনাম আছে। গত ১৬ আগস্ট করতোয়া নদীর ব্রিজসংলগ্ন এলাকায় অবৈধ বালুর ঘাটে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন তিনি।
এছাড়া করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সচেতনতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তিনি। সীমান্তবর্তী এলাকাটিতে মাদক ও চোরাচালান বন্ধে চেষ্টাও শুরু করেন। ধারণা করা হচ্ছে সংক্ষুব্ধ কোনো ব্যক্তি বা পক্ষের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন তিনি। দ্বন্দ্ব চলছে সর্বত্র। প্রতিনিয়ত। ডিসি বনাম এমপি। উপজেলা চেয়ারম্যান বনাম ইউএনও। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওসি বা ডিসির কোনো অস্তিত্ব নেই। বিরোধ হলে বাঁধবে লড়াই। সে লড়াইয়ে আমলা বা প্রশাসকের জিতবার কোনো সম্ভাবনা নেই। কূটজালে বিস্তৃত হয় সৎ-স্বকীয় ধারার বিরুদ্ধে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ষড়যন্ত্রে কুপোকাত হয় প্রতিবাদী প্রশাসক। উল্লেখ্য, মাঠপর্যায়ে ইউএনও পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উপজেলা পর্যায়ে সরকারের সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেন তারা। উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতিও ইউএনও। এমন দায়িত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে এ ধরনের জঘন্য হামলায় সঙ্গতভাবেই নির্বাহী মহল তথা প্রশাসনের পর্যায়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। এই হামলার কারণ অনুসন্ধান করে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে সঠিক বিচারের দাবি জানিয়েছে ওই অ্যাসোসিয়েশন। ঘটনা তদন্তে রংপুরের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সন্দেহভাজন তিন ব্যক্তিকে আটকের পর র্যাব একে চুরির ঘটনা বলে উল্লেখ করে। তবে এই ভাষ্য সম্পর্কে দ্বিমত ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।
তড়িঘড়ি করে সংবাদ সম্মেলন করায় সমালোচিত হয়েছে র্যাব। আটক তিন সন্দেহভাজনের একজন ঘোড়াঘাট উপজেলা যুবলীগের সদস্য। এছাড়া এই ঘটনায় আরো তিনজনকে ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এদের মধ্যে দু’জন হলেন ঘোড়াঘাট উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম, সিংড়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মাসুদ রানা। এ দু’জনকে ধরে এনে ছেড়ে দেয়ায়ও প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। যুবলীগ সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতারের পর তাদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে র্যাব বলেছে, ‘সেটা তো আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। আমরা কোনো আসামির রাজনৈতিক পরিচয়ে আগ্রহী নই। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।’ তবে পর্যবেক্ষক মহলের অভিযোগ, রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণেই তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।
দিনাজপুর জেলা পুলিশ বলছে, এখন পর্যন্ত তারা যে তথ্য পেয়েছে তাতে মনে হয় যুবলীগের আসাদুলই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী। আটক আসাদুলের বিরুদ্ধে কয়েকটি মাদক মামলা রয়েছে। আসাদুলের সাথে উপজেলা যুবলীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলমের ঘনিষ্ঠতার কথা জানায় স্থানীয় অধিবাসীরা। জেলা যুবলীগের সভাপতি রাশেদ পারভেজ জানিয়েছেন, ২০১৭ সালে জাহাঙ্গীর আলমকে বহিষ্কার করতে স্থানীয় এমপি শিবলী সাদিক সুপারিশ করেছিলেন। তিনি বলেন, জাহাঙ্গীর বেপরোয়া টাইপের। কিছু দিন আগে সে খোদ এমপির ওপর হামলা করে। যুবলীগের সভাপতি হওয়ার পর থেকেই সে মাদক ব্যবসা ও জমি দখল করতে সহায়তা করছে। থানায় চারটি কেস আছে। এর আগে স্থানীয় নেতাদের ওপর সে হামলা করে। পৌরমেয়র আবদুস সাত্তার বলেন, তার ওপর হামলার পরের দিন তিনি জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এছাড়া জমি দখল ও মাদক ব্যবসার সাথে জাহাঙ্গীরের জড়িত থাকার কথাও জানান এই পৌর চেয়ারম্যান।
শাসক দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদে হাজারো ঘটনা প্রকাশের পরে ঘোড়াঘাটে এ ঘটনায় শাসক দলের উল্লেখিত পাতি নেতাদের সম্পৃক্ততার সন্দেহ-অযৌক্তিক কিছু নয়। বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা প্রশাসনের সাথে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যে বেপরোয়া আচরণ করছে। তাদের ঔদ্ধত্য এতটাই চরমে পৌঁছেছে যে, ছোট আমলা বা বড় আমলা কারোই টুঁ শব্দটি করার জো নেই। সাবরিনা বা সাহেদরা এতটাই দাপুটে ছিল যে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আমলারা তাদের কাছে অসহায় বোধ করেছেন। জিকে শামীমদের কাছে অর্থে অথবা অনর্থে গণপূর্ত বিভাগ জিম্মি হয়ে পড়েছিল। ফরিদপুরের স্বনামধন্য দুই ভাইয়ের গল্প শুনে মনে হয়েছে তারাই রাজা তাদের রাজত্বে। এই সেদিন টঙ্গী পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তাকে কে বা কারা হত্যা করেছে। আজও তার কারণ উল্লেখিত হয়নি। সন্দেহের তীর ওদিকেই। অবশ্য এ বিষয়ে শাসক দলের কৃতিত্বের ইতিহাস মোটেই অনুজ্জ্বল নয়। মনে পড়ে ১৯৭২ সালের দিকে টাঙ্গাইলের ডিসি শাহ ফরিদ লাঞ্ছিত হয়েছিলেন বড় এক নেতার হাতে। দু’এক বছর আগে পাবনার ডিসি সোনার ছেলেদের হাতে পিটুনি খেয়েছিলেন।
ট্যাক্টফুল না হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টা ভর্ৎসনা করেছিলেন তাকে। বরগুনায় তাৎক্ষণিক বদলি করা হয়েছিল তাকে। টেকনাফের মাদক খ্যাত সংসদ সদস্য কয়েক দফায় হাত তুলেছিলেন ইউএনও, উপজেলা প্রকৌশলী ও ম্যাজিস্ট্রেটের গায়ে। পটুয়াখালীর দুর্নীতির জন্য খ্যাত এক বিগত এমপি চেয়ারম্যান নির্বাচনে পাইকারি সিল পেটাতে না দেয়ার ‘অপরাধে’ প্রকাশ্য জনসম্মুখে এক ম্যাজিস্ট্রেটকে চপেটাঘাত করেছিলেন। গত সপ্তাহে নোয়াখালীতে আরেক ‘বেয়াদব’ রাজস্ব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মিছিল করিয়েছেন এক এমপি। অভিযোগ স্থানীয় লোকজনের। দেখা যায়, অতি সামান্য রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থ হানি হলেই শাসককুলের নেতাকর্মীরা আমলা সে ছোট বা বড় বাছাই না করে চড়াও হচ্ছেন। উঁচু পর্যায়ের আমলারা অধিকাংশ সময় কিল খেয়ে কিল হজম করেন, মান সম্মানের ভয়ে। উচু মহলের চার দেয়াল টপকিয়ে এসব সংবাদ কদাচিৎ আসে ছোট বা বড় আয়নায়। কিন্তু জেলা, উপজেলার মতো খোলামেলা জগতে অল্পতেই আলোয় আসে সব। ক্ষমতাসীন দলের লোকদের হাতে বর্তমানে বা অতীতে নিগ্রহের শিকার হয়েছেন বা এখনো হচ্ছেন অনেক ডিসি, এসপি এবং সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা। এ গুলোর জন্য নেতাকর্মীদের কোনো শাস্তি হয়েছে এমন রেকর্ড নেই।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি কতটা গভীর হলে একজন ইউএনও এমন মারাত্মক হামলার শিকার হন তা সহজেই অনুমেয়। বড়জোর বড় নেতারা লোক দেখানো মাফ চাইয়ে নেন। উল্টো শাস্তি হয় প্রশাসকদের। চিহ্নিত করা হয় বিরোধী বলে। বদলি করা হয় তাকে। পোস্টিং মর্যাদাকর হয় না। প্রমোশন ঠেকে থাকে বছরের পর বছর। ওএসডি হতে হয়। কখনোবা জুনিয়রের অধীনে চাকরি করার অমর্যাদাকর অবস্থা ঘটে। চাকরিচ্যুতি ঘটে বিনা কারণ দর্শানে। আইনহীনতা পরিব্যাপ্ত হয়েছে সর্বত্র। প্রশাসকরা অন্যায়ের অধস্তন হয়ে পড়েছে। এ প্রবণতা প্রকারান্তরে সমাজকে সর্বনাশের প্রান্তসীমায় নিয়ে গেছে। প্রহরী বসিয়ে না হয় ইউএনওদের নিরাপত্তা রক্ষা করা যাবে কিন্তু জাতীয় স্বার্থের সুরক্ষা হবে কিভাবে? এই হাতুড়ি-হেলমেট বাহিনীকে রুখবে কে? এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রশাসনিক সমিতির নয়- গোটা জাতির। বিষ খেয়ে বিষ হজম করার বিষফল এ দেশের সাধারণ মানুষকেই হজম করতে হবে। মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে। সমাজের মাথা যে রাজনীতিবিদ তাদের মগজে পচন ধরলে আর যে উপায় নেই!
ছোট আয়না আর বড় আয়নার কথা বলেছিলাম। বিষয়টি প্রতীকী। ছোট আয়না যদি হয় ইউএনও তাহলে বড় আয়না সচিব বা তদূর্ধ্ব কেউ। কর্মক্ষেত্র একই। আগে বা পরে। প্রথমে অথবা শেষে। তৃণমূলে অথবা শীর্ষে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া সর্বত্রই একই দৃশ্য। প্রশ্ন সর্বাঙ্গে ব্যথা ঔষধ দেবো কোথা? চিকিৎসা এখনই প্রয়োজন। চাই উপশম। চাই চির উপশম। ইউএনও ধরনের অসংখ্য গল্প আমরা সমাজের আয়নায় দেখতে পেয়েছি। হয়তো আরো দেখতে পাব। সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম প্রতিনিয়ত আমাদের মনের আয়নায় এসব খবর পৌঁছে দেয়। কী হবে এসব দেখে আমরা যদি হই নির্বিকার? উত্তর দিয়েছেন একজন সদ্য অবসর গ্রহণকারী আমলা। তার কথা দিয়ে শেষ করি- ‘সব সরকারি অফিস, বিশ^বিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পেশাজীবী সংগঠন ও সব সাংবিধানিক ও অনুরূপ প্রতিষ্ঠান ও কমিশন থেকে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি উপড়ে ফেলা এখন সময়ের দাবি।’ (মোশারফ হোসেন ভূইয়া, সাবেক সিনিয়র সচিব ও সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড -এনবিআর, প্রথম আলো : ১৬ জুলাই ২০২০)
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
Mal55ju@yahoo.com