চীন সীমান্তে ভারতের গুলি : চীনা বিশেষজ্ঞের ভাষ্য
সীমান্তে গুলিবর্ষণে চীন সীমান্তে ভারতের গুলি - ছবি : সংগৃহীত
ভারতীয় সৈন্যরা সোমবার আবারো অবৈধভাবে লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি)অতিক্রম করেছে, নীতিবিগ্রর্হিতভাবে আলোচনার জন্য তৈরী হতে থাকা চীনের সীমান্ত টহল সৈন্যদের ওপর সতর্কতামূলক গুলিবর্ষণ করেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চীনা সৈন্যরা পাল্টা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হয় বলে মঙ্গলবার চীনা সামরিক বাহিনীর এক মুখপাত্র জানান।
চীন ও ভারতের মধ্যকার সীমান্ত অঞ্চলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই গুলিবর্ষণ চার দশকের মধ্যে এই প্রথম ঘটল।এটি একটি বিপজ্জনক কাজ। চীনা বিশেষজ্ঞরা বলেন, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করার ব্যাপারে উভয়পক্ষের মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছিল, এর মাধ্যমে ওই ঐতিহ্যের লঙ্ঘন ঘটল। তারা উল্লেখ করেন যে এর ফলে আরো বড় ধরনের সঙ্ঘাতে ঝুঁকি বাড়ল।
দুই দেশের মধ্যকার অচলাবস্থা চতুর্থ মাসে প্রবেশ করেছে। ২০১৭ সালেল ৭৩ দিনের দোকলাম অচলাবস্থার চেয়েও এটি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। সর্বশেষ এই ভারতীয় উস্কানি ভারতের মরিয়া মনোভাবই প্রদর্শন করছে। তারা আশা করছে, এর ফলে তারা আলোচনার টেবিলে দরকষাকষিতে আরো সুবিধা পাবে, কয়েক মাসের অচলাবস্থা কাটবে তাদের অনুকূলে।উল্লেখ্য, শীত আসছে। কিন্তু রণাঙ্গনে থাকা সৈন্যদের জন্য শীতকালে পর্যাপ্ত লজিস্টিক্যাল সাপোর্ট দিতে হিমশিম দফা। তাছঅড়া কোভিড-১৯ ও পাকিস্তানের সাথে সীমান্ত ইস্যুতেও তারা বেশ চাপে আছে।
চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কমান্ডের মুখপাত্র সিনিয়র কর্নেল ঝাং শুইলি মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলেন, ভারতীয় সৈন্যরা পাঙগঙন সো লেকের দক্ষিণ তীরের কাছে শেনপাও পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে চীন-ভারত সীমান্তের পশ্চিম অংশের এলএসি অতিক্রম করে।
ঝাং বলেন, ভারতীয় সৈন্যরা তাদের অভিযানের সময় নীতিবিগ্রহীতভাবে চীনা সীমান্ত টহল দলের সদস্যদের ওপর সতর্কতামূলক গুলিবর্ষণ করে। চীনা ওই সৈন্যরা তখন আলোচনার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। ভারতীয় সৈন্যদের এই কাজ মারাত্মক সামরিক উস্কানি, খুবই জঘন্য প্রকৃতির।এর জের ধরে চীনা প্রতিরক্ষা সৈন্যরা পরিস্থিতি শান্ত করতে পাল্টা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
ভারত সরকারের একটি সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে ইন্ডিয়া টুডে পরিস্থিতি নিশ্চিত করে দাবি করেছে যে চীনা সৈন্যরাই প্রথমে ভারতীয় অবস্থানের ওপর গুলিবর্ষণ করে।১৯৭৫ সালের পর ভারত-চীন সীমান্তে গুলিবর্ষণের এটিই প্রথম ঘটনা। এতে আরো বলা হয়, ৩১ আগস্টের ঘটনাতেও গুলিবর্ষণ ঘটেছিল।
ভারত আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করার চার দশক ধরে বিরাজমান মৌন সমঝোতা লঙ্ঘন করে ঘৃণ্য নজির স্থাপন করেছে। এটি মারাত্মক বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে বলে মঙ্গলবার গ্লোবাল টাইমসকে বলেছেন বেইজিংয়ের ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ইনস্টিটিউট অব সিঙ্গুয়া ইউনিভার্সিটির গবেষণা বিভাগের পরিচালক কিয়ান ফেঙ।
তিনি বলেন, উভয়পক্ষ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে মহা সংযমের পরীক্ষা দিয়েছে। চীন প্রথমে গুলি না করার নীতিমালা সমুন্নত রেখেছে।
তিনি বলেন, ভারত হয়তো এবার হুঁশিয়ারি সঙ্কেত হিসেবে আকাশে গুলি ছুড়েছে, কিন্তু পরেরবার সৈন্যদের দিকে গুলি ছোড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তিনি বলেন, চীন নিয়মতান্ত্রিক পন্থাতেই পাল্টা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু ঘটনাটি খুবই উদ্বেগজনক।
বিশ্লেষকেরা বলেছেন যে ভারতীয় মিডিয়া দাবি করেছে, চীনই প্রথম গুলি করেছে, যা অনৈতিক ও বিরক্তিকর কাজ এবং তা চীনকে দোষী করার দায়িত্বহীন কাজে পরিণত হতে পারে।
সর্বশেষ ভারতীয় এই প্ররোচনা এলো শুক্রবার মস্কোতে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) সম্মেলনের ফাঁকে চীন ও ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের বৈঠকের পরপরই। চীনা স্টেট কাউন্সিলর ও জাতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়ে ফেঙ্গে ওই বৈঠকে বলেন, চীন তার সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ওই সময় বলেছিলেন, ভারত আশা করছে যে দুই পক্ষ দায়িত্বশীল মনোভাব গ্রহণ করবে, সীমান্ত থেকে যত দ্রুত সম্ভব পূর্ণ প্রত্যাহার করবে, পরিস্থিতি জটিল করে এমন সব পদক্ষেপ এড়িয়ে যাবে।
কিয়ান বলেন, সোমবারের ঘটনাটি প্রমাণ করছে যে আলোচনা দ্রুত হওয়া উচিত। ভারত দেশে কোভিড-১৯ মহামারিতে ভয়াবহভাবে আক্রান্ত, সীমান্তে পাকিস্তানের সাথে বিরোধে নিয়োজিত। শীত আসতে থাকায় ভারত লাদাখে সৈন্য মোতায়ন করতে গিয়ে মারাত্মক লজিস্টিক সাপোর্ট ও সম্পদের সমস্যায় ভুগছে।
বিশ্লেষকদের মতে, চীনের সাথে সীমান্ত উত্তেজনার চেয়ে পাকিস্তানের সাথে ভারতের সীমান্ত উত্তেজনা আরো বেশি গুরুতর ব্যাপার, এতে চেইন রিঅ্যাকশনও রয়েছে। তীব্র সঙ্ঘাতে একইসাথে দুই ফ্রন্টে লড়াই করার মতো শক্তি ভারতীয় সেনাবাহিনীর নেই।
কিয়ান বলেন, ভারত ভয় পাচ্ছে যে অচলাবস্থা অব্যাহত থাকলে তাদের পক্ষে বিপুল চাপ সামাল দেয়া সম্ভব হবে না।এ কারণে তারা মরিয়া হয়ে যত দ্রুত সম্ভব প্রত্যাহার চায়। তিনি বলেন, এমন অবস্থার মধ্যেও ভারত এখনো আলোচনার মাধ্যমে তার স্বার্থ বাড়াতে চায়।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন, তিনি সম্ভবত ১০ সেপ্টেম্বর মস্কোতে অনুষ্ঠেয় এসসিওভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ির সাথে আলোচনা করবেন।
চীনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাপ দিয়ে আলোচনা করার ভারতের মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
গ্লোবাল টাইমস ও চায়না ইনস্টিটিউটস অব কন্টেমপোরারি ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্সের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারীদের ৫৭.১ ভাগ মনে করে না যে ভারতীয় সামরিক বাহিনী চীনের প্রতি কোনো হুমকি। আর ৪৯.৬ ভাগ মনে করে, ভারতের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল।
চীনা সেনাবাহিনীর ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কমান্ডের সৈন্যরা তাদের দায়িত্ব পালন করবে, জাতীয় ভূখণ্ড সুরক্ষিতি রাখবে।
সূত্র : গ্লোবাল টাইমস