চীন-ভারত দ্বন্দ্ব অনিবার্য!
চীন-ভারত দ্বন্দ্ব অনিবার্য! - ছবি সংগৃহীত
এশিয়ার দুই বৃহৎ শক্তি চীন ও ভারতের সীমান্ত বিরোধ ও দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো। কিন্তু ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পর এই বিরোধ খুব একটা চাঙ্গা হয়নি। বরং বিরোধের ইস্যুগুলোকে একপাশে সরিয়ে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা নিয়ে উভয় দেশ এগিয়ে গেছে। এমনকি ব্রিকস, নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং হংকং সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা গঠনের মতো এশীয় কৌশলগত সহযোগিতা বিনির্মাণে উভয় দেশ অংশগ্রহণ করেছে। প্রশ্ন হলো, এসব সহযোগিতার প্রক্রিয়া হঠাৎ করে কেন থমকে গেল।
এখন নতুন করে যে দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাত সৃষ্টি হয়েছে তার পেছনে আসলে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের যে ‘কৌশলগত প্যারাডাইম শিফট’ সেটিই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। ‘মোদি অ্যান্ড কোম্পানি’ মনে করছে, ভারতকে বিশ্বশক্তি হতে হলে পাশ্চাত্য বলয়ের সাথে একাত্ম হয়ে বৈশ্বিক মহাশক্তির কাতারে উঠতে হবে। এ জন্য কিছুটা সময় নিয়ে সোভিয়েত বলয়কেন্দ্রিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে পাশ্চাত্যকেন্দ্রিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় রূপান্তর করতে হবে। আর এ জন্য যুক্তরাষ্ট্র চীনকে সীমিত করার যে নীতি কৌশল নিয়েছে সে প্রচেষ্টায় তার মিত্র হয়ে পাশ্চাত্যের বিনিয়োগ বাজার এবং প্রতিরক্ষা পৃষ্ঠপোষকতা গ্রহণ করতে হবে।
মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগেই এই ব্যাপারে সমঝোতা চূড়ান্ত হয়ে গেছে। আর বিপুল বিক্রমে ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি সেই অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। এই কৌশলের সাথে কেবল আরএসএস বা বিজেপি যুক্ত এমনটাই নয়, ভারতের শীর্ষ স্থানীয় পুঁজিপতি ও করপোরেট হাউজগুলোকেও এই সমঝোতার অংশীদার করা হয়েছে। স্থানীয় বাণিজ্যিক জায়ান্টগুলো বেসামরিক ক্ষেত্র ছাড়াও পাশ্চাত্যের সমরাস্ত্র উৎপাদকদের সাথে যৌথ সমরাস্ত্র প্রস্তুত প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলছে। নিরাপত্তা খাতের সরকারি উদ্যোগগুলোকে বেসরকারীকরণ এবং রুশপ্রধান ভারতীয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে পাশ্চাত্যমুখী করতে মোদি সরকারের প্রয়োজন ছিল বড় আকারের সামরিক বাজেট। এই বাজেটের জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন সামরিক উত্তেজনা। পাকিস্তানে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ থেকে শুরু করে কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা- সবকিছুই প্রতিরক্ষা খাতের বড় প্যারাডাইম শিফটকে কেন্দ্র করে করা হয়েছে।
আজ চীন-ভারত যে সীমান্ত উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে সেটি এই কৌশলেরই অংশ। সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, মোদি সরকার দিল্লিতে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে কথা বলে আসছে। আর এই ৩৭০ অনুচ্ছেদ চূড়ান্তভাবে যখন বাতিল করা হয় তখন পুরো কাশ্মির উপত্যকাকে শুধু অবরুদ্ধই করা হয়নি; একই সাথে ভারতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেয়া হয় হয় যে, পাকিস্তান ও চীনা নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির গিলগিট বাল্টিস্তান ও লাদাখ ভারতের সার্বভৌম এলাকা এবং এগুলোকে ভারত নিয়ন্ত্রণে নেবে।
লোকসভায় অমিত শাহ বা রাজনাথ সিংয়ের এই ধরনের ঘোষণা দেয়ার অর্থ হলো, কার্যত চীন-পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দিল্লির যুদ্ধের ঘোষণা দেয়া। এর আগে ভুটানের দোকলামে চীন-ভারত যে ‘স্ট্যান্ড অফ’ অবস্থা সৃষ্টি হয় সেটিরও শুরু করেছিল ভারতই। পুরো কাশ্মির উপত্যকা ভারতের দখলের হুমকি চীনকে যে বিশেষভাবে উসকে দেবে সে বিষয়ে সচেতন থেকেই এটি করা হয়েছে। কারণ গিলগিট বাল্টিস্তান দিয়েই চীনের ‘রোড অ্যান্ড বেল্ট’ রুট চলে গেছে। আর চীন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের এটি হলো গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল।
প্রশ্ন হলো, ভারত কেন তার চেয়ে চার গুণ বেশি শক্তিশালী চীনের সাথে যুদ্ধের মতো উত্তেজনা সৃষ্টি করতে যাচ্ছে? এর একটি কারণ হলো, ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়িয়ে পাশ্চাত্য ও ইসরাইলের সাথে প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব জোরদার করার পরিবেশ সৃষ্টি। আর দ্বিতীয়ত, নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি ভারতে নতুন করে ক্ষমতায় আসার জন্য উন্নয়ন কর্মসংস্থান এমনকি সর্বশেষ করোনা নিয়ন্ত্রণে যে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে, তাতে উগ্র জাতীয়তাবাদী উত্তেজনা সৃষ্টি ছাড়া আবার তাদের ক্ষমতায় আসা কঠিন। তৃতীয় কারণটি হলো, ভারতের নীতি প্রণেতাদের ধারণা- যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য যেহেতু চীনবিরোধী একটি সর্বাত্মক ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে তাতে চীনের জন্য পাশ্চাত্যের বিনিয়োগ ও বাজার বন্ধ হওয়ার অর্থ হলো, ভারতের সেই সুযোগ পাওয়া। আর এই সুযোগ গ্রহণ করে অর্থনৈতিকভাবে চীনের মতো শক্তিশালী হতে পারলে ভারত এক সময় মহাশক্তির কাতারে নিজেকে নিয়ে যেতে পারবে বলে মনে করা হয়।
বলা হচ্ছে, করোনা-পরবর্তী সময়ে চীন থেকে পাশ্চাত্যের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে ভারত ও ভিয়েতনামসহ চীনবিরোধী দেশগুলোতে নিয়ে যাবে। পাশ্চাত্যের বাজারও এসব দেশের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। এই সুবিধা পেতে হলে চীনের বিরুদ্ধে ভারত যে যুদ্ধে নামছে, এমন একটি উত্তেজনা সৃষ্টি করতে হবে। আর সেটিই বুঝে শুনে দিল্লি করছে। এ কারণে চীন-ভারত সঙ্ঘাতের কারণগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, প্রায় সব ক্ষেত্রে ভারতই এই উত্তেজনা সৃষ্টি করছে। চীনের গ্লোবাল টাইমসের সম্পাদকীয়তে সেটিই উল্লেখ করা হয়েছে।
অবশ্য ভারতের নীতিপ্রণেতারা জানেন যে, চীনের সাথে যুদ্ধ শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরাইল অথবা ইউরোপ ভারতের সাথে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে আসবে না। তারা এর সুবাদে নিজেদের অস্ত্র বিক্রি করবে ভারতে। জেরুজালেম পোস্টের খবর অনুসারে এই কয়েক দিনের উত্তেজনায়, ইসরাইল ভারতের সাথে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের অস্ত্র কেনার ব্যাপারে একমত হয়েছে।
উত্তেজনা সৃষ্টির পাশাপাশি ভারতের নীতিপ্রণেতারা উত্তেজনা যাতে যুদ্ধ পর্যন্ত না গড়ায় সেটিও চাইবেন। এ কারণেই উত্তেজনা যখন তুঙ্গে তখন সমঝোতার পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য ভারতের সশস্ত্রবাহিনী প্রধান বিপিন রাওয়াত ও সেনাপ্রধান নারাভানে বলেছেন, চীন-পাকিস্তান এক হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্য দিকে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাশিয়ার মধ্যস্থতায় চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সাথে উত্তেজনা কমানোর জন্য মস্কোতে আলোচনায় মিলিত হয়েছেন।
ভারতের যেকোনো আগ্রাসী মনোভাবের কঠোর জবাব দেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রাখলেও চীন এই মুহূর্তে কৌশলগত কারণে যে যুদ্ধ চায় না, সেটি নয়াদিল্লি ভালোভাবেই জানে। এ কারণে চায়ের কাপে ঝড় তুলে ফায়দা হাসিলে যতটা দিল্লির কর্মকর্তারা মনোযোগী ততটা নন যুদ্ধের দিকে বাস্তবে অগ্রসর হওয়ার ব্যাপারে। আবার উত্তেজনা সৃষ্টি করতে গিয়ে গিয়ে চীনের হাতে ভারতের প্রায় হাজার বর্গ কিলোমিটার জায়গার দখল হারানোর ক্ষতির বিষয়টিও রয়েছে।
সব মিলিয়ে, এবারো ভারত-চীন সীমান্ত উত্তেজনা বড় রকমের যুদ্ধ পর্যন্ত না গড়ানোর সম্ভাবনাই রয়েছে। তবে এর মধ্যে চীন-ভারত অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক অনেকখানি ভেঙে পড়বে। পাশ্চাত্যের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এই জায়গাটি দখল করবে।