এত গ্যাস মসজিদের ভেতরে থাকলে মুসল্লিরা নামাজ পড়লেন কিভাবে?

কামাল উদ্দিন সুমন | Sep 08, 2020 06:48 am
ফতুল্লার তল্লার বায়তুস সালাহ জামে মসজিদ

ফতুল্লার তল্লার বায়তুস সালাহ জামে মসজিদ - ছবি : সংগৃহীত

 

প্রতিদিনের মতো গত শুক্রবার ফজর, জোহর,আসর, মাগরিরের নামাজ জামাতের সাথে আদায় হয়েছিল ফতুল্লার তল্লার বায়তুস সালাহ জামে মসজিদে। একই রাতে এশার নামাজও আদায় করেছিলেন প্রায় ৭০-৮০ জন মুসল্লি। সারা দিন একাধিকবার মসজিদের থাই গ্লাস বন্ধ করা ও খোলা হয়েছে। শুক্রবার রাতে এশার জামাতের পরও একাধিক মুসল্লি থাই গ্লাস খুলে মসজিদ থেকে বের হয়েছেন। ওই রাতে নামাজ শেষে ঘটে বিস্ফোরণের ঘটনা।

গতকাল সোমবার বিকেলে তল্লা এলাকায় গেলে একাধিক মানুষের প্রশ্নÑ মসজিদে যদি এত গ্যাস জমে থাকে, তাহলে একজন মুসল্লিও টের পোলো না? স্থানীয় চায়ের দোকানে বসা আফজাল নামের এক যুবক বলেন, গ্যাস বেশি হলে তো মানুষের নাকে লাগত আর বলা যেত। কিন্তু কেউই তো নামাজের সময় কিছু বলল না। এখন মানুষ পোড়া যাওয়ার পর সবাই কত কথা বলে। কত মানুষ দেখতে আসে। তার আক্ষেপÑ যার স্বজন যায় সে বুঝে। একই সময় স্থানীয় ভ্যানচালক তুহিন বলেন, বাসাবাড়িতে গ্যাস লিকেজ হলে গন্ধে টিকা যায় না আর এত বড় মসজিদে গ্যাসে ভরে গেছে কেউ বুঝল না।

তুহিন ও আফজালের প্রশ্নের উত্তর পেতে সময় লাগবে আরো অনেক। কারণ মসজিদের বিস্ফোরণের ঘটনা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), অ্যান্টি টেরোরিস্ট স্কোয়ার্ড, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনসহ (পিবিআই) বেশ কয়েকটি সংস্থা। তবে আগে এসি বিস্ফোরণের ঘটনা বলা হলেও ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, এসি বিস্ফোরণের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে গ্যাস লিকেজের বিষয় নিয়েই এখনো প্রকাশ্যে তদন্ত চলছে। ইতোমধ্যে তিতাস লাইন খনন কাজ শুরু করেছে। তারা পরীক্ষা করে দেখছে গ্যাসলাইনে কোনো ত্রুটি রয়েছে কিনা? এ ছাড়া বিভিন্নভাবে চলছে তদন্ত। জেলা প্রশাসন একদিনের গণশুনানি করেছে গতকাল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আলামতের ব্যালাস্টিক টেস্টের আগে বলা যাচ্ছে না আগুন লাগার মূল কারণ কী? গ্যাস ছাড়া অন্য কোনো দাহ্য বা বিস্ফোরক পদার্থ ছিল কিনা তা তদন্তে জানা যাবে।

নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমান বলেছেন, স্পেশাল এক্সপার্ট যারা আছেন তাদের দিয়ে তদন্তটা করা উচিত। বিশেষ করে বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ ও রাসায়নিক বিশেষজ্ঞ যারা আছেন। তা ছাড়া আরো যদি কোনো এক্সপার্ট থাকে তা সেনাবাহিনীতে যদি থাকে তাদের দিয়ে হতে পারে, র্যাবে যদি থাকে তাদের দিয়ে হতে পারে। তদন্তটা যেন এমনভাবে হয় যাতে ভবিষ্যতে এ নিয়ে প্রশ্ন না ওঠে।

‘আমার মৃত্যুটা যেন মসজিদে হয়’ : স্ত্রী ও এক ছেলে সন্তানকে নিয়ে এক রুমের একটি টিনশেড ভাড়া বাসায় বসবাস করে আসছিলেন সাংবাদিক নাদিম আহমেদ ফিদা। সাংবাদিকতা করার সুবাদে সামান্য যা সম্মানি পেতেন তা দিয়েই মোটামুটিভাবে চলে যেত সংসার। সংসারে একমাত্র তিনিই উপার্জনক্ষম ছিলেন। বর্তমান তিনি আর জীবিত নেই। নামাজ পড়তে গিয়ে বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হয়ে ঢাকা শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার রাতে মারা গেছেন। রাতেই খানপুর জোড়াটাংকি সংলগ্ন মাঠে সাংবাদিক নাদিম আহমেদের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
নামাজে জানাজা শেষে শহরের ডন চেম্বার এলাকায় তার বাসায় গিয়ে দেখা যায়, এক রুমের একটি টিনশেড রুমে তার স্ত্রী লীমা আহমেদ স্বামীর স্মৃতি মনে করে আহাজারি করছেন। আর পাশে আত্মীয়স্বজনরা বসে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন।

আহাজারি থামিয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে লীমা আহমেদ বলেন, সাংবাদিকতা করে যে সম্মানি পেতেন তাতেই চলত সংসার। কিন্তু সেটাও সংসার চলানোর মতো যথেষ্ট ছিল না। তাতেও কখনো কারো কাছে ঋণ বা ধার নেয়নি। না খেয়ে থাকলেও অবৈধ পথে হাঁটেননি। সৎভাবে বাঁচার চেষ্টা করেছেন সব সময়। তিনি বলেন, নাদিম প্রায়ই বলতো হজ করার টাকা তো আমার নাই, তবে আমার মৃত্যুটা যেন মসজিদে হয়। তখন আমি নিজেও বুঝতে পারতাম না কেন সে এসব বলে। মসজিদের বিস্ফোরণের ঘটনায় তার অকালে চলে যাওয়ায় আমার মনে হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা তার দোয়া কবুল করেছেন।
আজানও হচ্ছে না, নামাজও হচ্ছে না : যে মসজিদ থেকে দেয়া ফজরের আজানের শব্দে ঘুম ভাঙতো তল্লাবাসীর গত ৩ দিন ধরে আজান দেয়া আর নামাজ পড়া কোনোটাই হচ্ছে না সেই মসজিদে। শুক্রবার রাতে বিস্ফোরণের পর বায়তুস সালাহ জামে মসজিদে সকাল থেকে রাত অবধি উৎসুক মানুষের সমাগম ঠিকই ঘটে কিন্তু মুসল্লির সমাগম নেই।

বিস্ফোরণের কারণ উদঘাটনে মসজিদটি আলামত হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে আসছে বিভিন্ন সংস্থার লোকজন।
জানা যায়, ফতুল্লা ইউনিয়নের পশ্চিম তল্লার বায়তুস সালাহ জামে মসজিদ। প্রতি দিন ৫ বার আজানের সুমধুর ধ্বনি শুনে নামাজে আসতেন এলাকার মুসল্লিরা। কিন্তু চোখের পলকে পালটে গেল দৃশ্যপট। একটি ঘটনা বদলে দিলো এলাকাবাসীর জীবন। গত ৩ দিন ধরে মসজিদে ওয়াক্ত ফুরিয়ে যায়, আজান শোনা যায় না। এলাকাবাসী মসজিদের দিকে তাকাতেও ভয় পান, সবার বুকে স্বজন হারানোর আর্তনাদ।

জেলা প্রশাসনের গণশুনানি : ১৮ জনের সাক্ষ্য
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার পশ্চিম তল্লা এলাকায় বাইতুস সালাহ জামে মসজিদে জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটিকে সহযোগিতায় গণশুনানিতে ১৮ জন প্রত্যক্ষদর্শী অংশগ্রহণ করেছেন। তারা সেদিনের ঘটনার বর্ণনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে জানিয়েছেন। সোমবার বিকেলে এ বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন ওই তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরা ববি। তিনি বলেন, ১টা থেকে লোকজন আসতে শুরু করে। বিকেল সোয়া ৪টা পর্যন্ত ১৮ জন গণশুনানিতে অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়াও যারা আসবেন তাদের প্রত্যেকেরই কথা আমরা শুনব। তারা মূলত ঘটনার বর্ণনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে জানিয়েছেন। তদন্তের স্বার্থে এগুলো বলা যাচ্ছে না। একদিনের জন্যই এ গণশুনানির আয়োজন করা হয়।
তিনি আরো বলেন, তদন্তের অগ্রগতি আছে। তবে এখনো আমরা কিছুই বলতে পারছি না। বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা কাজ করছেন, তারা রিপোর্ট দেয়ার পর বিস্তারিত বলা যাবে।

গ্যাসলাইন ড্যামেজ করে মসজিদ তৈরি হয়েছে কি না তদন্ত হচ্ছে : তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার আব্দুল ওয়াহাব তালুকদার বলেছেন, সরেজমিনে আমরা দেখতে চাই মসজিদের নিচে গ্যাসের লাইন আছে কি না? যদি থেকে থাকে তাহলে মসজিদ তার কতটুক দূরে? সেখান থেকে গ্যাস বের হয়েছে কি না? মসজিদ তৈরির সময় আমাদের লাইনটাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তৈরি করা হয়েছে কি না? এসব খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের যে লাইনে গ্যাস আছে সে লাইনের কন্ডিশন কতটুকু ভালো বা খারাপ সেটাও দেখার বিষয় আছে। ওই লাইনটা বেশ পুরনো লাইন, অন্তত ৩০ বছর পুরনো। যেখান থেকে গ্যাস বের হচ্ছে সেই লাইনের ব্যতিরেকে অন্য জায়গায় যদি লাইন ভালো থাকে তাহলে আমরা সাবাই বুঝতে পারব মসজিদ তৈরির সময় ফাউন্ডেশন করতে গিয়ে আমাদের পাইপলাইন ড্যামেজ করে মসজিদ তৈরি করেছে কিনা। সে ক্ষেত্রে আমাদের জানিয়েছে কিনা। আর ড্যামেজটা কিভাবে হয়েছে তা চিহ্নিত করার জন্যই আজ আমরা মাটি কেটে সেটা সরেজমিনে দেখতে চাচ্ছি।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us