জেনারেল আসিম বাজওয়ার পদত্যাগ ও পাকিস্তানের রাজনীতি
জেনারেল আসিম বাজওয়ার - ছবি : সংগৃহীত
পাকিস্তান ও চীনের মধ্যকার অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের (সিপিইসি) চেয়ারম্যান লে. জেনারেল (অব.) আসিম সেলিম বাজওয়ার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। প্রধানমন্ত্রী বাজওয়াকে তার পদে থেকে কাজ চালিয়ে যেতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, “আসিম বাজওয়ার কর্মতৎপরতা এবং যে ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন, তাতে আমি সন্তুষ্ট”। বিশিষ্ট বিশ্লেষকরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী এখানে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন।
আসিম বাজওয়ার পদত্যাগ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত স্বাভাবিকভাবেই বিরোধী দলগুলো ভালোভাবে নেয়নি। তাছাড়া বিরোধী দল সমর্থিত বা প্রতিষ্ঠান বিরোধী, পশ্চিমাপন্থী বা ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত মিডিয়াগুলোও এতে খুশি হয়নি। অনেকেই ভেবেছিল যে, অজানা জায়গা থেকে দোয়া আহমেদ নুরানির ব্লগ পোস্টটির কারণে উভয় পদ থেকে (সিপিইসি কর্তৃপক্ষ এবং তথ্য বিষয়ক এসএপিএম) জেনারেল সরে যাবেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের মেয়ে এবং ভাইস প্রেসিডেন্টের পিএমএলএন মরিয়ম নওয়াজও এই ইস্যুতে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। জেনারেল বাজওয়া যখন এসএপিএম পদ থেকে পদত্যাগ করলেন, তখন তারা দাবি জানান যাতে আসিম বাজওয়ার এই পদত্যাগ অর্থহীন এবং তাকে মূলত সিপিইসি কর্তৃপক্ষের পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে।
জেনারেল বাজওয়ার পদত্যাগপত্র কেন গ্রহণ করেননি ইমরান খান?
প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যেখানে দায়বদ্ধতার প্রশ্নে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন এবং মন্ত্রিসভা সদস্য থেকে নিয়ে ঘনিষ্ঠ কাউকেও তিনি ছাড় দেন না, সেখানে কেন তিনি আসিম বাজওয়াকে পদত্যাগপত্র ফিরিয়ে নিতে বলেছেন, সেই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ।
একটি বিষয় স্পষ্ট, আহমেদ নুরানির গল্পের অনেক ফাঁক ফোকর রয়েছে; তিনি পরস্পর বিচ্ছিন্ন কিছু তথ্য একত্র করে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে জেনারেল বাজওয়ার ভাইয়েরা ও পরিবারের সদস্যরা যে সব ব্যবসায় চালান, সেগুলো জেনারেল বাজওয়ার চুরি করা সরকারি তহবিলের উপর নির্ভরশীল। তার ভাষ্যমতে, বাজওয়া কর্নেল হওয়ার পর থেকে – যখন তিনি প্রেসিডেন্ট মুশাররফের অধীনে কাজ করেছিলেন – তখন থেকে সিপিইসি অথরিটির চেয়ারম্যান হওয়া পর্যন্ত সময়কালে এই সব অর্থ তিনি চুরি করেছেন।
এই গল্প নিয়ে যথেষ্ট প্রচারণা হয়েছে। পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষই কোনা গল্প গভীরভাবে খতিয়ে দেখে না এবং টুইটারে যেহেতু পক্ষপাতিত্বপূর্ণ বহু কণ্ঠস্বর রয়েছে, সে কারণে নুরানির গল্পের দুর্বলতাগুলো সহজেই পাশ কাটিয়ে গেছেন তারা এবং ইমরান খানের সরকার এবং দেশের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছেন তারা। বাজওয়া টুইটারে নুরানির অভিযোগের চার পৃষ্ঠার ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যাতে নুরানির গল্পের আর ভিত্তি থাকে না। প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে এই সব কিছুর উপরেই নজর রাখা হয়েছে।
কিন্তু এটাই পুরো ব্যাখ্যা নয়। এর আগে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একমাত্র করাচির পিটিআই নেতা ড. আমির লিয়াকত হোসেনকে তার পদত্যাগপত্র ফিরিয়ে নিতে বলেছিলেন। আলিম খান, জেহাঙ্গির তারিন, তানিয়া আইদ্রুস, কিয়ানি এবং আরও অনেকের ক্ষেত্রে সেটা তিনি করেননি। তাহলে এখানে পার্থক্যটা কোথায়?
বিরোধী মিডিয়া দাবি করেছে যে, প্রধানমন্ত্রী সামরিক বাহিনীর ভয়ে ভীত। কিন্তু জিভিএস ইসলামাবাদের গ্রহণযোগ্য সূত্র থেকে জানতে পেরেছে যে, সেনা সদরের সুপারিশে বাজওয়াকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রী নিজের টিমের জোরালো সুপারিশের কারণে নিজেই তাকে বেছে নিয়েছেন।
জেনারেল বাজওয়ার প্রতি চীনাদের আস্থা
সাউদার্ন কমান্ডের প্রধান থাকাকালে বাজওয়া চীন সরকারের আস্থাও অর্জন করেছিলেন। গত দুই বছরে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় মিডিয়াগুলো সিপিইসি নিয়ে অনেক রটনা রটিয়েছিল, যেটা বেইজিংকে উদ্বিগ্ন করেছিল। কাজের গতি বাড়াতে এবং সিপিইসির আস্থা ফেরাতেই সিপিইসি অথরিটি গঠন করা হয়েছে। সে কারণেই এমন কাউকে বেছে নেয়া জরুরি ছিল যাকে বিশ্বাস করা যায় এবং যে সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য।
বৃহস্পতিবার টিভি শো-তে আসিম বাজওয়া বলেন তিনি প্রধানমন্ত্রীর ‘তথ্য ও সম্প্রচার বিষয়ক’ বিশেষ সহকারীর (এসএপিএম) পদ থেকে পদত্যাগ করবেন, তবে সিপিইসি কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব পালন করে যাবেন। টেলিভিশনে তিনি বলেন, “আমি পুরোপুরি সিপিইসি প্রকল্পে মনোযোগ দিতে চাই। সিপিইসি প্রকল্পগুলো দেশের ভবিষ্যৎ”। এআরওয়াই টিভিতে এবং পরে জিও টিভিতে টক শোতে অংশ নেন তিনি।
এসএপিএম জেনারেল আসিম বাজওয়া জানান, শুক্রবার তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দিবেন। “আমি আশা করছি প্রধানমন্ত্রী আমাকে সিপিইসিতে পূর্ণ মনোযোগ দেয়ার সুযোগ দেবেন”।
নুরানির তত্ত্বের অসারতা তুলে ধরেছে জেনারেল বাজওয়ার ব্যাখ্যা
এর আগে জেনারেল (অব.) আসিম সেলিম বাজওয়া তার আইনজীবী ও অ্যাকাউন্ট্যান্টদের মাধ্যমে আহমেদ নুরানির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ব্লগের চার পৃষ্ঠার ব্যাখ্যা দেন।
বাজওয়ার তার ব্যাখ্যায় নুরানির মূল বক্তব্যকে মূলত অসার প্রমাণ করেছেন, যেখানে দাবি করা হয়েছে যে, “তার সামরিক ক্যারিয়ারের উপর ভিত্তি করেই যুক্তরাষ্ট্রে তার পরিবারের ব্যবসায় পরিচালিত হচ্ছে”।
তাছাড়া নুরানি সবসময় পাকিস্তানে একটি বিতর্কিত চরিত্র ছিলেন। বেশ কয়েক মাস আগে পাকিস্তানে অজানা ব্যক্তিদের হাতে রহস্যময় কারণে তিনি হামলার শিকার হন। এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা নির্বাসনে আছেন এবং এটা অস্পষ্ট যে কিভাবে তিনি নিজেকে এবং তার পরিবারের ভরণপোষণ করছেন। তাছাড়া নুরানির ব্লগের আসল উদ্দেশ্য নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।
ইসলামাবাদের অনেকেই এই প্রশ্ন তুলেছেন যে, তার আসল টার্গেট কি বাজওয়া, না কি সিপিইসি?
জেনারেল বাজওয়ার ব্যাখ্যাতে অবশ্য সব প্রশ্নের উত্তর আসেনি। স্বাভাবিকভাবেই নতুন প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। টিভিতে তিনি তার ব্যাখ্যা দেয়ার পর টিভি অ্যাঙ্কার, রাজনীতিবিদ ও টুইটার অ্যাক্টিভিস্টরা দাবি তুলেছেন যে, কিভাবে তিনি ১৯,০০০ ডলার জমালেন, এবং কিভাবে সেটা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠালেন, সেটা খুঁজে বের করা হোক।
জেনারেল বাজওয়া স্মার্ট আচরণ করেছেন। তিনি শুধু টুইটারে তার আইনজীবীদের দিয়ে সুস্পষ্ট জবাবই দেননি, একই সাথে টিভিতে হাজির হয়ে জোরালোভাবে তার বক্তব্য রেখেছেন।
বাজওয়ার ব্যাখ্যা কেন নুরানির তত্ত্ব নাকচ করে দিয়েছে?
পাকিস্তানি মিডিয়ায় যে সব ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল, বাজওয়ার ব্যাখ্যা সেগুলো দূর করে দিয়েছে।
প্রথমত, মার্কিন ভিত্তিক ব্যবসায় বাজওয়ার বা তার স্ত্রীর নয়, এবং তারা সেখানে একটি শেয়ার হোল্ডার মাত্র। তার ভাইয়েরা সেখানে মার্কিন ব্যবসায়ীদের অংশীদার হিসেবে কাজ করছেন এবং মার্কিন নিয়ম নীতির পর্যবেক্ষণে সেগুলো পরিচালিত হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, নুরানি যে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন যে, বাজওয়ার পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে বিশাল আর্থিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে, সেটি সত্য নয়। বরং সেখানে তাদের সামান্য ব্যবসায় রয়েছে, সব মিলিয়ে ২৭টি দোকান বা ডেলিভারি শপ রয়েছে।
তৃতীয়ত, পাপা জোনস প্রতিষ্ঠানে বাজওয়ার পরিবারের অংশীদারিত্ব শুরু হযেছে ৯/১১ এর ঘটনার পর, যখন যুক্তরাষ্ট্র মুসলিমদের বিনিয়োগকে অনেক কড়াভাবে যাচাই বাছাই করেছে।
নুরানি তার ব্লগে সামরিক বাহিনীতে বাজওয়ার উত্থানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে তার পরিবারের ব্যবসায় সম্প্রসারণের মধ্যে যোগসূত্রের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
সিপিইসি কর্তৃপক্ষ চেয়ারম্যান জানান যে, ২০০২ সাল থেকে চলতি বছরের ১ জুন পর্যন্ত তার স্ত্রী তার ভাইদের এই কোম্পানিতে ১৯,৪৯২ ডলার বিনিয়োগ করেছে। “আঠারো বছর ধরে আমার জমানো অর্থ থেকে এই বিনিয়োগ করা হয়েছে, যার প্রতিটি পয়সার হিসাব রয়েছে। তাছাড়া একটি বারের জন্যও স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের কোন নিয়ম এখানে লঙ্ঘন করা হয়নি”।
যুক্তরাষ্ট্রে নুরানিকে কে অর্থায়ন করেছে – এটিও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
নুরানি যে অভিযোগ করেছেন, একই ধরনের অভিযোগ করেছিলেন ভারতের মেজর গৌরব আরিয়া, যিনি ভারত সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। এর বাইরেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো নুরানি কিভাবে বিগত মাসগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রে বাস করেছে। বিশিষ্ট ব্লগার, মালিহা হাশমি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা তুলেছেন:
মেজর জেনারেল আরিয়া এবং রিপাবলিক টিভিকে ইসলামাবাদ থেকে দেখলে, তাদেরকে শুধু ভারত সরকারের কাছেরই মনে হয় না, বরং সিপিইসির বিরুদ্ধে অপপ্রচারকারী হিসেবেও তাদের অবস্থান বোঝা যায়। গৌরব সম্প্রতি দাবি করেছে যে, এই পুরো প্রচেষ্টাটাই ব্যার্থ হয়েছে। তিনি এটাও দাবি করেছেন যে, চীনারা এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজছে।
এই সব কিছু ঘটেছে মূলত আক্ষরিক অর্থেই ৭২ ঘন্টার মধ্যে। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার সকল এসএপিএমকে তাদের সম্পত্তির ঘোষণা দিতে বলেছেন মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে। আসিম বাজওয়াকে ঘিরে সৃষ্ট নাটকের উপর নজর রাখছেন তিনি। যখন তিনি সিপিইসির চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করতে বলেন তাকে, ততক্ষণে তিনি বুঝে গেছেন যে নাটকের নাট বল্টুগুলো কোথায়। তিনি জানেন যে, এই পর্যায়ে এসে এমনকি এসএপিএম থেকে তার পদত্যাগ গ্রহণ করার অর্থ হবে দুর্বলতা দেখানো এবং এটা নতুন গঠিত সিপিইসি কর্তৃপক্ষের নৈতিক অবস্থানকে নষ্ট করে দেবে।
সূত্র : জিভিএস/এসএএম