বিপুল ক্ষমতা হাতে পাচ্ছে গোতাবায়া রাজাপাকসা
গোতাবায়া রাজাপাকসা - ছবি : সংগৃহীত
শ্রীলঙ্কার ২০তম সাংবিধানিক সংশোধনী বিল মন্ত্রিসভায় পাস হয়ে বৃহস্পতিবার সরকারি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে।চার বছর আগে রাজাপাকসা পরিবারের গঠিত শ্রীলঙ্কা পদুজনা পেরামুনার (এসএলপিপি) প্রায় দুই তৃতীয়াংশ আসনে ঐতিহাসিক জয়ের প্রেক্ষাপটে এমনটা হবে, তা সবাই জানত। এসএলপিপি এখন সব রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে অপ্রয়োজনীয় করে তুলেছে। তারা এখন ১৯৭৮-২০১৫ সালের সময়কালে বিদ্যমান সর্ব শক্তিশালী নির্বাহী প্রেসিডেন্সিতে ফিরে গেছে। তারা এখন বিলটি পার্লামেন্টে পাসসহ আইনে পরিণত করার পরবর্তী ধাপে যেতে পারবে।
বিশতম সংশোধনীর লক্ষ্য হলো বিদ্যামান নির্বাহী প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হ্রাস করে ১৯তম সংশোধনীতে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছিল, সেগুলো বাতিল করে দেয়া। উল্লেখ্য, ওই সংশোধনীতে পার্লামেন্টের অনেক ক্ষমতাও বিভিন্ন স্বাধীন সাংবিধানিক কমিশনের হাতে দেয়া হয়েছিল। ওগুলোও বাতিল করা হয়েছে।এর ফলে আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে যে নতুন পরিবর্তন সাংবিধানিক গণতন্ত্রের প্রতি একটি হুমকি।
কলম্বোভিত্তিক নিরপেক্ষ থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর পলিসি অলটারনেটিভসের (সিপিএ) শুক্রবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সংবিধান পরিবর্তন নিয়ে ২ সেপ্টেম্বর জারি করা ২০তম সংশোধনী নিয়ে তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সংগঠনটি জানায়, এই সংশোধনী ২০১০ সালে প্রবর্তিত অষ্টাদশ সংশোধনীতের প্রেসিডেন্টের ওপর আরোপ করা অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসা ও প্রধানমন্ত্রী মহিন্দা রাজাপাকসার নেতৃত্বাধীন সরকারের বর্তমান সিদ্ধান্তটি একেবারে পুরোপুরি নতুন সংবিধান প্রণয়নের যে চেষ্টা চলছে তারই অংশবিশেষ।
২০এ নামে পরিচিত খসড়া ব্যবস্থাটি কনস্টিউশনাল কাউন্সিল (সিসি) বিলুপ্ত করছে। সিসির প্রতিনিধিত্ব করেছিল অ-পার্লামেন্টারিয়ানরা। ২০তম সংশোধনীতে এর স্থলাভিষিক্ত হয় পার্লামেন্টারি কাউন্সিল (পিসি)। এই কাউন্সিল পুরোপুরি সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে গঠিত হচ্ছে।নতুন সংশোধনীতে পার্লামেন্ট সদস্যদের দ্বৈ নাগরিকত্ব অনুমোদন করা হয়। তাছাড়া আগে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে হলে বয়সের যে নির্ধারিত সীমারেখা ছিল, তাও প্রত্যাহার করা হয়েছে। ১৯৭৮ সালের সংবিধানে বলা হয়েছিল যে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর বয়স হতে হবে ন্যূনতম ৩০ বছর। ১৯এ সংশোধনীতে তা বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৩৫ বছর। নতুন পরিবর্তনে তা আগের ৩০ বছরে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে।
২০তম সংশোধনীতে থাকা অন্যান্য পরিবর্তন জররি পরিবর্তন হিসেবে পার্লামেন্টে আনা হয়।
নতুন সংবিধানে পুলিশ কমিশন, জুডিশিয়াল কমিশন ও পাবলিক সার্ভিক কমিশনের মতো স্বাধীন কমিশনগুলো বহাল রাখা হয়েছে। তবে বলা হয়েছে, তাদের নিয়োগ করবেন প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্টারি কাউন্সিলের সাথে পরামর্শক্রমে। কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিলের (সিসি) স্থলাভিষিক্ত হবে পার্লামেন্টারি কাউন্সিল (পিসি) এবং এর সদস্যরা হবেন প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধী দলের নেতা, প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত একজন, বিরোধী দলের নেতার মনোনীত একজন সদস্য।আগের ব্যবস্থায় ছিল নাগরিক সমাজের তিন ব্যক্তি এর সদস্য হবেন। কিন্তু ওই ব্যবস্থা এবার বাতিল করা হয়েছে। আর এটিই উদার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে নস্যাত করবে বলে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।
সেন্টার ফর পলিসি আলটারনেটিভসের (সিপিএ) তার বিশ্লেষণে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, এই পরিবর্তনের ফলে সাংবিধানিক ভারসাম্য রক্ষার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। তাছাড়া সরকারি তহবিলের কার্যকারিতা, দক্ষতা ও স্বচ্ছতাও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
এতে বলা হয়, আইন প্রণয়নকারী প্রক্রিয়াতেও প্রস্তাবিত সংশোধনীটি একই ধরনের উদ্বেগ সৃষ্টি করবে। এতে জোর দিয়ে বলা হয় যে এই সংশোধনীর ফলে স্বচ্ছতা হ্রাস করবে, জবাবদিহিতা কমিয়ে দেবে। আর এর প্রভাব শ্রীলঙ্কার সব নাগরিকের ওপর অনুভূত হবে।
তারা জানায়, বিলটি আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা উচিত। কারণ আইনের শাসন খর্ব করায়, নাগরিকদের সার্বভৌমত্ব বাধাগ্রস্ত করায় শ্রীলঙ্কার সাংবিধানিক গণতন্ত্রের ওপর এর বিপুল প্রভাব রয়েছে। এ ধরনের আইন প্রণয়নের আগে সব নাগরিকের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন বলেও সংগঠনটি জোরালভাবে জানায়।
তবে সংগঠনটি বিলটির ইতিবাচক কিছু দিকের প্রশংসাও করে। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্টের ৫ বছরের মেয়াদ অব্যাহত রাখার বিষয়টিকে স্বাগত জানানো হয়। এছাড়া প্রেসিডেন্টের মেয়াদ দুই মেয়াদ রাখার বিষয়টিকেও ইতিবাচক বলে জানানো হয়। তাছাড়া তথ্যের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ারও প্রশংসা করে সংগঠনটি।
অনুচ্ছেদ ১৯এ বাতিল করার ব্যাপারে এসএলপিপির সাধারণ যুক্তি হলো এই যে এটি ক্ষমতার বিভাজনকে একদিকে যেমন স্পষ্টভাবে বলা হয়নি, অন্যদিকে তা বাস্তবতার আলোকেও প্রণয়ন করা হয়নি। আর এর ফলেই নির্বাচিত সাবেক নির্বাহী প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনার সাথে সাবেক প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিঙ্গের সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হয়। কর্তৃত্ব নিয়ে ওই দুজনের মধ্যে অনেক ব্যবধান, বিভ্রান্তি ও অসামঞ্জস তা দেখা যায়। এসএলপিপি আরো জানায়, তারা নির্বাচনে এসব পরিবর্তনের ব্যাপারে জনসাধারণের কাছ থেকে রায় পেয়েছে। তারা প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনে এসএলপিপিকে বিপুলভাবে জয়ী করে তাদের পক্ষে রায় দিয়েছে। তারা আরো জানায়, ইউএনপি সরকার ১৯তম সংশোধনীর মাধ্যমে আসলে বিভ্রান্তিই সৃষ্টি করেছিল।
১৯তম সংশোধনীর দ্ব্যর্থবোধকতার জন্য কেবল প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যেই সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হয়নি, সেইসাথে প্রেসিডেন্টের সাথে স্বাধীন কমিশনগুলোর সঙ্ঘাতের ফলে সাবেক সরকারে স্থবিরতারও সৃষ্টি হয়েছিল। আর সেটাই এসএলপিপিকে পার্লামেন্ট নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী করতে সহায়তা করেছিল। আবার নির্বাচনে ইউএনপি নজিরবিহীনভাবে ভরাডুবিরও শিকার হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিঙ্গে ব্যর্থতাগুলো একটি শক্তিশালী সরকার, শক্তিশালী প্রেসিডেন্সির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে।
প্রস্তাবিত সংশোধনীর ফলে এসএলপিপি এখন কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে যেতে পারবে।
এদিকে পার্লামেন্টে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে এসএলপিপির যে সামান্য ঘাটতি রয়েছে, তা কে পূরণ করবে, তা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে রাজাপাকসা সরকার দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে প্রায়োগিক দিক থেকে মাত্র একটি আসনে পিছিয়ে আছে। ২২৫ আসনবিশিষ্ট পার্লামেন্টে তাদের সদস্য সংখ্যা কার্যত ১৪৯টি। তবে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে নিরাপদে অবস্থান করতে চাইলে তাদের দরকার দুই থেকে তিনজন এমপি। আর তা পূরণ করতে পারে সাজিথ প্রেমাদাসার বর্তমান প্রধান বিরোধীদল সামাজি জন বালাবেগয়া (এসজেবি) বা টিএনএর সাথে নেই এমন ছোট ছোট তামিল দলগুলো। আগে অবশ্য, মুসলিম দলগুলো দল বদল করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করত। কিন্তু এসএলপিপি এখন তাদের ব্যাপারে আগ্রহী নয়। তাদের বর্তমান মন্ত্রিসভায় মাত্র একজন মুসলিম মন্ত্রী আছেন। অবশ্য তিনি বেশ শক্তিশাল মন্ত্রণালয় পেয়েছেন। তিনি আইনমন্ত্রী হয়েছেন। সরকারের মধ্যে সাধারণ ধারণা রয়েছে যে মুসলিম দলগুলো সাম্প্রদায়িক। এ কারণে সাবেক শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী রিশাদ বাথুউদ্দিন ও তার অল সিলন মাক্কাল কংগ্রেসকে পুরোপুরি বাদ দেয়া হয়েছে। ইস্টার সানডে হামলার জন্য রিশাদকে জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করা হয়েছে।
ফলে বিলটি পাস করানোর জন্য অতিরিক্ত যে সদস্য দরকার তা আসতে পারে এসজেবি থেকে। উল্লেখ্য, এসজেবি গঠিত হয়েছে ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) ভেঙে।
সূত্র : এসএএম