সুন্নতি পোশাক কোনটি এবং কেন?

এমদাদুল হক চৌধুরী | Sep 07, 2020 02:25 pm
সুন্নতি পোশাক কোনটি এবং কেন?

সুন্নতি পোশাক কোনটি এবং কেন? - ছবি : সংগৃহীত

 

ইসলামী পোশাক নিয়ে মাঝে মধ্যে বিতর্ক ওঠে। সাধারণ একটি ধারণা রয়েছে যে, পুরুষদের ইসলামী পোশাক হলো জোব্বা। না, জোব্বা ইসলামী পোশাক নয়। কারণ, রাসূল সা:-এর সময় আরবের আবু জেহেল, আবু লাহাবদের পোশাক ছিল জোব্বা। তারাও জোব্বা পরিধান করতেন। আবার রাসূল সা: ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামগণও জোব্বা পরতেন। জোব্বা আরবের আদত বা প্রথা। তৎকালীন আরবে জোব্বা ছিল সামাজিক লোকাচার। জানতে হবে, কোনটা আদত, আর কোনটা ইবাদত। জ্ঞান আর মুক্তচিন্তা অভাবের কারণে, কিছু হুজুর আদত ও ইবাদতকে একাকার করে ফেলেছেন। রাসূল সা: এবং সাহাবায়ে কেরামদের যুগে এমন একটিও দৃষ্টান্ত বা ঘটনা পাওয়া যাবে না যে, কোনো মুশরিক ইসলাম গ্রহণের পর তার পূর্বের পোশাক বদলিয়ে নতুন করে জোব্বা পরিধানের কথা বলতে বলা হয়েছে। কিংবা ইসলামী পোশাকের নামে তাকে একটি জোব্বা দেয়া হয়েছে।

পরবর্তীকালে সাহাবায়ে কেরামরা ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের হাতে শত, শত, হাজার, হাজার অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেছেন। কোনো একটি দেশেও এমন একটি ঘটনা পাওয়া যাবে না যে, সে দেশের অমুসলিম ইসলাম গ্রহণের পর, তাকে পূর্বের পোশাক পরিবর্তন করতে বলা হয়েছে। কিংবা, তথাকথিত, সুন্নতি পোশাকের নামে তাকে জোব্বা পরতে বলা হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, পুরুষদের যদি সুন্নতি পোশাক থাকে, তাহলে মহিলাদের সুন্নতি পোশাক কী? অর্থাৎ, পুরুষদের যদি সুন্নতি পোশাক থাকে, তাহলে মহিলাদের সুন্নতি পোশাক নেই কেন?

কারণ, একটাই। তা হলো, ইসলাম একটি সর্বজনীন জীবনবিধান। এই জীবনবিধান, সব দেশের, সব মানুষের, সব আবহাওয়ার জন্য গ্রহণযোগ্য একটি জীবনবিধান। মানুষ তার দেশের আবহাওয়া ও লোকাচারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পোশাক পরিধান করবে এটাই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতাই ইসলামের একটি বিশেষ দিক।

পোশাকের ব্যাপারে রাসূল সা: বলেন, আমর ইবনে শোয়াইব থেকে তার দাদার সূত্রে বর্ণনা করেছেন, রাসূল সা: বলেন, ‘তোমরা পানাহার করো, দান-খয়রাত করো, কিন্তু অপচয় ও অহঙ্কারী পোশাক পরিধান করো না।’ (নাসায়ি, খণ্ড ৫, পৃ : ৫৯, হাদিস ২৫৫৯)

পোশাকের ব্যাপারে রাসূল সা:-এর নির্দেশনা :

প্রথমত, পুরুষেরা নারীদের এবং নারীরা পুরুষদের পোশাক পরিধান করতে পারবে না। এ ব্যাপারে রাসূল সা: অভিশম্পাত দিয়ে বলেন, ‘অভিশম্পাত ওই পুরুষকে যে নারীদের ন্যায় পোশাক পরিধান করে, অভিশম্পাত ওই নারীকেও যে পুরুষের ন্যায় পোশাক পরিধান করে।’ (আবু দাউদ, হাদিস ৪০৯৮)

দ্বিতীয়ত, রেশমি পোশাক ও খ্যাতির পোশাক পরা : ঈদ এলে আমরা দেখি, টিভি হিন্দি সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকাদের নামে নানা রঙের বাহারি পোশাক বাজারজাত করা হয়। উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরাও তাদের প্রিয় নায়ক-নায়িকাদের পোশাক কিনতে মরিয়া হয়ে ওঠে। প্রিয় নায়িকার পোশাক কিনতে না পারার বেদনায় আত্মহত্যার খবর পত্রিকায় প্রকাশ হতে দেখা যায়। পোশাকের এ দিকটিতে ইঙ্গিত করে রাসূল সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে প্রসিদ্ধি লাভের আশায় পোশাক পরবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তাকে লাঞ্ছনার পোশাক পরিয়ে দেবেন। এরপর তাকে অগ্নিদগ্ধ করবেন। (আবু দাউদ, হাদিস ৪০২৯)

তৃতীয়ত, ভিন্ন ধর্মীয় পুরোহিতদের অনুকরণে পোশাক : যে পোশাক পরলে, ভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিত্ব বা ভিন্ন ধর্মের লোক মনে হয়, সে ধরনের পোশাক পরতে রাসূল সা: কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। যেমন : হিন্দু পুরোহিতদের, বৌদ্ধ পুরোহিতদের, খ্রিষ্টান পুরোহিতদের ইত্যাদি, ইত্যাদি।

রাসূল সা: বলেন, যে ব্যক্তি ভিন্ন ধর্মের লোকদের পোশাক পরবে, সে আমার দলের অন্তর্ভুক্ত নয়। (তাবরানি, হাদিস ৩৯২১)

চতুর্থত, গর্ব অহঙ্কার জাতীয় পোশাক : যে পোশাক পরলে অহঙ্কার প্রদর্শন করা হয়। কারণ, অহঙ্কার আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার চাদর। তাই, যে পোশাকে অন্তরে অহঙ্কারের ব্যাধি পয়দা হয় সে পোশাক পরা যাবে না। রাসূল সা: বলেন, যে ব্যক্তি অহঙ্কারবশত টাখনুর নিচে পরে, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তাকে পবিত্র করবেন না এবং তার দিকে তাকাবেন না। (বুখারি, হাদিস ৫৭৯১)

পঞ্চমত, যে টাইটফিট পোশাকে নারীদের শরীরের অবয়ব প্রকাশিত হয়, সে পোশাক নারীরা পরতে পারবে না। অনুরূপভাবে পুরুষরাও টাখনুর নিচে প্যান্ট বা পায়জামা পরতে পারবে না।

ষষ্ঠত, পোশাক পরিধানে কৃপণতা না করা : অপচয়ের ন্যয় কৃপণতাও ইসলামে নিন্দনীয় একটি কাজ। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার নিয়ামতের প্রকাশ পোশাকের মধ্যে থাকা উচিত। ব্যাপক আর্থিক সামর্থ্য থাকার পরও নিম্নমানের বা দরিদ্রের পোশাক পরা রাসূল সা: নিষেধ করেছেন।
একবার, আবুল আহওয়াসের পিতা রাসূল সা:-এর কাছে এলেন। তখন তার পরনে ছিল নিম্নমানের পোশাক। রাসূল সা: বললেন, তোমার কি সম্পদ আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। রাসূল সা: পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, কী সম্পদ আছে? তখন তিনি বললেন, উট, গরু, ছাগল, ঘোড়া, গোলাম, ইত্যাদি ইত্যাদি। সম্পদের এ বিবরণ শুনে রাসূল সা: বললেন, আল্লাহ যখন তোমাকে এত নিয়ামত দিয়েছে, সে নিয়ামতের ছাপ তোমার পোশাকে থাকা চাই। (নাসাঈ, হাদিস ৫২৯৪)

সপ্তমত, পোশাকে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা : পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ। নিজের পোশাককে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখা ইসলামে একটি জরুরি বিষয়। এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কোনো এক সফর থেকে ফেরার পথে রাসূল সা: তাঁর প্রিয় সাহাবাদের লক্ষ করে বললেন, ‘তোমরা তোমাদের ভাইদের কাছে আগমন করছ। সুতরাং তোমাদের হাওদাগুলো গুছিয়ে নাও এবং তোমাদের পোশাক পরিপাটি করো, যাতে তোমাদের (সাক্ষাৎ করতে আসা) মানুষের ভিড়ে তিলকের মতো সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন মনে হয়। আল্লাহ তায়ালা স্বভাবগতভাবে নোংরামি বা ইচ্ছাকৃতভাবে নোংরা থাকা পছন্দ করেন না।’ (আবু দাউদ, হাদিস ৭০৮৩)

অষ্টমত, পোশাকের মাধ্যমে সতর ঢাকা : আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন, ‘হে আদম সন্তান! আমি তোমাদের জন্য অবতীর্ণ করেছি পোশাক। তোমাদের দেহের যে অংশ প্রকাশ করা দোষণীয় তা ঢাকার জন্য এবং তা সৌন্দর্যের উপকরণ। বস্তুত, তাকওয়ার যে পোশাক সেটাই সর্বোত্তম।’ সূরা আরাফ, আয়াত ২৬।
পুরুষদের নাভী থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত, এবং মহিলাদের পুরো শরীরই সতর। এই সতর ঢেকে রাখা ফরজ। পোশাকের উদ্দেশ্য হলো সতর ঢাকা। যে পোশাকে সতর ঢাকা হয় না, সে পোশাক, পোশাকই নয়।

সর্বশেষ : রাসূল সা: নতুন পোশাকের ক্ষেত্রে সর্বদাই শোকরিয়া আদায় করতেন। কারণ, নতুন পোশাক পরিধান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার নিয়ামত। নতুন পোশাক পরিধানের সময় বলতেন, ‘হে আল্লাহ! তোমারই প্রশংসা। তুমিই আমাকে এই পোশাক পরিয়েছ। আমরা তোমার কাছে এ কাপড়ের কল্যাণ ও উপকারিতা প্রার্থনা করি এবং অকল্যাণ ও অপকারিতা থেকে আশ্রয় চাই।’ (তিরমিজ, হাদিস ১৭৬৭)।

লেখক ও গবেষক


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us