কিয়ামত দিবসে ৪টি প্রশ্নের ২টি হবে সময় সম্পর্কে
কিয়ামত দিবসে মানুষকে সময় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে - ছবি : সংগৃহীত
পার্থিব জীবনে মুমিনের মূল পুঁজি সামান্য কিছু সময়। সময় কল্যাণের পথে ব্যয় ও সময় থেকে উপকৃত হওয়ার চেষ্টাকারীর জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে সুসংবাদ রয়েছে। সময়ের সঠিক ব্যবহারে শিথিলতা প্রদর্শন করা জীবনের মূল পুঁজি ধ্বংসের নামান্তর। ভোগবিলাসে মূল্যবান অধিকাংশ সময় নষ্ট করছে। সময়ের সঠিক ব্যবহার মুমিনকে জান্নাতের সুউচ্চ আসনে পৌঁছে দিতে পারে। অপরদিকে সময়ের অবহেলায় নিক্ষিপ্ত হতে পারে জাহান্নামে। প্রবাদ আছে যে সময় ও নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না।
কুরআন ও হাদিসে সময়ের পরিচর্যা স্ববিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া সালাফদের দিকে তাকালে দেখব তাদের লোভ ছিলো সময়ের প্রতি। যদিও সময়ের চেয়ে দিনার, দিরহাম, ডলার বা টাকার প্রতি আমরা আগ্রহী। সময়কে শ্রেষ্ঠ নিয়ামত বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন: ‘তিনিই রাত ও দিন, সূর্য ও চাঁদকে তোমাদের উপকারে নিয়োজিত করেছেন এবং তারকারাজিও তারই নির্দেশমত কর্মে নিয়োজিত। নিশ্চয় তাতে জ্ঞানীদের জন্য বহু নিদর্শন রয়েছে।’(সুরা ইব্রাহিম : ৩৩-৩৪) অর্থাৎ রাতকে দিনে রূপান্তর করেছেন এবং দিনকে রাতে রূপান্তরিত করেন। যাতে একটি সময় নষ্ট হয়ে গেলে অন্য সময় এর প্রতিকার করা যায়।
সময়ের গুরুত্বারপে অনেক সুরার প্রারম্ভে সময়ের কসম করা হয়েছে। রাত্রি ও দিনের কসম করে বলেন: ‘শপথ রাত্রির যখন তা আচ্ছন্ন করে। শপথ দিনের যখন তা উদ্ভাসিত করে।’(সুরা আল-লাইল :১-২) এখানে রাত ও দিনের কসমে বান্দাদেরকে কল্যাণের চিন্তা ও গবেষণা করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। ফজর ও দশ রাতের কসম করে বলেন: ‘শপথ ফজরের! শপথ দশ রাতের।’ (সুরা আল-ফাজর : ১-২) অপর আয়াতে বলেন : ‘শপথ সকালও পূবাহেৃর! শপথ রাত্রির যখন তা গভীর হয়।’(সুরা দ্বোহা :১-২) সময়ের কসম করে বলেন: ‘সময়ের শপথ!নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমর্জিত।’(সুরা আসর :১-২)
প্রসিদ্ধ তাফসিরবিদদের মতে আল্লাহ যখন তার সৃষ্ট জীবের প্রতি শপথ করেন উদ্দেশ্য মানুষকে সেই বিষয়ে স্ববিশেষ গুরুত্বারোপ করা। এখানে মানুষের দৃষ্টিকে সময়ের দিকে ফিরানো এবং মহান আল্লাহর কল্যাণমূলক কাজ ও নিদর্শনের প্রতি সতর্কতা আরোপ করাই উদ্দেশ্য।
অধিকাংশ তাফসীরবিদ বলেন, মানুষের সব কর্ম, গতিবিধি, উঠাবসা ইত্যাদি সব যুগের মধ্যে সংঘটিত হয়। সূরায় যেসব কর্মের নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেগুলোও এই যুগ-কালেরই দিবা-রাত্রিতে সংঘটিত হবে। এরই প্রেক্ষিতে যুগের শপথ করে সে দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। (সাদী, ইবন কাসীর)।
ইসলাম প্রতিটি কাজের একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে। নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ছাড়াও অধিকাংশ বিষয়সমূহ সময়ের মালায় গাঁথা। আল্লাহ বলেন: নিশ্চয় নামাজ মুসলমানদের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফরজ করা হয়েছে। (সূরা নিসা : ১০৩)। এখানে নির্দিষ্ট সময় নির্দিষ্ট সালাত আদায়ের তাকিদ দিয়ে সময়ের গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে। তেমনি ভাবে ইসলামের প্রতিটি কাজ সময় মতো পালন করতে হবে। অন্যথায় তা যথাযথ ভাবে আদায় হবে না।
রাসুল (সা:) বলেছেন: কিয়ামত দিবসে আল্লাহর সামনে মানুষকে সময় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। হাশরের কঠিন দিবসে মৌলিক চারটি বিষয়ে মানুষকে প্রশ্ন করা হবে। বিশেষ করে সময় সম্পর্কে প্রধান দুটি প্রশ্ন করা হবে। যা মা‘আয ইবন জাবাল (রা:) রাসূল (সা:) হতে বর্ণনা করেন, ‘চারটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হওয়া পর্যন্ত কোনো বান্দার পদ যুগল কিয়ামতের দিন এক বিন্দু পরিমাণ নড়তে পারবে না। যার প্রথম প্রশ্নটি করা হবে তার জীবন সম্পর্কে। সে তার জীবন কীভাবে ব্যয় করেছে? দ্বিতীয় প্রশ্ন তার যৌবন সম্পর্কে। তার যৌবন সে কী কাজে ব্যয় করেছে? (তিবরানী ও বাজ্জার)
এমনিভাবে সবাই সাধারণ জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। বিশেষ করে তার যৌবনকাল সম্পর্কে। আর যৌবন জীবনের একটি নিদিষ্ট অংশ। কিন্তু যৌবনকালে মানুষ বেশি কর্মশক্তির অধিকারি হয়ে থাকে। শৈশব ও বার্ধক্য জীবনে এ দুটি সময় দূর্বলতায় কাটে ।
প্রবাদে বলা হয় ‘সময় স্বর্ণের চেয়েও মূল্যবান।’ প্রকৃত পক্ষে সময় এর চেয়েও মূল্যবান। যেমন শহীদ হাসান আল-বান্না বলেন: ‘এটাই জীবন! জীবন মানে এটা নয় যে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময় ব্যয় করা।’ এমনিভাবে হাসান বসরি রহ. বলেন : হে আদম সন্তান, নিশ্চয় তুমি অনেকগুলো দিন পেয়েছো আর প্রত্যেক দিনের পর দিন অতিবাহিত হয়ে চলে গিয়েছে।’
সময় নিয়ে আপসোস বিষয়ে কুরআন দুটি অবস্থানের কথা বর্ণনা করেছে। প্রথম অবস্থান : জীবনের অন্তিম মুহূর্ত। তখন সে আফসোস করবে, যদি তাকে একটুখানি সময় দেওয়া হতো। যদি একটু সুযোগ দেওয়া হতো তবে সে তার বিনষ্ট অবস্থা ঠিক করে নিত এবং ছুটে যাওয়া আমলগুলো সংশোধন করে নিতে পারত।
এই বিষয়ে কুরআনে বলা হয়েছে :‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ঐশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণে উদাসিন না করে। যারা উদাসিন হবে তারাইতো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমি তোমাদের যে রিযিক দিয়েছি তোমরা তা হতে ব্যয় করবে তোমাদের কারো মৃত্যু আসার পূর্বে ; অন্যথায় সে বলবে, হে আমার রাব্ব! আমাকে আরো কিছু কালের জন্য অবকাশ দিলে আমি সাদাকাহ করতাম এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভূক্ত হতাম।’ (সুরা আল-মুনাফিকুন : ৯-১০)। অবশ্য এ আশা পরিবর্তনযোগ্য ও কর্তনকারী কেউ নেই।
দ্বিতীয় অবস্থান : আখিরাতের মুহূর্ত। আল্লাহ বলেন: ‘সেখানে তারা আর্তনাদ করে বলবে, হে আমাদের রাব্ব! আমাদেরকে নিস্কৃতি দিন, আমরা সৎ কাজ করব, পূর্বে যা করতাম তা করব না। আল্লাহ বলবেন, আমি কি তোমাদেরকে এতো দীর্ঘ জীবন দান করিনি? যে, তখন কেহ সতর্ক হতে চাইলে সতর্ক হতে পারতে? তোমাদের নিকটতো সতর্ককারীরাও এসেছিলো। সুতরাং শাস্তি আস্বাদন করো, যালিমদের কোনো সাহায্যকারী নেই।’ (সুরা আল-ফাতির : ৩৭)
সুতরাং মুসলমানের উচিৎ সময়ের প্রতি কর্তব্যনিষ্টা ও দায়িত্ববান হওয়া। যেহেতু সময় তার পার্থিব ও ধর্মীয় জীবনে উপকার করে থাকে। আর সময় তার জাতির জন্য মঙ্গল ও সৌভাগ্য বয়ে নিয়ে আসে। আর সময়ই তার বৈষয়িক ও আধ্যাত্বিক উন্নতি সাধন করে থাকে।
ওমর ইবন আবদুল আজিজ বলেছেন: রাত-দিন তোমরা কাজে ডুবে থাক অতএব সময়ও তোমাদের মাঝে ডুবে থাকবে! মূলত ঘৃণার আলামত হলো সময় নষ্ট করা। আর সময় হলো একটি তলোয়ার তুমি তাকে নষ্ট না করলে সেও তোমাকে নষ্ট করবে না। সর্বদায় এক ভালো অবস্থা থেকে আরো উন্নত অবস্থানের জন্য প্রাণান্তকর উন্নতির চেষ্টা করা মুমিনের উপর ওয়াজিব। যাতে আজকের দিনটি গতকালের চেয়ে ভালোভাবে অতিবাহিত হয়। আগামীকাল আজকের চেয়ে আরো ভালো হয়। তিনি তাদের আরো বলেন: যার গতকালের চেয়ে আজকের দিনটি সুন্দরভাবে কেটেছে তিনি খুবই ভাগ্যবান। আর যার খারাপ কেটেছে তিনি হলেন অভিশপ্ত ব্যক্তি! (আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী, মুসলিম জীবনে সময়, পৃ.২০)।
আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা:)বলেন : ‘সে দিন আমি অত্যন্ত লজ্জিত হয়েছি, যে দিনের সূর্য ডুবে গেছে। আমার আয়ু কিছুটা হলেও ফুরিয়ে গেছে, অথচ আমার আমলের কোনো উন্নতি হয়নি!’
পরিশেষে মহান রবের কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেনো মুসলিমদের যথাযথভাবে সময় কাজে লাগানোর তৌফিক দান করেন। দ্বীন ও ইসলামকে বুঝতে সময়ের সদ্ব্যবহার অন্তরে সজিবতা দান করেন। সময়কে মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার বানিয়ে দেন। যেন অলসতার অসুখ থেকে বাঁচতে পারি। নেক আমল করে জান্নাতী হতে পারি। আমিন ।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইসলামি গবেষক