যেকোনো সময় চীন-ভারত যুদ্ধ!
যেকোনো সময় চীন-ভারত যুদ্ধ! - ছবি : সংগৃহীত
ভারত ও চীনের মধ্যে তাদের বিরোধপূর্ণ পার্বত্য সীমান্ত নিয়ে অচলাবস্থায় দীর্ঘায়িত হতে থাকায় বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন যে পরমাণু শক্তিধর এই দুই দেশ অনিচ্ছাকৃত যুদ্ধে নিয়োজিত হয়ে যেতে পারে।
দুই দেশ ৪৫ বছর ধরে নানা ধরনের লিখিত ও অলিখিত সমঝোতার মাধ্যমে অস্বস্তিকর যুদ্ধবিরতি বজায় রেখে চলেছিল। কিন্তু গত কয়েক মাসে পরিস্থিতি অনিশ্চয়তাপূর্ণ হয়ে গেছে। ফলে কোনো এক পক্ষের ভুল হিসাবের ফলে মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে, যা এই ঠাণ্ডা-নির্জন এলাকার অনেক দূরেও প্রতিধ্বনিত হতে পারে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীল নর্দার্ন কমান্ডের (২০১৪-১৬) সাবেক প্রধান লে. জেনারেল ডি এস হুদা বলেন, এই পরিস্থিতি বিপজ্জনক, তা হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। অনেক কিছুই নির্ভর করছে উত্তপ্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে দুই পক্ষ সক্ষম কিনা এবং তা অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো যায় কিনা তার ওপর।
এশিয়ার এই দুই জায়ান্ট বেশ কয়েক রাউন্ড আলোচনা করেছে, বিশেষ করে সামরিক কমান্ডারদের মধ্যে, কিন্তু ফল আসেনি। এখন আলোচনা সম্ভবত রাজনৈতিক পর্যায়ে চলে গেছে। এই প্রেক্ষাপটে শুক্রবার রাশিয়ার রাজধানীতে দুই দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা আলোচনায় বসেছিলেন। চার মাস আগে লাদাখ অঞ্চলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার পর এটিই ছিল তাদের মধ্যে প্রথম উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগ।
গত সপ্তাহে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দুই দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে নতুন করে প্ররোচনা চালানোর অভিযোগ আনে। এমনকি তাদের সৈন্যরা সীমান্ত অতিক্রম করেছিল বলেও অভিযোগ আনা হয়।
ভারত বলে, গত সপ্তাহে চনিা সামরিক বাহিনী দুবার উস্কানিমূলক অভিযান চালিয়েছিল, তবে তারা তা ভণ্ডুল করে দিয়েছে। চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অভিযোগ করে, ভারতীয় সৈন্যরা প্রতিষ্ঠিত নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে সীমান্তে উস্কানিমূলক তৎপরতা চালিয়েছে।
গত মে মাসে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এরপর জুনে তারা লাঠি, পাথর ও হাতাহাতি লড়াইয়ে মেতে ওঠে। এতে ভারতের ২০ জন সৈন্য নিহত হয়, আহত হয় আরো অনেকে। চীন কোনো হতাহতের কথা জানায়নি।
হুদা বলেন, তার মনে হয় না যে দুই পক্ষের কেউ পূর্ণ মাত্রায় যুদ্ধ চায় বা বিদ্যমান সমঝোতা ও প্রোটোকলগুলো পুরোপুরি ভেঙে যাক।
বেইজিংয়ের পিকিং ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ওয়াঙ লিয়ান বলেন, উন্মুক্ত যুদ্ধের আশঙ্কা নেই। কারণ উভয় পক্ষই সাম্প্রতিক মোকাবেলায় সংযম প্রদর্শন করেছে। তবে তিনি আরো বলেন, দেশে চীনবিরাধী ভাবাবেগে চাপের মুখে আছে নয়া দিল্লি। আর বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোরতর মার্কিন পদক্ষেপের ফলে ভারত আরো সাহসী হয়েছে।
তিনি বলেন, আমার মনে হয় না যে দুই দেশ আরো বড় মাত্রায় সামরিক সঙ্ঘাতে যাবে। তবে আমার মনে হচ্ছে, দুই দেশ কিছু প্রস্তুতি নিচ্ছে।
দুই দেশের মধ্যে লাদাখ থেকে সিকিম পর্যন্ত ৩,৫০০ কিলোমিটার (২,১৭৫ মাইল) সীমান্ত রয়েছে। এই সীমান্ত লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল নামে পরিচিত।
দুই দেশ ১৯৬২ সালে যুদ্ধে নিয়োজিত হয়েছিল। এর পর থেকে তাদের মধ্যে সাময়িক যুদ্ধবিরতি চলছিল। দুই দেশের মধ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহার না করার সমঝোতাও রয়েছে।
তবে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক রাহুল বেদি বলেন, জুনের প্রাণঘাতী সঙ্ঘাতের পর সীমান্তে সম্পৃক্ত হওয়ার আইন পরিবর্তন করেছে ভারত। স্থানীয় কমান্ডারদেরকে চীনা সৈন্যদের যেকোনো ধরনের বৈরী তৎপরতার বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত ও আনুপাতিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার স্বাধীনতা তাদের দেয়া হয়েছে।
ভারতের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক, অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলসহ কৌশলগত সম্প্রদায়েল সদস্যরা বলছেন, চীনা সেনাবাহিনী নতুন নতুন ফ্রন্ট খুলছে। এর ফলে অবিশ্বাস বাড়ছে, প্রত্যাহার বিলম্বিত হচ্ছে।
ভারতের সামরিক বাহিনীর আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো চীনের মিত্র পাকিস্তানের সাথে থাকা কাশ্মির বিরোধ। ভারতের সামরিক নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, চীন ও ভারতের মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হলে বেইজিংয়ের প্রতি ইসলামাবাদ সমর্থন ব্যক্ত করবে। এর ফলে পরিস্থিতি নয়া দিল্লির জন্য আরো কঠিন হয়ে পড়বে।
কাশ্মির ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত। আর এর প্রান্তভাবে থাকা লাদাকে চীনের সাথে সীমান্ত রয়েছে ভারত ও পাকিস্তানের। অর্থাৎ লাদাকে তিন পরমাণু শক্তির মিলন রয়েছে।
ভারতের চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল বিপিন রাওয়াত গত সপ্তাহে চীনের সাথে থাকা সঙ্কটের সুযোগ গ্রহণ না করতে পাকিস্তানকে হুঁশিয়ার করে দেন।
তিনি বলেন, পাকিস্তান চীনের কাছ থেকে উত্তর সীমান্তে যেকোনো হুমকি থেকে ফায়দা হাসিল করতে পারে পাকিস্তান, তারা আমাদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তিনি বলেন, এ ধরনের অপপ্রয়াস চালালে তাদেরকে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
ভারত ২০১৯ সালের আগস্টে লাদাখকে কাশ্মির থেকে আলাদা করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করে। এর ফলেই চীনের সাথে সীমান্ত বিরোধ ত্বরান্বিত হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ও চীনা বিশেষজ্ঞ প্রবীন সাওয়ানি বলেন, আমরা খুবই কঠিন অধ্যায়ে প্রবেশ করছি। যুদ্ধ এড়ানোর জন্য সৈন্য প্রত্যাহার খুবই দরকারি বিষয়। দুই দেশের কেউ যুদ্ধ চায় না। কিন্তু যুদ্ধ যদি শুরুই হেয় যায়, তবে পাকিস্তানিরা তাতে ঢুকে পড়বে, কাশ্মিরিরাও তা করতে চাইবে। তা হবে তিন ফ্রন্টের যুদ্ধ।
সূত্র : এপি/এসএএম