পাকিস্তানকে কতটা চাপ দিতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র?
ট্রাম্প ও ইমরান খান - ছবি : সংগৃহীত
আফগানিস্তানে রাজনৈতিক নিষ্পত্তি ও যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে দীর্ঘ যুদ্ধটির অবসানের লক্ষ্যে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহতভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। তাই বলে এই সহযোগিতা পাক-মার্কিন সম্পর্কটি মৌলিক কোনো পরিবর্তনের পথে অগ্রসর হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে না। চীনকে সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্র তার কৌশলগত মিত্র-চক্রে এখনো পাকিস্তানকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি।
এর একটি কারণ চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা, যা যুক্তরাষ্ট্রের চীন-বিরোধী বৈশ্বিক জোটের সঙ্গে খাপ খায় না। তবে মৌলিক কারণটি হলো মার্কিন শাসক মহলের অপরিবর্তনীয় মনোভাব। তারা সবসময় পাকিস্তানকে দক্ষিণ এশিয়ায় ‘সন্ত্রাসের মদতদাতা’ হিসেবে দেখে এসেছে।
আর সে কারণেই আফগানিস্তানে অত্যন্ত গঠনমূলক ভূমিকা পালন করার পরও মার্কিনীদের কাছ থেকে এফএটিএফে তেমন অর্থবহ সমর্থন পায়নি পাকিস্তান। তারা প্রধান আফগান আলোচক আব্দুল গনি বারদারসহ কয়েক ডজন গুরুত্বপূর্ণ তালেবান নেতার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। অথচ এই বারদারের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা করছে। বারদারকে নিষিদ্ধ করেও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কোন সহায়তা পাকিস্তান পায়নি। আর এটাই বলে দিচ্ছে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কতটা ফারাক।
অনেক বিশ্লেষক বলতে চাচ্ছেন দ্রুত আন্ত:আফগান আলোচনা শুরুর জন্য তালেবানের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পাকিস্তানের কৌশল এটা। কিন্তু তালেবান কিন্তু ওই প্রক্রিয়া থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন নয়। যেখানে আটকে আছে, যা আমি আগেও এই কলামে বলেছি, সেটা হলো তালেবান কমান্ডারদের মুক্তি দিতে কাবুলের অনীহা, যাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
তালেবান নেতাদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে পাকিস্তানের সিদ্ধান্ত দেখে মনে হয় তারা যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসবাদের মদতদাতা’ অভিযোগটিই বারবার মেনে নিচ্ছে। এমন কি মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক সর্বশেষ কান্ট্রি রিপোর্টেও একই কাহিনী দেখা যায়। রিপোর্টে বলা হয়েছে:
“সন্ত্রাসী তহবিল বন্ধ ও ভারতীয় রাজ্য জম্মু-কাশ্মীরে ফেব্রুয়ারিতে যে বড় আকারের হামলা চালানো হয় তার সঙ্গে জড়িত পাকিস্তানভিত্তিক জয়সে মোহাম্মদের (জেইএম) মতো ভারত-কেন্দ্রিক জঙ্গি গ্রুপগুলোকে সংযত রাখার ক্ষেত্রে পাকিস্তান ২০১৯ সালে মাঝারি গোছের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।”
আফগান শান্তি প্রক্রিয়ায় পাকিস্তানের কিছু ইতিবাচক অবদানের কথা রিপোর্টে বলা হলেও তাতে আরো বলা হয় :
“তবে, পাকিস্তান এখনো অন্যান্য অঞ্চলভিত্তিক সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে রয়ে গেছে। তারা যেসব গ্রুপকে প্রশয় দিচ্ছে সেগুলোর মধ্যে আফগানিস্তানে হামলা চালানো আফগান তালেবান ও সহযোগি এইচকিউএন, ভারতকে টার্গেটকারী এলইটি ও জেইইম। পাকিস্তান জানা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যেমন জেইএম প্রতিষ্ঠাতা ও জাতিসংঘ ঘোষিত সন্ত্রাসী মাসুদ আজহার এবং ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার ‘প্রজেক্ট ম্যানেজার’ সাজিদ মীরের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। দুই জনেই পাকিস্তানে মুক্ত অবস্থায় আছে বলে মনে করা হয়।”
তবে বাস্তব কথা বলো পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির মনযোগ যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরে গেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে স্বীকার করেছেন যে পাকিস্তানের [অর্থনৈতিক] ভবিষ্যৎ চীনের সঙ্গে মিশে গেছে (যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমাদের সঙ্গে নয়)।
কথিত সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ছিলো পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক সাহায্যের উৎস। আফগান তালেবানকে হারানোর বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সামরিক ও বেসামরিক আদলে এসব সাহায্য এসেছে। কিন্তু দেশটির প্রধানমন্ত্রী এখন দেশের ভবিষ্যৎ চীনের সঙ্গে বাঁধা দেখতে পাচ্ছেন। এতে বুঝা যায়, ক্রমবর্ধমান চীন-মার্কিন শত্রুতায় একটি পক্ষ বেছে নেয়া ছাড়া পাকিস্তানের কোন উপায় নেই।
এই শত্রুতা যদি দ্বি-মেরু ‘নতুন শীতল যুদ্ধে’ রূপ নাও নেয়, এই শত্রুতা এখনো নিজেকে গতানুগতিক দ্বিমেরু রূপে তুলে না ধরলেও তা, যেসব দেশের ঐতিহাসিকভাবে দুই দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রয়েছে, যেমন পাকিস্তানের ‘এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ‘মেল্টিং পট’ হিসেবে উত্থান প্রতিহত করবে। সম্প্রতি এমন মন্তব্য করেছেন দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মুইদ ইউসুফ।
চীনের সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে পাকিস্তান অর্থনৈতিক মেল্টিং পট হতে পারে। তবে পাকিস্তান যতদিন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাধা শক্তি দড়ির উপর দিয়ে হাটার চেষ্টা করবে ততদিন দেশটির এই উচ্চাশা পূরণ হবে না। চীন ও চায়না-পাকিস্তান ইকনমিক করিডোরের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব পুরোপুরি ভিন্ন।
তবে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক শিথিল করার দিকে পাকিস্তান হাঁটবে বলে মনে হয় না, যা যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে। এর মানে হলো যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে পাকিস্তান চাপে থাকবে সেটা সামরিক ও অর্থনৈতিক-দুই তরফেই। সেখানে আফগান পুনর্মিলনে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না।
সূত্র : এসএএম