লেবানন ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি

মো: বজলুর রশীদ | Sep 04, 2020 05:36 pm
লেবানন ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি

লেবানন ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি - প্রতীকী ছবি

 

মধ্যপ্রাচ্যে লেবানন এক কৌশলগত এলাকায় অবস্থান। লেবাননের সরকার সবসময়ই নড়বড়ে অবস্থায় থাকে। খ্রিষ্টান মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভেদ। শিয়া, সুন্নি, ব্যাপটিস্ট, ক্যাথলিক গ্রুপিং। মাঝে মাঝে সরকার কোনো কাজ করতে পারে না। ইসরাইলের সাথে তুলনা করলে বিমানবাহিনীর বিমানগুলো একপ্রকার খেলনা। দেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা প্রচুর, আবার হাজার হাজার উদ্বাস্তুও রয়েছে।

ফিলিস্তিনিরা দলে দলে এখানে আসে; ইরাকিরাও এখানে ভিড় করে; সিরিয়ার লোকজনও শান্তির অন্বেষায় ছুটে আসে। কাজের অভাবে এরা ভিক্ষুকে পরিণত হয়। অভিযোগ আছে, সরকারি কিছু কর্মকর্তা ও এলিট শ্রেণী উদ্বাস্তু সমস্যা থেকে লাভবান হয়েছে, বিদেশী সহায়তার ভালো অংশ পকেটে যায়, সমাজসেবা ও গরিবদের জন্য আর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট থাকে না। এমন নাজুক অবস্থায় হিজবুল্লাহ সমাজসেবার কাজ করছে; এমনকি খাদ্য সহায়তাও তারাই দিচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাও তারাই করছে। এ কাজে তাদের কাছে মুসলিম অমুসলিম কোনো ভেদাভেদ নেই। অনেকে গলার কাঁটা মনে করলেও তাদের ছেড়ে দিচ্ছেন না। হিজবুল্লাহর লক্ষ্য ইসরাইলি আক্রমণ প্রতিহত করা। ইসরাইলের অনেক স্বাদ-আহ্লাদ হিজবুল্লাহর জন্য অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল তাই হিজবুল্লাহর ওপর অসন্তুষ্ট। পশ্চিমাদের সন্ত্রাসী তালিকায় এদের নাম উপরে। হারিরি হত্যার মামলার রায় দেয়ার কথা ৭ আগস্ট ২০২০। বিস্ফোরণ হলো ৪ আগস্ট। এখন রায় ঘোষণা পিছিয়ে গেল। হিজবুল্লাহ ইসরাইলের সাথে লড়াইরত। হিজবুল্লাহকে ‘দৈব অভিশাপ’ বলে গালি দেয় ইসরাইল।

বৈরুত এখন একটি ছেড়া ন্যাকড়ার মতো। ইসরাইল বলেছে, এতে তারা জড়িত নয়। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ৪ আগস্ট মিডিয়া ব্রিফিংয়ে বলেছেন, এটি একটি সন্ত্রাসী আক্রমণ। তিনি আরো বলেন, কিছুই নিশ্চিত নয়। তবে আমরা দেখছি কিভাবে এটি হলো? বিস্ফোরিত পরমাণু বোমার ‘মাশরুম দৃশ্য’ বৈরুতবাসীরা অনেক বছর স্মৃতিতে ধরে রাখবে। নেতানিয়াহু ৩ আগস্ট ২০২০, টুইট বার্তায় লিখেন, ‘লেবাননের বিষয়টি এখনো আকাশে ঝুলে আছে। যারা আমাদের আঘাত করতে চায়, তাদের আমরা অবশ্যই আঘাত করব, এই নীতি সবার জন্য প্রযোজ্য।’

তিনি এর আগে ২০১৮ সালে জাতিসঙ্ঘে বলেছিলেন, ‘ইরান লেবাননে হিজবুল্লøাহকে গোপন আস্তানা বানানোর নির্দেশ দিয়েছে, যেখান থেকে গাইডেড মিসাইল ছোড়া যাবে, যে মিসাইল ইসরাইলের অভ্যন্তরে আঘাত করবে, আক্রমণ হবে নিখুঁত, ১০ মিটারের ভেতর থাকবে।’ ‘হিজবুল্লাহ তিনটি গাইডেড মিসাইল বসিয়েছে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি।’ তিনি একটি ম্যাপ দেখান। এখন যে সাইটটি ভস্মীভূত হয়েছে সে স্থানটি ওই ম্যাপে দেখানো ছিল। হিজবুল্লাহ সাধারণত সব কাজে গ্রামের মানুষকে সাথী করে, সাধারণরা এবার গ্রামসহ উজাড় হলো। নেতানিয়াহু আরো বলেছিলেন, ‘হিজবুল্লাহর প্রতি আমার ম্যাসেজ রয়েছে। আমরা জানি তারা লেবাননে কী করছে।’

ইসরাইলের রাজনৈতিক অবস্থা এখন কড়াইয়ে ফুটন্ত তেলের মতো। ২ আগস্ট কমপক্ষে ৬০ হাজার ইসরাইলি নেতানিয়াহুর বাসভবন ঘেরাও করে দুর্নীতির জন্য তার পদত্যাগ দাবি করে। তারা দাবি করে প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গান্টজ ক্ষমতা গ্রহণ করুক। দুই দিন পর বিস্ফোরণের কারণে সব কিছুই চুপচাপ। অথচ বেনি গান্টজ ৩১ জুলাই বিস্ফোরণের মাত্র চার দিন আগে, ইসরাইলি সেনাবাহিনীকে লেবানন আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এখানে আরো উল্লেখ্য, ৭ জুলাই ইসরাইল ইরানের নাতাঞ্জ পরমাণু কেন্দ্রে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং ১৫ জুলাই ইরানের সাতটি জাহাজ পুড়িয়ে দেয়। এখন এসব আগুন লাগাকে ‘রহস্যময়’ বলা হচ্ছে। তবে ইরান সরাসরি ইসরাইলকে দায়ী করেছে এবং বলেছে তাদের কাছে প্রমাণ রয়েছে। এখন চারদিকেই আগুন আর আগুন। ইরাকের নাজাফে ২০টি গুদামে ৬ আগস্ট আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।

দুবাইয়ের আজমানে ১০০টি দোকানঘর পুড়ে গেছে একই তারিখে। ৫ আগস্ট উত্তর কোরিয়ায় চীন সীমান্তে বড় বিস্ফোরণে কয়েক ব্যক্তি মারা যায়। গান্টজ বলেন, ‘ইরানের প্রত্যকটা বিন্দুর আমারা জবাব দেবো।’
২০০৬ সালে ইসরাইল বেসামরিক ঘরবাড়ি ভেঙে ধূলিসাৎ করে দেয়। বলা হয়, যোদ্ধারা এসব সাধারণ মানুষের ঘরবাড়িতে অবস্থান করে গুলি চালায়। ইসরাইলি সেনারা বৈরুতের দাহিয়ার আশপাশ এলাকা জনশূন্য করে দেয়। নিরীহ জনসাধারণের ওপর ইসরাইলি সেনাদের এমন নির্মম আক্রমণকে দাহিয়া ডকট্রিন বলা হয়। ইসরাইলের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী নাফতালি বেনেট, হারেজ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘যুদ্ধ হলে লেবাননের সব প্রতিষ্ঠান, অবকাঠামো, বিমানবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, ট্রাফিক কেন্দ্র, সেনা বেস সব কিছুতেই ইসরাইলের বোমা ফেলার আইনগত অধিকার জন্মায়।’ ‘যদি হিজবুল্লাহ মিসাইল ছুড়ে তবে আমরা লেবাননকে প্রস্তর যুগে পাঠিয়ে দেবো।’ ইসরাইলিরা মনে করে, তারাই সৃষ্টার মনোনিত মানুষ। পবিত্র ভূমি, মধ্যপ্রাচ্য এমন কি সারা দুনিয়ায় রাজত্ব করার অধিকার একমাত্র তাদেরই।

বৈরুতে যে নাইট্রেট বিস্ফোরিত হয়েছে, সেগুলো ২০১৪ সাল থেকে প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় জাহাজে ছিল, জাহাজের মালিক এক রাশিয়ান ব্যবসায়ী ইগর গ্রিচুসকিনের, তিনি সাইপ্রাসে বসবাস করেন। আশ্চর্যের বিষয়- ছয় বছর আগে মালেদাভিয়া থেকে এই পদার্থ অজানা গন্তব্যে পাঠানো হয়েছিল। এই সূত্রই সবকিছু প্রমাণ করবে যদি সাক্ষী-প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করে দেয়া না হয়।

গ্রিনপিস মনে করে গুদামে রক্ষিত নাইট্রেটের সাথে আর কী কী বিস্ফোরিত হয়েছে; তা কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারছে না। এখন এ বিষাক্ত ডাস্টে আসলে কী কী রয়েছে এবং কিভাবে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি করবে এর জন্য গবেষণা চালানো উচিত। অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বিস্ফোরিত হলে বিষাক্ত গ্যাস নাইট্রোজেন অক্সাইডস অ্যামোনিয়া গ্যাস নির্গত হয়। উভয় গ্যাস মানুষের ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর। এটি সূর্যরশ্মির সাথে মিশে খারাপ ওজন সৃষ্টি করে। তদুপরি করোনাও ফুসফুসে আক্রমণ করে। বৈরুতে বাতাসের মানের ওপর কোনো আপডেট নেই। খরচ কমাতে মনিটোরিং সিস্টেম গত বছর বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তখন লেবাননে গড়ে বাতাসে ফাইন পার্টিকুলেট ম্যাটার ৩০ মাইক্রোগ্রাম ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত হলো প্রতি কিউবিক মিটারে ১০ মাইক্রোগ্রাম। এখন ওই ৩০ মাইক্রোগ্রামের সাথে মিশবে বিস্ফোরিত পর্দাথের বিষাক্ত পার্টিকেল। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেও সময়ের প্রয়োজন। নাজাত সালিভা, বৈরুতের আমেরিকান ভার্সিটির রসায়নের প্রফেসর, তিনি তার নিজস্ব কিছু যন্ত্রপাতি দিয়ে বাতাসের স্যাম্পল নিয়েছেন, তার সেন্সর থেকে ফল আসতে মাসখানেক অপেক্ষা করতে হবে। স্বাস্থ্যের বিপর্যয় কারো জন্য এতদিন অপেক্ষা করবে না। তিনি জানান, পরীক্ষার জন্য আমাদের হাতে এখন কোনো রিসোর্স নেই। বৈরুতের ২০১৫ সালের আবর্জনা সমস্যা সারা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল, সেটি এখনো সুরাহা হয়নি। এই স্তূপ পরিষ্কার করতেই নাকি ১৫ মিলিয়ন ডলার দরকার।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us