ইসরাইলের উত্তপ্ত রাজনীতির মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের সমীকরণ

মো: বজলুর রশীদ | Sep 04, 2020 05:31 pm
লেবানন

লেবানন - প্রতীকী ছবি

 

ইসরাইলের রাজনৈতিক অবস্থা এখন কড়াইয়ে ফুটন্ত তেলের মতো। ২ আগস্ট কমপক্ষে ৬০ হাজার ইসরাইলি নেতানিয়াহুর বাসভবন ঘেরাও করে দুর্নীতির জন্য তার পদত্যাগ দাবি করে। তারা দাবি করে প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গান্টজ ক্ষমতা গ্রহণ করুক। দুই দিন পর বিস্ফোরণের কারণে সব কিছুই চুপচাপ। অথচ বেনি গান্টজ ৩১ জুলাই বিস্ফোরণের মাত্র চার দিন আগে, ইসরাইলি সেনাবাহিনীকে লেবানন আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এখানে আরো উল্লেখ্য, ৭ জুলাই ইসরাইল ইরানের নাতাঞ্জ পরমাণু কেন্দ্রে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং ১৫ জুলাই ইরানের সাতটি জাহাজ পুড়িয়ে দেয়। এখন এসব আগুন লাগাকে ‘রহস্যময়’ বলা হচ্ছে। তবে ইরান সরাসরি ইসরাইলকে দায়ী করেছে এবং বলেছে তাদের কাছে প্রমাণ রয়েছে। এখন চারদিকেই আগুন আর আগুন। ইরাকের নাজাফে ২০টি গুদামে ৬ আগস্ট আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।

দুবাইয়ের আজমানে ১০০টি দোকানঘর পুড়ে গেছে একই তারিখে। ৫ আগস্ট উত্তর কোরিয়ায় চীন সীমান্তে বড় বিস্ফোরণে কয়েক ব্যক্তি মারা যায়। গান্টজ বলেন, ‘ইরানের প্রত্যকটা বিন্দুর আমারা জবাব দেবো।’
২০০৬ সালে ইসরাইল বেসামরিক ঘরবাড়ি ভেঙে ধূলিসাৎ করে দেয়। বলা হয়, যোদ্ধারা এসব সাধারণ মানুষের ঘরবাড়িতে অবস্থান করে গুলি চালায়। ইসরাইলি সেনারা বৈরুতের দাহিয়ার আশপাশ এলাকা জনশূন্য করে দেয়। নিরীহ জনসাধারণের ওপর ইসরাইলি সেনাদের এমন নির্মম আক্রমণকে দাহিয়া ডকট্রিন বলা হয়। ইসরাইলের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী নাফতালি বেনেট, হারেজ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘যুদ্ধ হলে লেবাননের সব প্রতিষ্ঠান, অবকাঠামো, বিমানবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, ট্রাফিক কেন্দ্র, সেনা বেস সব কিছুতেই ইসরাইলের বোমা ফেলার আইনগত অধিকার জন্মায়।’ ‘যদি হিজবুল্লাহ মিসাইল ছুড়ে তবে আমরা লেবাননকে প্রস্তর যুগে পাঠিয়ে দেবো।’ ইসরাইলিরা মনে করে, তারাই সৃষ্টার মনোনিত মানুষ। পবিত্র ভূমি, মধ্যপ্রাচ্য এমন কি সারা দুনিয়ায় রাজত্ব করার অধিকার একমাত্র তাদেরই।

বৈরুতে যে নাইট্রেট বিস্ফোরিত হয়েছে, সেগুলো ২০১৪ সাল থেকে প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় জাহাজে ছিল, জাহাজের মালিক এক রাশিয়ান ব্যবসায়ী ইগর গ্রিচুসকিনের, তিনি সাইপ্রাসে বসবাস করেন। আশ্চর্যের বিষয়- ছয় বছর আগে মালেদাভিয়া থেকে এই পদার্থ অজানা গন্তব্যে পাঠানো হয়েছিল। এই সূত্রই সবকিছু প্রমাণ করবে যদি সাক্ষী-প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করে দেয়া না হয়।

গ্রিনপিস মনে করে গুদামে রক্ষিত নাইট্রেটের সাথে আর কি কি বিস্ফোরিত হয়েছে; তা কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারছে না। এখন এ বিষাক্ত ডাস্টে আসলে কি কি রয়েছে এবং কিভাবে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি করবে এর জন্য গবেষণা চালানো উচিত। অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বিস্ফোরিত হলে বিষাক্ত গ্যাস নাইট্রোজেন অক্সাইডস অ্যামোনিয়া গ্যাস নির্গত হয়। উভয় গ্যাস মানুষের ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর। এটি সূর্যরশ্মির সাথে মিশে খারাপ ওজন সৃষ্টি করে। তদুপরি করোনাও ফুসফুসে আক্রমণ করে। বৈরুতে বাতাসের মানের ওপর কোনো আপডেট নেই। খরচ কমাতে মনিটোরিং সিস্টেম গত বছর বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তখন লেবাননে গড়ে বাতাসে ফাইন পার্টিকুলেট ম্যাটার ৩০ মাইক্রোগ্রাম ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত হলো প্রতি কিউবিক মিটারে ১০ মাইক্রোগ্রাম। এখন ওই ৩০ মাইক্রোগ্রামের সাথে মিশবে বিস্ফোরিত পর্দাথের বিষাক্ত পার্টিকেল। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেও সময়ের প্রয়োজন। নাজাত সালিভা, বৈরুতের আমেরিকান ভার্সিটির রসায়নের প্রফেসর, তিনি তার নিজস্ব কিছু যন্ত্রপাতি দিয়ে বাতাসের স্যাম্পল নিয়েছেন, তার সেন্সর থেকে ফল আসতে মাসখানেক অপেক্ষা করতে হবে। স্বাস্থ্যের বিপর্যয় কারো জন্য এতদিন অপেক্ষা করবে না। তিনি জানান, পরীক্ষার জন্য আমাদের হাতে এখন কোনো রিসোর্স নেই। বৈরুতের ২০১৫ সালের আবর্জনা সমস্যা সারা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল, সেটি এখনো সুরাহা হয়নি। এই স্তূপ পরিষ্কার করতেই নাকি ১৫ মিলিয়ন ডলার দরকার।

ঘটনার পর তুরস্ক, কাতার, বাংলাদেশ, জর্দান ও ইরাক ফিল্ড হাসপাতাল পাঠিয়েছে। ইসরাইলও মানবিক সহায়তা দেয়ার জন্য জাতিসঙ্ঘের কোঅর্ডিনেটর নিকোলাই ম্লাদিনভের মাধ্যমে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামের মাধ্যমে কেমন সহায়তা দেবে তার প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু যে সকালে লেবাননের অবকাঠামো ধ্বংস করতে চেয়েছে, তার কাছে থেকে বিকেলে সহায়তা গ্রহণ নিন্দনীয়। ইসরাইল মানবিক সহায়তা পাঠাবে না-কি মানবিক দুরবস্থার সৃষ্টি করবে সেটি খুব বড় প্রশ্ন বলে মনে করা হয় না। ইসরাইলের মানবতার চেহারা আছে বলে কেউ বিশ্বাস করে না। বৈরুতে তাদের একটি কাজ সেটি হলো ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ করা। তাছাড়া যারা দাহিয়া মতবাদের প্রবক্তা তাদের কাছ থেকে কিভাবে সহায়তা নেয়া যায়!

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যায় ভারাক্রান্ত লেবানন। বিশ্বে নামকরা ২০১৫ সালের গারবেজ ক্রাইসিস এখনো চলমান। চলতি ২০১৯-২০ সালে লেবানিজ পাউন্ড ৮০ শতাংশ ভেল্যু হারিয়েছে। পাবলিক ডেট জিডিপির ১৭০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। করোনাভাইরাস ও লকডাইন অর্থনীতিকে আরো কাবু করে দিয়েছে। লেবাননের এক তৃতীয়াশ মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে। ৩০ শতাংশ বেকার। এর উপর এই বিস্ফোরণ লেবাননের বুকে যেন ছুরি বসিয়েছে। এখন বৈরুত বন্দরকে স্থানীয়রা বলে, ‘আলীবাবা ও চল্লিশ চোরের গুহা’। এই বন্দরে দুর্নীতি, ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া, চোরাই পণ্য চালান, কালোবাজারে বেচা বিক্রি হরদম চলে। সাবেক মন্ত্রী গাজী আরিদি বলেছিলেন, ‘চোরাই পণ্যের জটিল নেটওয়ার্কের বন্দর।’ এখানে সর্বস্তরে অপারেশনে ঘুষের কাজকারবার চলে। মন্ত্রী বলেন, ‘এসব কারণে সরকার ফি বছর এক বিলিয়ন ডলারের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত।’

লেবাননের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিফ হিট্টি ‘লেবানন একটি ব্যর্থরাষ্ট্র’ আখ্যা দিয়ে সরকার পতনের অনেক আগেই পদত্যাগ করেছেন। ইসরাইলি পত্রিকা হারেজ, ৬ আগস্টে লেবানন ব্লাস্টের জন্য ইসরাইলের সমালোচনা করেছে। রিচার্ড সিলভারিস্টিন লিখেন, বৈরুতের বিস্ফোরণের জন্য ইসরাইল দায়ী!

বিস্ফোরণের তদন্ত চলছে। আমরা দেখেছি চারদিকের আগুন শুধু ‘রহস্যময়’। ২০০৫ সালে রফিক হারিরির মৃত্যুর পর রাজনৈতিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। সেটিও রহস্যময়, তদন্তেই ১৫ বছর গেল! লেবাননিরা সিরিয়ার বাশার আল আসাদকে দায়ী করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, হয়তো তদন্তে এটাকে একটি দুর্ঘটনা হিসেবে প্রকাশ করা হবে। ফলে আসলে কারা এমন কাজ করল তা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থেকে যাবে। ভবিষ্যতে আরো বড় ধরনের আঘাত লেবাননে নেমে আসবে। অযোগ্য ও অদক্ষ প্রশাসন যে কত ভয়ঙ্কর তা বৈরুত বন্দর বা চল্লিশ চোরের গুহার বিস্ফোরণ প্রমাণ করে। কোনো দল বা গোষ্ঠী এটি না করলে ধরে নিতে হবে গোটা প্রশাসন বৈরুতকে ধ্বংস করছে। আলীবাবার ‘এটাও এক বড় রহস্য...!’

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us