কেমন হবে ইরান-ইসরাইল সঙ্ঘাত?
কেমন হবে ইরান-ইসরাইল সঙ্ঘাত? - ছবি : সংগৃহীত
জেনারেল কাসেম সুলাইমানিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। বহু মার্কিন সৈন্যকে হত্যা করার জন্য তাকে এবং ইরানকে অভিযুক্ত করার পরই তিনি গুপ্তহত্যার শিকার হন। ইরানকে শায়েস্তা করার জন্য আমেরিকান ও ইসরাইলি বাহিনী মোতায়েন করার পর দ্রুত এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। ইরান সরাসরি সঙ্ঘাতের পরিবর্তে ‘ভয় দেখিয়ে নিবৃত্ত করা বা বাধা প্রদানের নীতি’কে অগ্রাধিকার দেয়। এই নীতি বা কৌশল অনুযায়ী ‘ইরান আক্রান্ত হলে ইসরাইলের ইস্পাত কঠিন বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়ার মাধ্যমে তাদের নৈতিক শক্তিকে দুর্বল করে দিয়ে ইরান বিভিন্ন অবস্থান থেকে ব্যাপকভাবে রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা শুরু করবে। এ ছাড়া তারা বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরকবাহী যানবাহন দিয়ে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করবে এবং তাদের আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীরা শত্রুপক্ষের নিরাপত্তা ব্যুহ ভেদ করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।’
ইরানের এই বাধা প্রদান বা হামলা চালানোর পূর্বাভাস ইসরাইলের জন্য একটি বাস্তব হুমকি। এই কারণেই ইসরাইল পারস্য উপসাগরে জাহাজ বহরে বাধাদানসহ নিজেদের অন্যান্য পরিকল্পনা থেকে সরে আসে। ইরানের কয়েকটি লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা চালিয়ে দেশটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য ইসরাইল একটি ‘স্টিলথ স্ট্রাটেজি’ গ্রহণ করেছে। জানা গেছে, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইল পঞ্চম প্রজন্মের এফ-৩৫ এয়ার সুপিরিয়রিটি’ স্টিলথ ফাইটার এয়ারক্রাফট ব্যবহার করছে। এই এটাকে প্রতিরোধ করার মতো কোনো প্রযুক্তি ইরানের নেই। এতে উল্লেখ করা হয়, ‘দেখে মনে হচ্ছে- ইসরাইল ইরানের পরমাণু এবং ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির বিরুদ্ধে ধীরগতিতে এবং লুকিয়ে লুকিয়ে সামরিক ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে। সম্ভবত তাদের পরিকল্পনায় শিল্প অবকাঠামোসহ বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুও রয়েছে। রহস্যময় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে ইতোমধ্যে ইরানের একটি প্রধান সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদন কেন্দ্র; ক্ষেপণাস্ত্র প্রদর্শনের একটি সামরিক ঘাঁটি এবং একটি বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট, অ্যালুমিনিয়াম ও রাসয়নিক ফ্যাক্টরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পারস্য উপসাগরের বুশেহর বন্দরে অগ্নিকাণ্ডের ফলে সাতটি জাহাজ ধ্বংস হয়ে গেছে।’
একইভাবে, ২০০৬ সালের যুদ্ধে ইসরাইলকে পরাজিত করার কারণে শায়েস্তা করার জন্য হিজবুল্লাহকে টার্গেট করে লেবাননে ব্যাপক বিস্ফোরণ ঘটানো হলো। যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল-আরব ত্রিপক্ষীয় কৌশলগত জোট- যেটাকে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ড’ বলা হয়- তারা ইরানকে একঘরে করার জন্য শিয়া-সুন্নি বিভাজনকে কাজে লাগাচ্ছে। ১৯৭৯ সালে ইরানি বিপ্লবের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র সুন্নি আরব দেশগুলোর সামনে ইরানকে একটি দানবীয় শক্তি ও হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করেছে। সুন্নি আরব দেশগুলো আমেরিকার কাছ থেকে শত শত কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র ও সামরিক হার্ডওয়ার ক্রয় করে আসছে। এখন এই হুমকি আরো বেশি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং বিশেষভাবে ইসরাইলের কাছ থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয় করার বিষয়ও হয়তো জানা যাবে।
ইসরাইল-সংযুক্ত আরব আমিরাত চুক্তি তথা আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে কূটনৈতিক আগ্রাসন চালিয়ে দীর্ঘদিনের আরব ঐক্যকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়া হয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে ২০০২ সালের আরব শান্তি উদ্যোগের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক আক্রমণ চালিয়ে আরব ঐক্যকে পাল্টে দেয়া হয়েছে। চুক্তির মাধ্যমে মিসর ও জর্দান ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু এই স্বীকৃতি দিয়ে তারা এখন প্রতারণার শিকার। প্রকৃতপক্ষে ইসরাইলের চলমান দখলদারিত্ব যেটার মাধ্যমে ইতোমধ্যে দুই রাষ্ট্র নীতির সব আশাকে ধূলিসাৎ করে দেয়া হয়েছে, সেটাই এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। ওমান, বাহরাইন এবং সুদান ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় বেশি আগ্রহী। প্রকৃতপক্ষে, যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল-আরব ত্রিপক্ষীয় কৌশলগত জোট ইরানের বিরুদ্ধে একটি জোটে পরিণত হয়েছে। তারা শান্তি নয়, ইরানের বিরুদ্ধে জোট গঠন করতে চায়।
এ দিকে, ইরানও সময় নষ্ট না করে চীনের সাথে কৌশলগত প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছে। এই অংশীদারিত্ব সমন্বিতভাবে একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূ-রাজনৈতিক ঝড়ের সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার সর্বাধিক চাপের পলিসিকে পাত্তা না দিয়ে চীন একটি আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সফল হয়েছে। এই সময়ে চীনের ‘ইকোনমিক অর্ডার’ একটি অর্থনৈতিক বাধা সৃষ্টি করেছে। এটার মাধ্যমে ইরানসহ অন্য যারা এই ব্যবস্থার অধীনে আসছে তাদেরকে নিরাপত্তা ‘ছাতা’র অধীনে নিয়ে আসা হচ্ছে।
বর্তমানে ইসরাইলের সুপিরিয়র এফ-৩৫ জঙ্গিবিমান এবং যথাযথ গোয়েন্দা ব্যবস্থার কারণে ইসরাইলি হামলার কাছে ইরান অরক্ষিত তথা দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু চীনের সাহায্যে এই হুমকি মোকাবেলায় যথাযথ ব্যবস্থা গড়ে তোলাটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। এটা ইরানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীনের জে-২০ ও পঞ্চম প্রজন্মের স্টিলথ জেট ফাইটার। এটা হয়তো বা আমেরিকান এফ-৩৫ এর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবে;
হয়তো পারবে না। তবে আউটার স্পেস-এ চীন একটি স্যাটেলাইটকে গুলি করে ভূপাতিত করতে সক্ষম। তাদের পক্ষে এফ-৩৫ কে গুলি করে ভূপাতিত করার সক্ষমতা অর্জন করা কঠিন কিছু নয়। আর চীন যখন এই সক্ষমতা অর্জন করবে তখন ইসরাইলের স্টিলথ স্ট্র্যাটেজি মুখ থুবড়ে পড়বে।
যেসব আরব দেশ ইসরাইলের সাথে শান্তি চায় তাদের প্রতি আমাদের শুভেচ্ছা। কিন্তু এটা ফিলিস্তিনিদের রক্তের বিনিময়ে নয়। সত্যের মুহূর্ত শিগগির আসবে যখন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী আমিরাত সফর করবেন এবং সেখানে তাদের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হবে। এই সময় তেলআবিব থেকে একটি বার্তা প্রচার করা হবে, ‘আমাদের যারা শত্রু, মিসর ও কেনানের সব অধিবাসী এবং ব্যাবিলনের অধিবাসীরা আমাদের ভয়ে কাঁদতে থাকবে। যখন আমরা তাদের বুকে বর্শা নিক্ষেপ করব এবং দেখতে পাবো তারা রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে এবং তাদের মাথা কেটে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে তখন আমাদের এই ত্রাসের কারণে তাদের আকাশে বাতাসে ভয়ভীতি ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে।’
লেখক : পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান
দ্য নেশন থেকে ভাষান্তর :
মুহাম্মদ খায়রুল বাশার