তুরস্ক ও ভূমধ্যসাগরীয় স্বার্থ
তুরস্ক ও ভূমধ্যসাগরীয় স্বার্থ - ছবি : সংগৃহীত
এবারের ঘটনার সূত্রপাত ভূমধ্যসাগরের তলদেশের তেল ও গ্যাসের ভাগ নিয়ে। বছরখানেক আগে ভূমধ্য সাগরের উত্তর তীরের দেশ তুরস্ক দক্ষিণ তীরের লিবিয়ায় ত্রিপোলির সরকারের সাথে চুক্তি করেছে সাগরের তলায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য। সম্প্রতি তুরস্ক ভূমধ্যসাগরে তাদের অনুসন্ধান জাহাজ ও সাথে পাহারাদার নৌবাহিনীর জাহাজ নিযুক্ত করেছে। গ্রিস এতে বাগড়া দিয়ে বসেছে। গ্রিসের দাবি, সাগরে তাদের অর্থনৈতিক অঞ্চলে ঢুকে তুরস্ক এ অনুসন্ধান চালাচ্ছে। এরই মধ্যে গত মাসেই ভূমধ্যসাগরীয় আরেকটি দেশ মিসরের সাথে এইরকম চুক্তি করেছে গ্রিস। স্বার্থের সঙ্ঘাত এখন প্রকাশ্য মহড়ায় রূপ নিয়েছে।
গত জুন মাসে লিবিয়াগামী এটি সন্দেহজনক চোরাই অস্ত্রবাহী জাহাজকে ভূমধ্য সাগরে তাড়া করে একটি ফরাসি ফ্রিগেট। সেখানে অবস্থানরত তুরস্কের নৌবাহিনীর জাহাজের সাথে একটা সংঘর্ষ প্রায় ঘটে যাচ্ছিল। তুরস্কের যুদ্ধজাহাজ থেকে তিন তিন বার রাডার বার্তা পাঠিয়ে ফরাসি ফ্রিগেটকে টার্গেট করার হুঁশিয়ারি দেয়া হয়। ফ্রান্স এ ঘটনাকে “চরম আগ্রাসী” বলে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। ফ্রান্স দাবি করেছে, তাদের জাহাজ সেখানে অস্ত্র চোরাচালান রোধের কাজে নিযুক্ত ছিল। “অপারেশন সি গার্ডিয়ান” নামের ন্যাটোর কর্মসূচির আওতায় ইউরোপীয় কমান্ডের অধীনে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে মোতায়েন ছিল ফরাসি ফ্রিগেট করবেট। এ ঘটনার পর পরপরই ফ্রান্স ওই এলাকায় পূর্ব নির্ধারিত ন্যাটোর এটি মহড়ায় তুরস্কের সাথে অংশ না নেবার কথা ঘোষণা করে।
মাসখানেক পর গ্রিক যুদ্ধ জাহজের সাথে তুরস্কের যুদ্ধ জাহাজের আর এটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় ফ্রান্স যুদ্ধ জাহাজ ও যুদ্ধবিমান পাঠায় ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলে গ্রিসের সমর্থনে।
ওদিকে আগষ্টে ভূমধ্য সাগরীয় বন্দর বৈরুতে ভয়াবহ রাসায়নিক বিষ্ফোরণ ঘটে যায়। সে সুযোগে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাকরণ বৈরুতবাসীকে সহানুভূতি দেখানোর নামে সফর করতে গিয়ে বিমান থেকে ভূমধ্যসাগরের সম্ভাব্য যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন করে এসেছেন। মার্কিন প্রশাসন সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে তাদের উপস্থিতি কিছুটা শিথিল করার পর ফ্রান্স সেখানে তার পুরাতন উপনিবেশগুলোর উপর খবরদারি করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়িপ এরদোগান এ কথাই সম্প্রতি স্পষ্ট করে বলেছেন যে, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাকরন এবং আরো কেউ কেউ ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে তাদের পুরনো উপনিবেশিক স্বার্থ চাঙ্গা করতে চায়।
বর্তমানকালে তুরস্ক একটি সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষ দেশ যার কোনো রাষ্ট্রধর্ম নেই। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তুরস্কের ৯৬.৫ শতাংশ লোক ইসলাম ধর্মাবলম্বী ০.৩ শতাংশ খ্রিস্টান ও ৩.২ শতাংশ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী।
এশিয়া ও ইউরোপের সঙ্গগমস্থলে অবস্থিত তুরস্কের বতর্মান প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়িপ এরদোয়ান হলেন দেশের ১২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২০১৪ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত তার দল একে পার্টি পরপর চারবার সংসদীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন রয়েছে।
সম্প্রতি ইস্তানবুলের হায়া সোফিয়া নামের প্রাচীন গির্জাকে পুনর্বার মসজিদে রূপান্তর করে বিশ্বের মুসলিম ও খ্রিস্টান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। তবে এটাকে উসমানিয়া দখলদারিত্ব বলে নিন্দা করেছে মার্কিন মিত্র মিসর।
বাইজেন্টাইন শাসনামলে ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে কনসটানটিপোলে (আজকের ইস্তাম্বুল) নির্মিত হয় রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের চার্চ হাজিয়া সোফিয়া (ল্যাটিন অর্থ-পবিত্র জ্ঞান)। পরে মুসলমানরা কনস্টানটিপোল জয় করলে ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মে পবিত্র জুমার নামাজ আদায় ও খুতবা পাঠের মাধ্যমে উসমানিয়া সুলতান মেহমেদ এটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন।
দীর্ঘ পাঁচ শ’ বছর পরে আধুনিক তুরস্কের জনক বলে পরিচিত মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ১৯৩৪ সালে এটিকে যাদুঘরে পরিণত করেন ।
গত জুন মাসে প্রেসিডেন্ট এরদোগান নিজেই পবিত্র কোরআনের আয়াত পাঠ করে আনুষ্ঠানিকভাবে হায়া সোফিয়াকে পুনরায় মসজিদে রূপান্তর করেন। এ সময় গ্রিসের সমালোচনার জবাবে এরদোগান বলেছেন, উসমানিয়াদের যুগে এথেন্সে নির্মিত কোনো মসজিদের চিহ্ন আজ নেই। সব মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা তেমনটি করিনি।
প্রেসিডেন্ট এরদোগান নিজেকে মুসলিম উম্মার নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। মুসলিম অনুভূতি ব্যবহার করে তুরস্ক মুসলিম বিশ্বের তার মার্যাদা বাড়িয়ে নিচ্ছে বলে সৌদি আরবও চিন্তিত।