কেমন হবে আমেরিকামুক্ত বিশ্ব!
কেমন হবে আমেরিকামুক্ত বিশ্ব! - ছবি : সংগৃহীত
প্রত্যেক রাষ্ট্র ও ভূখণ্ডের অদ্ভুত কিছু রাজনৈতিক রোগ আছে। যেমন, বিরক্তিকরভাবে মিসর সিসির জন্ম দিয়েছে, রাশিয়া পুতিনের, চীন শি’র, ভারত মোদির, ব্রাজিল বোলসোনারোর, মিয়ানমার অং সান সু চির, ইরান খামেনির, সিরিয়া আসাদের। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, সুপারপাওয়ার আমেরিকা এবং তার সাম্রাজ্যবাদী অন্যায়-ঔদ্ধত্যের চোরাগলি তাকে শূন্য গহ্বরে ঠেলে দিচ্ছে।
অবশ্য, আমেরিকা অধ্যায়ের অবসান নিয়ে খোলামেলা আলোচনা ট্রাম্পকে উত্তেজিত করে তুলেছে। ডেভিড এ ম্যাসনের ‘দ্য এ্যান্ড অব দ্য আমেরিকান সেঞ্চুরি’ (২০০৯) এ বিষয়ক বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধের একটি আদর্শ উদাহরণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাথে সূচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বৈশ্বিক আগ্রাসনের বিভিন্ন ধাপ সেই বিশ্লেষণে আমরা দেখতে পাই। তার নিবন্ধে, জর্জ প্যাকার মার্কিন কূটনীতিক রিচার্ড হলব্রুকের জীবনকালকে (১৯৪১-২০১০) ‘মার্কিন সাম্রাজ্যের সোনালি অধ্যায়’ হিসেবে অবহিত করেছেন। এরপর পতনের ঘণ্টা বাজতে শুরু করে। এ দিকে মার্কিন রাজনীতির চতুর সাম্রাজ্যবাদীরা অন্য চিন্তায় ব্যস্ত ছিল তখন। ’৯০ এর দশকের শেষের দিকে, ‘দ্য প্রজেক্ট ফর দ্য নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি’ (পিএনএসি) ছিল ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক একটি সংস্কারবাদী প্রকল্প। তারা মার্কিন নেতৃত্বাধীন নব্য রক্ষণশীল ও নব্য-উদার প্রকল্পগুলোকে নিশ্চিতরূপে বিজয়ী ঘোষণা করেছিল। এটিকে তারা ‘আমেরিকার বিশ্ব-নেতৃত্ব’ বলে প্রচার করেছিল- তাদের ইচ্ছে মতো। উইলিয়াম ক্রিস্টল ও রবার্ট কাগানের নেতৃত্বাধীন পিএনএসির সেই সব লোক তাদেরই বিভ্রান্তির কারণে আজ মানুষের হাসির খোরাক।
তাদের বেশির ভাগ লোক ছিল কট্টর ইহুদিবাদী। তারা ইসরাইলের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে রূপান্তরিত করে দিয়েছিল এবং এটিকেই তারা ‘নতুন আমেরিকান অধ্যায়’ বলে অভিহিত করেছিল। তাদের কুৎসিত মুখোশ খসে পড়ার আগেই তারা জর্জ বুশ ও ডিক চেনিকে অলীক ভবিষ্যদ্বাণীর জোরে আয়ত্তে নিয়েছিল। ফলে তারা ‘মার্কিন নেতৃত্ব’-এর অলীক মিথ প্রচার করে ইরাকের মতো একটি সুন্দর দেশকে অন্যায় আগ্রাসন চালিয়ে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়।
খাঁটি আমেরিকান, মার্টিন কাপলান তার প্রবন্ধে ‘ট্রাম্প অ্যান্ড দ্য এ্যান্ড অব দ্য আমেরিকান সেঞ্চুরি’ (২০১৭) মার্কিন সাম্রাজ্যের পতনে শোক প্রকাশ করেছেন। ট্রাম্পের নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের সবাইকেই যুক্তরাষ্ট্রের অপ্রত্যাশিত ও দুঃখজনক চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে হবে। ঐতিহাসিক, গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে তাদের নেতৃত্ব ত্যাগ করতে হবে। এই কাজ বহির্বিশ্বের সাথে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরের মানুষদেরও করতে হবে।’ তবে বহির্বিশ্বের লোকজন হয়তো ভাবছেন, এটা কখন এবং কিভাবে সম্ভব!
মার্কিন সব শাসকই দেশের ভেতরে ও বাইরে যত অযোগ্যতার আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সেই দীর্ঘ বিভ্রম-ইতিহাসের সমাপ্তিতে শোক প্রকাশ করার মতো কিছু আছে বলে মনে করি না।
আমেরিকান শতাব্দীর পরবর্তী বিশ্ব
মাত্র ২০ বছর আগে, ক্লিনশেভ করা নিউ কনজারভেটিভ গুণ্ডারা ভেবেছিল, তারাই আগামী বিশ্ব শাসন করতে চলেছে। ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের তিন বছর পর, আজ চরম বিপর্যস্ত, জনস্বাস্থ্য খাতের ব্যর্থতা কোটি মানুষকে মারাত্মক মহামারীর দিকে ঠেলে দিয়েছে। আর এ কারণেই রাষ্ট্রের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ছে এবং মানবাধিকারের সাথে তাদের স্বপ্নগুলোও টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। আমেরিকায় গেড়ে বসা বর্ণবাদের মূলোৎপাটনের দাবিতে অনেক বিক্ষোভ হচ্ছে। ওরিগন, সিয়াটল, ওকল্যান্ড, শিকাগো ও নিউ ইয়র্কের সড়কগুলোতে গুয়াতেমালা ও চিলির সামরিক অভ্যুত্থানের দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে। অন্য দিকে ইতর স্বৈরাচারী আমেরিকান বর্ণবাদ আমাদের বিশ্বাস করাচ্ছে যে, এসব অভ্যুত্থান কেবল এশিয়া, আফ্রিকা কিংবা লাতিন আমেরিকাতেই হওয়া সম্ভব! তা ছাড়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের পোস্টাল সিস্টেম ভেঙে দিয়ে প্রহসনের মাধ্যমে আবার নির্বাচিত হওয়ার ফন্দি আঁটছেন। বিশ্বব্যাপী মার্কিন আগ্রাসন, সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুরতা এবং মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি অবজ্ঞাগুলো আজ ষোলকলায় পূর্ণতা পাচ্ছে এবং এসব অন্যায় যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই বুমেরাং হচ্ছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামার অনুসরণ করে ট্রাম্প ও তার রিপাবলিকান অনুসারীরা ভোটারদের দমিয়ে পুনরায় নির্বাচিত হওয়া নিশ্চিত করতে ডাক ব্যবস্থাকে ‘হাঁটু গেড়ে’ বসিয়েছেন এবং যুক্তরাষ্ট্র এক প্রহসনের নির্বাচন করতে যাচ্ছে। যেমনটি অতীতে আমরা মিসর, সিরিয়া ও ইরানে দেখেছি।
বিপরীত প্রক্রিয়া হিসেবে, আমেরিকা-পরবর্তী বিশ্ব খোদ আমেরিকাকেই তার ভণ্ডামি থেকে মুক্ত করবে। মার্কিনিদের তারা আগলে নেবে মানবতার প্রশস্ত বুকে। আমেরিকা কেবল তখনই মুক্তি পাবে, যখন সে তার দীর্ঘ বর্ণবাদের ইতিহাসের সাথে বোঝাপড়া করবে এবং সব বর্ণবাদী প্রতিষ্ঠান ভেঙে দেবে। আজ উপকূল থেকে উপকূলে বিদ্রোহের দাবানল জ্বলছে। বিদ্রোহীরা বলছে, আসল আমেরিকানদের চাপাপড়া স্বপ্নগুলোর পুনরুদ্ধার করা এবং সাম্রাজ্যবাদী অহঙ্কারের দুর্গ মাটিতে মিশিয়ে দেয়াই তাদের লক্ষ্য।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ইরানিয়ান স্টাডিজ ও কম্পারেটিভ লিটারেচারের অধ্যাপক।
‘আলজাজিরা’ থেকে অনুবাদ ইজাজ নাজিম