শ্রিংলার সফর ও ভ্যাকসিন কূটনীতি
শ্রিংলার সফর ও ভ্যাকসিন কূটনীতি - ছবি : সংগৃহীত
ভারতের নবনিযুক্ত পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিশেষ বিমানে ১৮-১৯ আগস্ট সংক্ষিপ্ত ঝটিকা সফরে ঢাকা ঘুরে গেলেন। রহস্য হলো, দিল্লির সাউথব্লক থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তার সফর সম্পর্কে ঢাকাকে কিছুই জানানো হয়নি। ফলে সচিব পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা তাকে স্বাগত জানানোর জন্য কুর্মিটোলায় বিমানবাহিনীর ঘাঁটিতে উপস্থিত ছিলেন না। ঢাকাস্থ ভারতীয় বিদায়ী হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাশ তাকে স্বাগত জানান। সে সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন ছিলেন সিলেটে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ঢাকায় থাকলেও তার সাক্ষাতের কোনো শিডিউল রাখা হয়নি। অথচ সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো: শহিদুল হক, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, একাত্তর টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল হক বাবু, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম ও নৌপরিবহনমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা রাখা হয়। নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে শ্রিংলার সাক্ষাৎ ঘটে। এগুলোর পেছনে কারণ ও রহস্য নিহিত রয়েছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি বিশেষ ‘বার্তা’ তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিবের সাথে সাক্ষাতে কোভিড-১৯ প্রতিষেধক উদ্ভাবন ও বিতরণ, সীমান্ত অপরাধ বন্ধ, কাঁটাতারের বেড়া, রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, মৈত্রী পাইপলাইন, আখাউড়া-আগরতলা, চিলাহাটি-হলদিবাড়ী ও খুলনা-মংলা রেললাইন নির্মাণের অগ্রগতি এবং দুই দেশের মধ্যে বেসরকারি বিমান চলাচল শুরু করার সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সাথে বাংলাদেশের বর্তমান সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ও নিবিড়। জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধিতা থাকলেও ভারতের সাথে বন্ধুত্ব, আস্থা ও সুসম্পর্ক বহাল রাখতে ক্ষমতাসীন সরকার বদ্ধপরিকর। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা এবং এখন দেড় কোটি শরণার্থীর তখন আশ্রয় দেয়াকে বাংলাদেশ সবসময় কৃতজ্ঞতার সাথে বিবেচনায় রেখে এসেছে। মূলত ভারতের চাহিদা মেনে নিয়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ট্রান্সশিপমেন্ট ও কার্গো ট্রেন চলাচলের সুবিধা অবারিত করেছে এ দেশের সরকার। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পারস্পরিক সম্পর্কোন্নয়নে যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা ভারতের চিরদিন মনে রাখা দরকার। ভারতের রাষ্ট্রীয় সংহতি, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও স্ট্র্যাটেজিক বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বরাবরই সংবেদনশীলতার পরিচয় দিয়ে আসছেন। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সক্রিয় থাকা ‘উলফা’র (United Liberation Front of Assam) নেতাদের ভারতের হাতে তুলে দিতে দ্বিধা করেননি। বাংলাদেশে সব ধরনের ভারতীয় বিদ্রোহী ঘাঁটিগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে যেত এর আগে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের (Inter Service Intelligence) ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেয়া হয় এ দেশে। ভারতের সংবিধান থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল এবং সাথে সাথে কাশ্মিরে ক্র্যাকডাউনের ব্যাপারে বাংলাদেশ কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের স্থলে রামমন্দির নির্মাণের ভিত্তি স্থাপন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারিভাবে কোনো মন্তব্য করেনি আজ পর্যন্ত। এগুলোর পেছনে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের চেতনা কার্যকর রয়েছে।
তবে কতিপয় দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বিষয়ে দিল্লির অসহযোগিতা ও শিথিল মনোভাব বাংলাদেশ সরকারের হাইকমান্ডকে উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ করেছে স্বাভাবিকভাবেই। রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারত নিতে জানে বেশি, দিতে জানে কম। সৎপ্রতিবেশীসুলভ সহাবস্থানের জন্য এই নীতি আশাব্যঞ্জক নয়। বারবার আশ্বাস দেয়া সত্ত্বেও সীমান্তে বিএসএফের হাতে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশী হত্যা বন্ধ করা হয়নি। অথচ পাঞ্জাব, কাশ্মির, রাজস্থান ও গুজরাটের ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে বেসামরিক নাগরিক হত্যা নেই বললেই চলে। ভারতের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (NRC) ও নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (CAA) নিয়ে বাংলাদেশ সর্বদা উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। বাংলাদেশসংলগ্ন আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে বংশপরম্পরায় লাখ লাখ বাঙালি বসবাস করে আসছে। তাদের মধ্যে যারা নিজেদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারবে না, তাদেরকে বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’ করা হবে বলে জানানো হয়েছে। তখন মানবিক বিপর্যয় ও সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে। ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর চাপে এমনি বাংলাদেশ বিপর্যস্ত। এর ওপর ভারতীয় শরণার্থীদের আগমন হলে সঙ্কট সামাল দেয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশের থাকবে না। নয়াদিল্লি থেকে বারবার বলা হয়, এতে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই এবং এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেও তার মুখ থেকে এ ব্যাপারে কোনো আশ্বাসবাক্য বের করতে পারেননি। নাগরিকত্ব প্রমাণের সনদে গরমিল থাকায় আসামের অনেক বাংলাভাষী মুসলিম যাদের ক্যাম্পে রাখা হয়েছে, তারা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে পারে, এমন আশঙ্কা রয়েছে বাংলাদেশের। নয়াদিল্লিসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলমানদের জয় শ্রীরাম স্লোগান দিতে বাধ্য করা, মসজিদে অগ্নিসংযোগ ও গো হত্যাকারী সন্দেহে মুসলমানদের পিটিয়ে হত্যা বাংলাদেশের জনগণকে শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। বৃহত্তর জনগণ প্রতিবেশী যে রাষ্ট্রকে তাদের সাম্প্রদায়িক আচরণের কারণে অপছন্দ করে, সে রাষ্ট্রের সাথে সরকারের দহরম মহরম জনগণ স্বাভাবিক কারণেই ভালো চোখে দেখে না। জনবান্ধব কোনো সরকার বৈরী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক বহাল রাখতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাঙালি অভিবাসীদের ‘উইপোকা’ অভিহিত করেছেন। লোকসভায় সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট আইনে সংশোধনী আনতে গিয়ে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশে সংখ্যালঘু যারা ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার, তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভারতের নাগরিকত্ব দেয়া হবে। ওই তিন দেশের মুসলমান ছাড়া হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানরা ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন।
অমিত শাহ লোকসভায় বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’-এর প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। বিজেপি সরকার ভোটের রাজনীতিতে নাগরিকত্ব ইস্যুটিকে ব্যবহার করে। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ শঙ্কিত ও উৎকণ্ঠিত। অনেক চেষ্টা করেও তিস্তা চুক্তি সই করাতে ভারতকে রাজি করাতে পারেনি বাংলাদেশ অথচ তিস্তা বাংলাদেশের জনগণের জন্য জীবন-মরণ সমস্যা। শীতকালে তিস্তা নদী শুকিয়ে যায় আর বর্ষাকালে তিস্তার পানি বিস্তৃত ভূখণ্ডকে প্লাবিত করে। শীত মৌসুমে তিস্তার পানি ধরে রাখার একটি প্রকল্প হাতে নেয়া গেলে বাংলাদেশ বাঁচতে পারে। এ ব্যাপারে কাজ বেশ কিছু দূর এগিয়েছে। তিস্তা নদীভিত্তিক বাঁধ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য চীন ১০০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে চীনে পণ্য পাঠাতে ৯৭ শতাংশ শুল্ক রেয়াত দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে চীন।
এই সুবিধার আওতায় বাংলাদেশের আট হাজার ২৫৬টি পণ্য শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে চীনে। এ সিদ্ধান্তে দেশের ৭০ কোটি ডলারের রফতানি আয় বৃদ্ধি পাবে। চলমান করোনা মহামারীতে সহায়তা দেয়ার জন্য চীন থেকে একটি মেডিক্যাল টিম প্রয়োজনীয় কিটস ও চিকিৎসাসামগ্রীসহ সম্প্রতি ঢাকায় আসে। একটি চীনা কোম্পানি বাংলাদেশে এর ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের দিক থেকে বাংলাদেশের সাথে চীনের এই ঘনিষ্ঠতা ভারতের জন্য নিদারুণ অস্বস্তি তৈরি করেছে। অন্য দিকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীনের পুরনো বন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে টেলিফোনে কথা বলেছেন।
তিনি একসাথে কাজ করা ও সম্পর্কোন্নয়নের ওপর জোর দেন। ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দু জানায়, ‘কাশ্মির বিষয়ে পাক প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চেয়েছেন’। এ দিকে পদ্মা সেতুসহ বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণে চীনের অব্যাহত সহযোগিতা দিল্লি ভালো চোখে দেখছে না। তাই ‘সম্পর্ক ঝালাই করা’র উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার শ্রিংলার ঢাকা সফর।
লাদাখকে কেন্দ্র করে চীনের সাথে ভারতের সশস্ত্র সংঘর্ষ দিল্লির মোদি সরকারকে অপ্রীতিকর অবস্থার মুখোমুখি করেছে। পাকিস্তানের পাশাপাশি নেপালও চীনের প্রভাববলয়ে এসে গেছে। পাকিস্তান ও নেপাল এরই মধ্যে তাদের দেশের সংশোধিত মানচিত্র প্রকাশ করেছে। ভারতের এক প্রতিবেশী মিয়ানমারে রয়েছে চীনের হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রকল্প। সেখানে ইরাবতি নদীর উৎসে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করে বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়া হবে দক্ষিণ চীনের শিল্পাঞ্চলে। মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটে সামরিক ঘাঁটি, বঙ্গোপসাগরের মোহনায় সমুদ্রবন্দর নির্মাণ এবং ওখান থেকে পণ্যসামগ্রী মহাসড়ক ধরে চীনে নিয়ে যাওয়ার গুরুত্ববহ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে। সুতরাং মিয়ানমার চীনের বলয়েই থাকা স্বাভাবিক।
ভারতের করোনা ভ্যাকসিন এখনো দ্বিতীয় স্টেজে। কোভিড-১৯ এর ছোবলে ভারতের অবস্থা একেবারে নাকাল। দেশটাতে প্রতি চারজনে একজন করোনা পজিটিভ। এমন পরিস্থিতিতে বাজার সম্প্রসারণের জন্য ভারতের খুবই প্রয়োজন বাংলাদেশের। এ ব্যাপারে ভারতকে বাংলাদেশের বাজারে একচেটিয়া প্রবেশাধিকার দিতে গেলে ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে। বাস্তবতা হচ্ছে রাশিয়া, আমেরিকা ও ব্রিটেন থেকেও যদি বিনামূল্যে অথবা স্বল্পমূল্যে কার্যকর ভ্যাকসিন পাওয়া যায়, তা নিতে কারো দ্বিধা থাকা উচিত নয়। বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক জন ডি ক্লেমেন্স ও অধ্যাপক ইয়ান হোমগ্রেন অভিমত ব্যক্ত করেছেন, চীনের তৈরি ‘সিনোভ্যাক’ টিকা কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর ও নিরাপদ। এটি এখন ট্রায়ালের তৃতীয় স্টেজে। চীন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এর এক লাখ ১০ হাজার ডোজ তারা বাংলাদেশকে দেবে বিনামূল্যে। জানা গেছে, বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত টিকার জোগান দেবে চীন। সরকার ও জনগণের ক্রয়ক্ষমতা নাগালে রাখা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মধ্যস্থতার মাধ্যমে এর মূল্য নির্ধারণ করা হবে। বাংলাদেশের একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিকে তারা লাইসেন্সের মাধ্যমে টিকা উৎপাদনের প্রযুক্তি হস্তান্তর করবে (প্রথম আলো, ২২ আগস্ট ২০২০)। সাধারণ মানুষ মনে করে, বাংলাদেশের বিপদের দিনে এটা চীনের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছার নিদর্শন।
ভারতের একশ্রেণীর সংবাদপত্র বাংলাদেশ সম্পর্কে অসম্মানজনক ও আপত্তিকর সংবাদ প্রচার করে থাকে সবসময়। গত ২০ জুন কলকাতার বহুল আলোচিত আনন্দবাজার পত্রিকা ‘লাদাখের পর ঢাকাকে পাশে টানছে বেইজিং’ শিরোনামের খবরের প্রথম লাইন ‘বাণিজ্যিক লগ্নি আর খয়রাতি টাকা ছড়িয়ে বাংলাদেশকে পাশে পাওয়ার চেষ্টা নয়াচীনের’। এই প্রতিবেদন ঢাকার সাংবাদিক মহলসহ সবাই প্রত্যাখ্যান করেছে। ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দু জানায়, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশে ভারতীয় প্রকল্পগুলোর গতি শ্লথ হয়ে গেছে। এর বিপরীতে চীনের অবকাঠামো প্রকল্পগুলো অগ্রাধিকার পাচ্ছে। ভারতীয় হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাশ বিগত ছয় মাস ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাতের চেষ্টা করেও শিডিউল পাননি। ভারতের আপত্তি সত্ত্বেও সিলেটে ওসমানী বিমানবন্দরে একটি নতুন টার্মিনাল নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়েছে Beijing Urban Construction Group (BUCG) নামক এক চীনা কোম্পানিকে। ভারত মনে করে, উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার জন্য সিলেটে ওসমানী বিমানবন্দরে নতুন টার্মিনাল নির্মাণ স্পর্শকাতর বিষয়। ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। বিগত ১৫ বছরের মধ্যে এই প্রথম বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে বিপুল পরিমাণ কৃষিপণ্য আমদানি করেছে ((Kallol Bhattacherjee, The Hindu, New Delhi, 25 July, 2020).
‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’- বিদেশনীতির এই থিওরিকে সামনে রেখে বাংলাদেশকে সামনে এগোতে হবে, এটাই জনগণের প্রত্যাশা। কোনো বিশেষ দেশের তল্পিবাহক না হয়ে বা কারো পক্ষপুটে আশ্রয় না নিয়ে সবার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখাই সফলতা। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকদের মতে, মোদি সরকারের ধর্মীয় গোঁড়ামিপূর্ণ ও উগ্র জাতীয়তাবাদী মানসিকতা ও আচরণ প্রতিবেশী দেশগুলোর আস্থায় চিড় ধরিয়েছে। ভারত ও চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্মানজনক ও বন্ধুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বহাল রাখতে হবে। তিস্তাবাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে, ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্পে হাত দেয়া যাবে। তখন বাংলাদেশ মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবে। ব্যাপক দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার মধ্যেও বাংলাদেশের ফরেন রেমিট্যান্স ও প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে এবং মাথাপিছু আয় চার ডিজিটে উন্নীত হয়েছে। পাকিস্তানের পার্লামেন্টে বাংলাদেশকে অনুসরণ করার দাবি উত্থাপন করছেন সংসদ সদস্যরা। বাংলাদেশী এক টাকায় পাকিস্তানি দুই রুপি পাওয়া যায়।
স্মর্তব্য, গত ১৫ আগস্ট বেগম খালেদা জিয়ার জন্মবার্ষিকীতে চীনা দূতাবাস তার বাসভবনে পুষ্পস্তবক ও উপঢৌকন পাঠিয়েছে। আগে কোনো দিন এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। আওয়ামী লীগ বেগম খালেদা জিয়ার জন্মবার্ষিকীর সঠিক তারিখ নিয়ে প্রশ্ন তোলায় এবং তা নিয়ে ব্যাপক হইচই করার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি মরহুম প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ ১৫ আগস্ট জন্মবার্ষিকী পালন না করার জন্য বেগম খালেদা জিয়াকে অনুরোধ করেছিলেন। তখন থেকে ঘটা করে ১৫ আগস্ট জন্মবার্ষিকী পালন করা হয় না। চীনা দূতাবাস এটি জেনেও তাদের দু’জন কর্মকর্তার মাধ্যমে শুভেচ্ছা ও উপঢৌকন পাঠায়। চীন বোঝাতে চাচ্ছে যে, বর্তমান সরকার যদি চীনের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তা হলে তাদের বিকল্প চিন্তা আছে। সুতরাং সরকারকে সতর্কতার সাথে পা ফেলতে হবে। ভারতের বন্ধুত্ব ও চীনের বিনিয়োগ ও অবকাঠামোগত সুবিধা একসাথে চালানো যায় কি না পরখ করে দেখতে হবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ওমর গণি এমইএস ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম