থাই খালে চীন-ভারত নতুন বিরোধ!
প্রস্তাবিত থাই খাল - প্রতীকী ছবি
প্যাসিফিকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার নতুন স্নায়ুযুদ্ধের কথা ভুলে যান। এর চেযে বেশি উত্তপ্ত যুদ্ধ ইতোমধ্যই শুরু হয়ে গেছে ভারত ও চীনের মধ্যে। হিমালয়ের পার্বত্য এলাকায় সীমান্ত বিরোধ নিয়ে ওই লড়াইয়ে ইতোমধ্যে অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছে। সাগরে ভারতকে ঘিরে ফেলার জন্য চীন বেশ কয়েকটি জোট গড়েছে, মুক্তার মালা নামে পরিচিত নৌ ঘাঁটি গড়ে তুলেছে।
ভারত মহাসাগরে (পড়ুন ভারত) প্রাধান্য বিস্তার করার ক্ষেত্রে চীনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো মালাক্কা প্রণালী। সিঙ্গাপুর ও সুমাত্রাকে বিভক্তকারী এই সংকীর্ণ সাগর লেনটি দিয়েই চীনের সমুদ্র বাণিজ্য পরিচালিত হয়, দেশটি দক্ষিণ এশিয়ার দিকে তার নৌবাহিনীকেও পাঠায় এই পথ দিয়ে।ভারতের সাথে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ভূমধ্যসাগর ও এর বাইরের এলাকায় চীনের কৌশলগত উচ্চাভিলাষ পূরণের জন্য সম্ভাব্য বৈরী শক্তিগুলোর মধ্যকার একটি সংকীর্ণ চোকপয়েন্টের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করার জন্য যেকোনো কিছুই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আর এমন প্রেক্ষাপটেই থাইল্যান্ডের ক্রা ইসতমাস খালের কথা আসে। অনেক দিন ধরেই এর কথা আসছে। স্থানটি মালয় উপদ্বীপের সবচেয়ে সরু অংশ। এটি ভারত মহাসাগরে যেতে চীনের জন্য দ্বিতীয় সাগর রুট খুলে দিতে পারে। এখান দিয়ে চীনা নৌবাহিনী দ্রুতগতিতে দক্ষিণ চীন সাগরে নবনির্মিত ঘাঁটিগুলো থেকে ভারত মহাসাগরে যেতে পারবে, তাদেরকে মালয়েশিয়ার দক্ষিণ অংশ দিয়ে ৭০০ মাইল ঘুরতে হবে না। ফলে চীনের জন্য থাইল্যান্ডের এই খালটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সম্পদে পরিণত হতে যাচ্ছে। খালটি খনন করতে চীনকে যদি থাইল্যান্ড ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে দেয়, তবে দেশটি মুক্তার মালাটি গাঁথা চিরদিনের জন্য শেষ করে ফেলতে পারে।
দীর্ঘ দিনের বিতর্কিত খালটি এখন থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক মহলে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। একটি পার্লামেন্টারি কমিটি চলতি মাসে প্রস্তাবটির ব্যাপারে সুপারিশ করতে যাচ্ছে। এমনকি ঐতিহাসিকভাবে সমালোচনামুখী ব্যাংকক পোস্টও খালটির অনুকূলে সম্পাদকীয় লিখেছে। থাইল্যান্ডে চীনা প্রভাবিত প্রকল্পগুলো সম্ভবত জনমত গঠনে সহায়তা করছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নামমাত্র মিত্রতা থাকলেও থাইল্যান্ড এখন প্রবলভাবে চীনের দিকে ঝুঁকছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালে থাই সরকারের দায়িত্ব গ্রহণকারী সামরিক বাহিনকে স্বীকৃতি দিতে যুক্তরাষ্ট্রের অস্বীকৃতির পর তারা বেইজিংমুখী হয়েছে।
ভারতকে ঘিরে ফেলার বেইজিংয়ের পরিকল্পনার সাথে চমৎকারভাবে খাপ খেয়ে যায় থাই খাল। চীনা নৌবাহিনী অব্যাহতভাবে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের দিকে ধেয়ে আসছে, জিবুতিতে একটি পূর্ব আফ্রিকান লজিস্টিকস চালু করেছে, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইরান এবং এমনকি রাশিয়ার নৌবাহিনীগুলোর সাথে যৌথ মহড়া চালাচ্ছে। পুরো অঞ্চলে চীনা-সমর্থনপুষ্ট প্রকল্পগুলোর প্রাচুর্য ঘিরে ফেলার ধারণাটিকেই ব্যাপকতা দিচ্ছে।
সাগরে চীনের মোকাবেলা করার জন্য ভারতও তৈরী হচ্ছে। আগস্টে হিন্দুস্তান টাইমস খবর দিয়েছে, ভারত আন্দামান ও নিকোবর আইল্যান্ডসে তার বিমান ও নৌ ঘাঁটিগুলোকে ব্যাপকভাবে আধুনিকায়নের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। আর এসবের টার্গেট চীন। আন্দামান ও নিকোবরের লোকসংখ্যা ৫ কোটির সামান্য বেশি। কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এই দ্বীপপুঞ্জ ভারত মহাসাগরকে মালাক্কা প্রণালী থেকে আলাদা করেছে। আর এই দ্বীপগুলোই প্রস্তাবিত থাই খালকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার কাজটি করতে সক্ষম হতে পারে।
হাজার বছর না হলেও কয়েক শ’ বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব বাণিজ্য করিডোর হিসেবে কাজ করছে মালাক্কা প্রণালী। ইতালিয়ান অভিযাত্রী মার্কো পোলো ১২৯২ সালে কুবলাই খানের রাজদরবার থেকে দেশে ফিরেছিলেন এই প্রণালী দিয়েই।১৪০০-এর দশকে চীনের মিং রাজবংশের অ্যাডমিরাল ঝেং হি ভারত, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে তার যাত্রা করেছিলেন এই পথ দিয়ে। বর্তমানে এই প্রণালী দিয়ে বছরে ৮০ হাজারের বেশি জাহাজ চলাচল করে। পূর্ব আফ্রিকার সাথে বাণিজ্য যোগাযোগে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ রুট। আধুনিক সিঙ্গাপুরের সমৃদ্ধি এই প্রণালীর দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের সংকীর্ণ কৌশলগত অবস্থানকে ভিত্তি করেই গড়ে ওঠেছে।
রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী থাই সেনাবাহিনীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত থাই ক্যানেল অ্যাসোসিয়েশন বলছে, তারা এটাকে এশিয়ার প্রধান ট্রানজিট পয়েন্ট গড়ে তুলতে চাচ্ছে। এই লক্ষ্যে এখানে গড়ে তোলা সম্ভব শিল্প পার্ক ও লজিস্টিকস। অবশ্য এটা কতটা যৌক্তিক হবে, তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে।
বর্তমান থাই খাল প্রকল্পে, ৯এ রুট নামে পরিচিত, দুটি সমান্তরাল খালের কথা বলা হয়েছে। প্রতিটি হবে ৩০ মিটার গভীর, ১৮০ মিটার প্রশস্ত এবং থাইল্যান্ড উপসাগরের সঙ্গলা থেকে আন্দাবান সাগরের ক্রাবি পর্যন্ত ৭৫ মাইল লম্বা হবে।
অবশ্য, প্রস্তাবিত এই প্রকল্প গ্রহণ করা মানে থাইল্যান্ডের নিজেকে দুই টুকরা করার ঝুঁকি গ্রহণ। থাইল্যান্ড তার সর্বদক্ষিণের তিনটি প্রদেশে সক্রিয় বিদ্রোহের মুখে রয়েছে। এসব প্রদেশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, বেশির ভাগ লোকই জাতিগতভাবে মালয়। খালটি উত্তরে মূল ভূখণ্ড ও দক্ষিণের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের মধ্যকার প্রতীকী সীমান্তে পরিণত হতে পারে। এটি বিদ্রোহ দমনে থাই সামরিক বাহিনীর কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করবে না, তবে কয়েক শ’ বছর স্থায়ী একটি বিভক্তি সৃষ্টি করতে পারে। একবার খাল খনন করা হলে তা ভরাট করা অসম্ভব হয়ে পড়বে এবং যদি কখনো থাইল্যান্ড দুই টুকরা হযে যায়, তবে থাই খালটি এই ভাঙনের জন্য দায়ী হতে পারে।
থাইল্যান্ড এ প্রসঙ্গে পানামার কথা মনে করতে পারে। দেশটি একসময় ছিল কলম্বিয়ার অংশ। ১৯০৩ সালে পানামা লোকজন বিদ্রোহ করলে মার্কিন নৌবাহিনী এগিযে এসে নতুন দেশটির স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। এক বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের ইসতমিয়অন ক্যানেল কমিশন হাজির হয় এবং ১৯১৪ সালে পানামা খালটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। এরপর থেকেই পানামা হয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রিত দেশ। ১৮৬৯ সালে চালু হওয়া সুয়েজ খাল ছিল ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ও ফরাসি সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এটি ছিল ভূরাজনৈতিক ফূটবল। এমনকি মিসর এখনো খালের অপর প্রান্তে থাকা সিনাই উপদ্বীপে ইসলামপন্থীদের বিদ্রোহ মোকাবেলা করে আসছে।
বর্তমানে থাইল্যান্ডের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা তুলনামূলক নিরাপদ। তবে থাই খালটি খনন করা হলে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক ভূগোল নতুন করে নির্ধারিত হবে। এটি চীনকে স্থায়ীভাবে নিরাপত্তা অংশীদারে পরিণত করবে, পানামার মতো থাইল্যান্ডও দেশটিকে সহজে বিদায় করতে পারবে না।কম্বডিয়ার সিহানকুভিল ও মিয়ানমারের কিয়াকফুর বন্দরে পরিকল্পিত বিনিয়োগের মতো চীন থাই খালেও বিনিয়োগ করতে আগ্রহী তার মুক্তার মালাকে গেঁথে ফেলার জন্য।আর থাইল্যান্ডের কোনো বৈরী সরকার যদি কখনো এই মালা কেটে ফেলার হুমকি দেয় হবে, চীনের পক্ষে দক্ষিণের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করা অসুবিধাজনক হবে না। আর এর মাধ্যমে তারা খালটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারবে, নিজের স্বার্থ সুরক্ষিত করার প্রয়োজনকে যৌক্তিক করতে পারবে। এখানও পানামার সৃষ্টির কথাটি এসে যায়।
খাল খননের বিপদের কারণে থাই পরিবহনমন্ত্রী সাকসায়াম চিদচুব সম্প্রতি খালের বদলে রেল ও মহাসড়ক লিঙ্ক প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। আর ওই এলাকার দুই প্রান্তে দুটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা যায় কিনা তাও খতিয়ে দেখছেন। এটিকে স্থল সেতুতে পরিণত করতে চাচ্ছেন তিনি।
থাই খালটি যুক্তরাষ্ট্র, তার মিত্র কিংবা ভারতের জন্যও খুবই কম হুমকি হবে। কারণ ভারত আনায়াসে আন্দামান ও নিকোবর আইল্যান্ডের মাধ্যমে এই হুমকি প্রতিরোধ করতে পারবে। তবে মিয়ানমার ও কম্বডিয়ার মতো গরিব দেশগুলোর স্বাধীনতাকে আরো খর্ব করে ফেলতে পারে চীনা হস্তক্ষেপে। আর তা থাইল্যান্ডের জন্যই বিপদ ডেকে আনতে পারে। মালাক্কা প্রণালী সিঙ্গাপুরের জন্য আশীর্বাদ হয়েছে এর উন্মুক্ত অর্থনীতির জন্য, যা বিদেশী হস্তক্ষেপ থেকে তুলনামূলকভাবে মুক্ত। চীনের জন্য ঝুঁকি নেয়ার আগে থাইল্যান্ডকে বিষয়টি ভেবে দেখা উচিত।
সূত্র : ফরেন পলিসি/সাউথ এশিয়ান মনিটর