সৌদি আরবের দ্বিমুখী সঙ্কট
সৌদি আরবের দ্বিমুখী সঙ্কট - ছবি : সংগৃহীত
সৌদি আরবের ‘ডিপ স্টেট’ হিসেবে পরিচিত রাষ্ট্রের প্রভাবশালী নীতিনির্ধারকদের এক বৈঠকে আলোচনা করে বাদশাহ সালমান ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইস্যুতে ছাড় দেয়া ছাড়া ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা না করার কথা বলেছেন। সৌদি আরবের ঘোষণার পর এর মিত্র দেশগুলোর মধ্যে বাহরাইন, ওমান, মরক্কো ও সুদানের বক্তব্যও পাল্টে যায়। বাদশাহ সালমান ফিলিস্তিন ইস্যুতে সহানুভূতিশীল একজন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তিনি ৮০-এর দশকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে ফিলিস্তিনিদের জন্য সাহায্য তহবিল গঠন করেছিলেন। তিনি ফিলিস্তিন ইস্যুতে ‘বিশ্বাসঘাতকতার তকমা’ নিয়ে মৃত্যুবরণ করতে চান না বলে উল্লেখ করেছেন।
সৌদি আরবের নতুন ঘোষণায় বোঝা যাচ্ছে, বাদশাহ সালমান একটি বিশেষ অবস্থান নিতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু ভূ-রাজনৈতিক যে পরিস্থিতি তাতে কি সৌদি আরব ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকতার দিকে না নিয়ে থাকতে পারবে? এটি করতে গেলে সৌদি আরবকে চীন ও রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। তবে ঐতিহাসিকভাবে পশ্চিমা বলয়ের নিজস্ব রাজ্যটি অন্য শক্তিশালী এবং আরো অনুগত মিত্র খুঁজে পাবে, এমন আশা কম। দেশটির সামরিক সক্ষমতা পশ্চিমা এবং বিশেষভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এর নির্মাতারা এবং প্রশিক্ষণ প্রকল্পগুলোর সাথে আবদ্ধ।
সৌদি আরব চীন থেকে উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র এবং নজরদারি প্রযুক্তি কিনতে পারে; তা সত্ত্বেও চীনা সামরিক যন্ত্রপাতিতে পুরোপুরি পরিবর্তন করা দেশটির জন্য কঠিন হবে। চূড়ান্ত সৌদি অভিভাবক হিসেবে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিস্থাপন করবে এমন আশাও নেই। বছরের শুরুতে তেলের দাম এবং উৎপাদন নিয়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে রিয়াদের বিরোধ একটি উদ্বেগজনক সম্পর্কের সৃষ্টি করেছিল। তদুপরি, রাশিয়ার ইরান সম্পর্কে ইতিবাচক সমর্থন এবং আরব বিশ্বে এর ভূমিকা ইরানকে নিয়ন্ত্রণ করা অথবা এর শাসনব্যবস্থার পতনের জন্য সৌদি আকাক্সক্ষা থেকে অনেক দূরে।
আমিরাতি ক্রাউন প্রিন্স বিন জায়েদ আর সৌদি ক্রাউন প্রিন্স বিন সালমান মিলে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার বিষয়কে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে দু’দেশের মধ্যে যোগাযোগ ও সম্পর্ক চলে আসছে বেশ কিছু দিন ধরে। আর এই প্রক্রিয়া থেকে সৌদি আরব ও মিত্র দেশগুলো বেরিয়ে আসতে পারবে কিনা সেটিই প্রশ্ন। সৌদি আরব ও মিত্র দেশগুলোর শাসন কাঠামো ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্নায়ু যুদ্ধকাল থেকেই তৈরি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য বলয়ে থেকে। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র ছিল সৌদি জ্বালানি নিরাপত্তানির্ভর আর সৌদি আরব ছিল আমেরিকান প্রতিরক্ষা নিরাপত্তানির্ভর। জ্বালানিনির্ভরতা যুক্তরাষ্ট্রের কমলেও রিয়াদ আমেরিকার নিরাপত্তা আশ্রয় থেকে বের হয়ে ভিন্ন কোনো মেরুকরণ তৈরি করতে পারবে, এমনটি দেখা যাচ্ছে না। এটি সম্ভব হতো যদি কয়েক দশক ধরে ইরানের সাথে এবং সম্প্রতি তুরস্কের সাথে যে ব্যবধান রিয়াদের দেখা যাচ্ছে সেটি ঘুচিয়ে একটি সমঝোতার সম্পর্ক গড়া সম্ভব হতো। সেটি হতে দেয়া মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকান কৌশলের বিপরীত।
এই কৌশলের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল দুটি দেশই মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সঙ্ঘাত ও বিরোধকে জিইয়ে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরানের অম্ল মধুর সম্পর্ক যাই থাক না কেন তুরস্ক ন্যাটোভুক্ত এবং আমেরিকান বলয়ের একটি দেশ। ইরান ও সৌদি আরব আদর্শগতভাবে বিপরীতমুখী ধারায় রয়েছে। তিন দেশের মধ্যে ধর্ম ও বিশ্বাসগত মিল রয়েছে। কিন্তু কোনোটিই কার্যকরভাবে ঐক্যের জন্য সক্রিয় বলে মনে হয় না। আর এ ধরনের বৃহত্তর ঐক্য গঠনের জন্য যে ধরনের নেতৃত্ব তিন দেশে প্রয়োজন সেটিও দেখা যায় না। ফলে এই বিরোধ নিষ্পত্তির পরিবর্তে আরো বড় হতে দেখা যাচ্ছে।
একটি ভঙ্গুর ও মেরুকরণকৃত মুসলিম বিশ্বে সৌদি আরব সুন্নি দেশগুলোর ওপর নেতৃত্ব দাবি করতে সক্ষম হবে কিনা, এখন সেই প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন কারণ সৌদি আধিপত্যকে ক্রমবর্ধমানভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। পাকিস্তান থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ক’জন নেতা সালমানের সিংহাসনের উত্তরসূরিকে সম্মান করবেন তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তরুণ সৌদি ক্রাউন প্রিন্স ক্রমবর্ধমানভাবে ষড়যন্ত্র এবং হত্যার সাথে জড়িয়ে পড়েছেন। তার বাবার মৃত্যুর সময় আসতে আসতে তার অবস্থা আরো দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। তখন সুন্নি মুসলিম বিশ্বের ওপর প্রভাবের ক্ষেত্রে সৌদি নেতৃত্ব নিঃসন্দেহে এরদোগানের তুরস্কের সাথে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হবে এবং ধীরে ধীরে সৌদি আরবের প্রভাব হ্রাস পেতে থাকবে।