ইসরাইলকে স্বীকৃতির প্রভাব আরব বিশ্বে
ইসরাইলকে স্বীকৃতির প্রভাব আরব বিশ্বে - ছবি : সংগৃহীত
সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরাইলের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের আনুষ্ঠানিককরণ বা সাধারণীকরণের পরে, অনেক পর্যবেক্ষক মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এবং আরব বিশ্বে এই চুক্তির প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেছিলেন। আরব বসন্ত চলাকালে আরব বিদ্রোহ ও বিপ্লবের পরে যে পাল্টা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তা ‘রাজনৈতিক আরব বিশ্বের’ ভবিষ্যতের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে বলে মনে হয়। আরব দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাহ্যিক হস্তক্ষেপের ফলে, রূপান্তর প্রক্রিয়া প্রায় সব দেশেই ব্যর্থ হয়েছে। সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া এবং ইরাকে রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে পড়ে। আরব আমিরাত এবং সৌদি আরবের নিয়ন্ত্রণে আসা মিসর আঞ্চলিক ইস্যুতে বেশির ভাগ রাজনৈতিক সুবিধা হারায়। রূপান্তর প্রক্রিয়াতে তিউনিসিয়া এখনো একমাত্র দেশ যেটি গণতন্ত্রকে
টিকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম করে চলেছে। আরব বসন্তের প্রভাব নিয়ন্ত্রণে আনতে দুই উপসাগরীয় রাজতন্ত্র জর্দান এবং মরক্কো সফল হয়েছিল। তবে এই দুটি রাষ্ট্রই এখনো বাহ্যিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সুদানে ওমর আল-বশিরের দীর্ঘকালীন কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থাকে আমিরাত ও সৌদি সমর্থিত সামরিক জেনারেলদের দিয়ে পরিবর্তন করা হয়। সব মিলিয়ে, শেষপর্যন্ত আরব বসন্তকে আরব শীতে পরিণত করা হলো।
আরব বিশ্বের এসব পরিবর্তনের সবচেয়ে প্রভাবশালী অভিনেতা হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব। আমিরাত এবং সৌদি আরব হয়তো মনে করে যে, এই অঞ্চলে পরিবর্তনের তরঙ্গ থামানো প্রায় অসম্ভব এবং আরব বিশ্বে গণতান্ত্রিক পরিবর্তন বন্ধের একমাত্র উপায় হলো কর্তৃত্ববাদের এক নতুন গতিবেগ শুরু করা। আর এ জন্য ইসরাইলের সাথে সমঝোতার বিকল্প নেই।
বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের দুটি রাজনৈতিক শিবির হচ্ছে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের শক্তি এবং স্বৈরশাসনের শক্তি। প্রথম শিবিরটি রাজনৈতিক ইসলাম থেকে উদারপন্থী পর্যন্ত বিভিন্ন মতাদর্শের সমন্বয়ে গঠিত, দ্বিতীয় ফ্রন্টটিতে পারিবারিক রাজতন্ত্র বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক একনায়কতন্ত্রগুলো রয়েছে। ইসরাইল এই দুর্বল সংশ্লেষ এবং আরব বিশ্বের বিপর্যয় থেকে লাভবান হয়ে আসছে। ট্রাম্প প্রশাসনের সহায়তায় ইসরাইল ‘আরব হুমকি’ নির্মূল করার জন্য এবং ইসরাইল-ফিলিস্তিন প্রশ্নের সমাধান করতে তাদের ইচ্ছানুযায়ী পদক্ষেপ নেয়। আমিরাত এবং ইসরাইলের মধ্যে সাম্প্রতিক চুক্তি হলো, বর্তমান ইসরাইল ও আমেরিকান সরকার এই অঞ্চলে তাদের অবস্থানকে আরো দৃঢ় করার জন্য গৃহীত সর্বশেষ পদক্ষেপ। কোনো আরব দেশে যাতে কোনো জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন বা রাজনৈতিক অভিনেতা ক্ষমতায় না আসে তা নিশ্চিত করতে এটি নেয়া হয়েছে। অন্য কথায়, এই চুক্তিটি বাহ্যিক শক্তির ওপর আরবনির্ভরতা বাড়ানোর আরেকটি আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ।
চুক্তিটিকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, এটি কেবল ইসরাইলি নিরাপত্তা নয় বরং দেশটির সম্প্রসারণবাদ ও দখলদারিত্বেরও নিশ্চয়তা দেবে।
প্রথমত, এই চুক্তিটির মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত পবিত্র জেরুসালেমের ইসরাইলি কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে। চুক্তিটি আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইলের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দখলকে বৈধ করার পথ প্রশস্ত করেছে।
দ্বিতীয়ত, আমিরাত আরব লিগের নেয়া শান্তি উদ্যোগ তথা দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে লঙ্ঘন করেছে। এতে বলা হয়েছিল, যদি ইসরাইল দখলদারিত্ব শেষ করে ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে মেনে নেয় তবে সব আরব দেশ ইসরাইল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে এবং দেশটির সাথে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে। এই চুক্তির মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত আরব উদ্যোগ এবং ঐক্যকে শেষ করে দিয়েছে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন প্রশ্ন উপেক্ষা করে আমিরাত বিনা মূল্যে ইসরাইলের সাথে তার সম্পর্ককে স্বাভাবিক করেছে। এখন থেকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে আরব ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা বেশ কঠিন হবে, ফিলিস্তিন ইস্যুটিই বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আরব ঐক্যের মূল কারণ ছিল।
তৃতীয়ত, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইসরাইলের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অন্যান্য আরব দেশকে একই পথ অনুসরণ করতে একপর্যায়ে বাধ্য করবে। ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়া হবে; তবে বিনিময়ে কিছুই গ্রহণ করবে না। এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের প্রতি কোনো সমঝোতামূলক পদক্ষেপ নেবে না। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো এবং অন্যান্য বৈশ্বিক শক্তি ইসরাইলের সাথে দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু করার জন্য আরব রাষ্ট্রগুলোকে চাপ দেবে এবং এই চাপকে প্রতিহত করা আরো কঠিন হবে। এছাড়া, এখন থেকে ইসরাইল-ফিলিস্তিন প্রশ্ন আরব সরকার ও ইসরাইলের মধ্যকার স্বাভাবিকতার ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হবে না।