করোনায় স্বাস্থ্য সমস্যা
করোনায় স্বাস্থ্য সমস্যা - ছবি : সংগৃহীত
দৃশ্যকল্প ১
রফিক সাহেব একজন চাকরিজীবী। সাদামাটা ছিমছাম তার জীবন কিন্তু করোনাকালে তার জীবন আর আগের মতো স্বাভাবিক নেই। সারাক্ষণ টেনশন, কী যেন এক চাপা আতঙ্ক। ঘুমের সমস্যা, সব সময় অস্থির লাগে, বুক ধড়ফড় করে। মনের মধ্যে একদম শান্তি নেই।
দৃশ্যকল্প ২
মিসেস আমিনা একজন হোমমেকার। সংসারের খুঁটিনাটি চিন্তা করাই তার অভ্যাস। তিনি একটু পারফেকশনিস্ট এবং ভীষণ খুঁতখুঁতে, কিছুটা শুচিবায়ুর সমস্যা রয়েছে। একরকম ভালোই চলছিল কিন্তু কোভিড শুরু হওয়ার পর তার শুচিবায়ুর সমস্যা বেড়ে যায়। সব সময় মনে হয় এই বুঝি করোনা লেগে গেল তার শরীরে, এই বুঝি শ্বাসের মাধ্যমে করোনা ঢুকল। জিনিসপত্র বাইরে থেকে আনলে অনেক সময় নিয়ে ধৌত করেন কিন্তু তবুও মনে হয় ঠিকমতো পরিষ্কার হলো না।
দৃশ্যকল্প ৩
সিন্থিয়া একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিবিএ পড়ছে। বন্ধুবান্ধব, বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে হাসি আনন্দে দিন কেটে যাচ্ছিল কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তার জীবনে ঘটল ভয়ঙ্কর এক দুর্ঘটনা। হোম কোয়ারেন্টিনের শুরুর দিনগুলোতে খুব মজা হচ্ছিল। বিভিন্ন রান্নার এক্সপেরিমেন্ট করছিল, অনেক দিন জমে থাকা সব মুভি একে একে দেখা শেষ হচ্ছিল। কিছুটা ভয় থাকলেও পরিবারের সবাই মিলে ভালোই দিন কাটছিল। কিন্তু কিভাবে যেন তার বাবা করোনা আক্রান্ত হয়ে যান এবং খুব দ্রুতই তার পরিস্থিতির অবনতি হয়। তখন ঢাকার সব হাসপাতাল পরিপূর্ণ। সিন্থিয়া তার বাবাকে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতাল দৌড়াচ্ছে, কোথাও ভর্তি করাতে পারছে না। তার চোখের সামনে প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে তার বাবা মৃত্যুবরণ করেন। সারা পৃথিবীতে এত বাতাস কিন্তু একফোঁটা বাতাসের জন্য তার বাবার তীব্র হাহাকার তার মনে গভীর এক আতঙ্কের সৃষ্টি করে। কিছু দিন পর থেকেই তার ঘুম নেই, নিয়মিত দুঃস্বপ্ন দেখে। বাবার সেই প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টের ছবি বিমূর্তভাবে তার চিন্তায় বারে বারে হানা দেয় । সব সময় অস্থির লাগে।
দৃশ্যকল্প ৪
সামাদ সাহেব বছরখানেক হলো সরকারি চাকরি থেকে রিটায়ার করেছেন। মে মাসের মাঝামাঝি তিনি করোনা আক্রান্ত হন। বেশ কয়েক সপ্তাহ ভোগার পর করোনামুক্ত হন। কিন্তু করোনা নেগেটিভ হলেও শরীর আগের অবস্থায় ফেরে না। প্রচণ্ড ক্লান্তি, এক অদ্ভুত অবসাদ। কোনো কিছুই করতে ভালো লাগে না, সারাক্ষণ কান্না পায়। মনের মধ্যে চাপা ভয়।
দৃশ্যকল্প ৫
অন্তু নার্সারিতে পড়ুয়া এক শিশু। বেশ দুরন্ত, চঞ্চল হাসিখুশি। তার চঞ্চলতা যেন স্বাভাবিক আট-দশটা শিশুর চেয়ে একটু বেশি। তবু চলে যাচ্ছিল কিন্তু করোনার ঘরবন্দি সময়ে সারাক্ষণ বাসায় বসে থাকতে থাকতে সে যেন কিছুটা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, সারাক্ষণ চিৎকার করে কথা বলে। বাবা-মা কিছু বললেই রেগে যায়। তার এই আচরণে তার বাবা-মা অনেকটাই বিস্মিত।
উপরের চরিত্রগুলো কাল্পনিক হলেও ঘটনাগুলো কিন্তু মোটেই কাল্পনিক নয় বরং এই করোনাকালে আমাদের পরিচিত মানুষের মধ্যে অনেকেই এই সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়েছেন। এই সময় শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি বেশ জোরেশোরে আলোচনায় এসেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও তার নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর যথেষ্ট জোর দিয়েছেন। যদিওবা এই করোনাভাইরাস পৃথিবীর সব মানুষকে এক মানসিক অস্থিরতায় ফেলেছে। তবু কিছু কিছু মানুষ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ যেমন-
হ যাদের আগে থেকেই মানসিক সমস্যা রয়েছে
হ শিশু ও বয়স্ক লোক জন
হ মাদকাসক্ত ব্যক্তি
হ দুর্বল ব্যক্তিত্বের মানুষ যারা সমস্যা মোকাবেলা করতে ভয় পান
হ ফ্রন্টলাইনার্স যেমন চিকিৎসক তথা স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যসহ মাঠপর্যায়ে কাজ করা ব্যক্তিবর্গ
একজন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নির্ধারণ করেন তিনি কিভাবে চিন্তা করবেন, কিভাবে কোন জিনিসকে ব্যাখ্যা করবেন এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিবেন। তাই যে কোনো মানসিক সমস্যা বা কোনো একটি মানসিক রোগ (যেমন দুশ্চিন্তাজনিত রোগ বিষণ্নতা, সিজোফ্রেনিয়া ইত্যাদি) সেই ব্যক্তির চিন্তাভাবনা আবেগ-অনুভূতি সর্বোপরি তার সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করে। যদিও একেকটি মানসিক রোগের একেকরকম উপসর্গ তথাপি এই করোনাকালে অনেকের মাঝেই কিছু কমন সমস্যা দেখা দিচ্ছে যেমন-
ষ অবসাদ
ষ বিষণ্নতা
ষ ভয় দুশ্চিন্তা আতঙ্ক
ষ ঘুমের সমস্যা
ষ মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া
ষ খাবারের রুচির সমস্যা
ষ বুক ধড়ফড় করা, শরীরের ঘাম দেয়া
ষ অস্থির লাগা
ষ আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি এবং সিদ্ধান্তহীনতা
এবার আসা যাক সমাধানের উপায়ে। করোনা চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যের অপরিহার্যতা। সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে গেলে আমাদের অবশ্যই মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে। কিছু পরামর্শ আমরা মেনে চলতে পারি। যেমন-
ষ যেকোনো মানসিক সমস্যায় নিজের মাঝে চেপে রাখা যাবে না। প্রিয়জনের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে, প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
ষ মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে ইতিবাচক বিজ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে। মানসিক রোগ শারীরিক রোগের মতোই চিকিৎসাযোগ্য।
ষ কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাস যেমন পুষ্টিকর খাবার নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং ঘুমের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা
ষ সামাজিক যোগাযোগ বাড়ানো। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখো কিন্তু আমরা চাইলে প্রযুক্তির সহযোগিতায় সামাজিক যোগাযোগ বজায় রাখতে পারি, আমাদের ইচ্ছাই যথেষ্ট।
ষ কটু কথা, সমালোচনা ইত্যাদি ব্যতীত সহযোগিতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবারিক পরিবেশ নিশ্চিত করা
ষ পরিবারের শিশু ও বয়স্ক সদস্যদের প্রতি বাড়তি মনোযোগ দেয়া
ষ স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আত্মিক পরিশুদ্ধি লাভ করা।
করোনা খুব সহসাই চলে যাচ্ছে না। হয়তো আরো অনেক দিন একে সাথে নিয়েই আমাদের চলতে হবে। সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যতœ নিয়ে আল্লাহর কৃপায় নিশ্চয়ই এই সময়টা আমরা পার করতে পারব।
লেখক : মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, রেজিস্ট্রার, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা