করোনা কি তাদের জন্য পৌষ মাস?

করোনা কি তাদের জন্য পৌষ মাস? - ছবি : সংগৃহীত
করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি করে বিশ্বের বাজার ধরতে কয়েকটা দেশের হন্যে হয়ে ওঠা দেখে প্রবাদটি উল্টে দিতে ইচ্ছে হলো। ভ্যাকসিনের প্রথম জোগান দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা এখন প্রতিযোগিতায় পরস্পরের প্রতিস্পর্ধী।
আজ থেকে দুই শ' বছর আগে ১৮২০-র দশকেও ঠিক এমনই ঘটেছিল ম্যালেরিয়ার ওষুধ কুইনাইনকে কেন্দ্র করে। সতেরো-আঠারো শতক থেকে কুইনাইনের উৎস সিঙ্কোনা গাছের বাকল ব্যবহৃত হয়ে আসছিল জ্বর-জারিতে, এলোপাথাড়ি অনুমানের উপর নির্ভর করে। সিঙ্কোনা সম্পর্কে প্রথম বিশদ তথ্য পান ১৮২০-র দশকে দু’জন ফরাসি রসায়নবিদ পিয়ের জোসেফ পেলেতিয়ের ও জোসেফ বিনেম ক্যাভেন্তু-র গবেষণা। সিঙ্কোনা গাছের অনেক প্রকার-ভেদ আছে। ফরাসি রসায়নবিদদের গবেষণায় প্রথম জানা যায় হলুদ, ধূসর ও লাল বাকলে আছে উৎকৃষ্ট অ্যালকালয়েড। উৎকৃষ্টতম সিঙ্কোনা হলো হলুদ বাকল।
আঠারো শতক থেকে অ্যালকালয়েড রসায়নের গবেষণায় ঢুকে পড়েছিল বাজারের চিন্তা। রসায়নবিদ ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ যুক্ত হয়েছিল একবিন্দুতে। পিছিয়ে ছিলেন না ওষুধপ্রস্তুতকারীরাও। তারাই হয়ে ওঠেন গবেষক এবং তাদের দোকানগুলো গবেষণাগার। আমেরিকা ও ইউরোপ জুড়ে শুরু হয়ে যায় কুইনাইন উৎপাদন। সকলের লক্ষ্য, বিশ্ববাজারে প্রথম প্রবেশ করে একচেটিয়া কারবার। ১৮২০-র দশকে প্যারিসের অভিজ্ঞ শারীরবৃত্ত বিশারদ ফ্রাঁসোয়া মাজেন্দি কয়েকখানা বই লিখে একেবারে খোলাখুলি কুইনাইন ব্যবসায় উৎসাহ দিলেন। তার রচিত ফরমুলারি গ্রন্থে তিনি ওষুধনির্মাতাদের উৎসাহ দিলেন এর জন্য। তার বইও ব্যবসা করল কুইনাইনের মতো। অনেকগুলো সংস্করণ। অনূদিত হলো বিভিন্ন ভাষায়।
এমনকি ১৮২৪-এ উত্তর আমেরিকায় বইটি প্রকাশিত হওয়ার আগেই বিখ্যাত সংস্থা ফার অ্যান্ড কুনজ়ি কুইনাইন বিক্রি শুরু করে দিল ১৬ ডলারে এক আউন্স। বেশ দামি। ১৮২৩-এ ফিলাডেলফিয়ার এক কোম্পানি দাবি করে বসল, ব্যবসায়িক ভিত্তিতে তারা সিঙ্কোনার বাকল দিয়ে কুইনাইন প্রস্তুত করে ফেলেছে। মিসৌরির এক চিকিৎসক জন স্যাপিংটন কুইনাইনের বড়ি বিক্রি করতে থাকলেন নিজের নামে। লন্ডনে লুক হাওয়ার্ড, যিনি ছিলেন ওষুধের খুচরো বিক্রেতা, ১৮৩০-এ ফেঁদে ফেললেন একটা কুইনাইনের কারখানা। ওই বছরই রোমেও গড়ে উঠল কুইনাইন প্রস্তুতকারী একটা সংস্থা। এই ভাবে আমেরিকা ও ইউরোপে চিকিৎসক, ওষুধপ্রস্তুতকারী এবং ব্যবসায়ীদের মূলধন বিনিয়োজিত হল কুইনাইন উৎপাদনে।
কুইনাইন ব্যবসার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ ছিল না উইলিয়াম ডওসন লুকারের মতো বিশিষ্ট উদ্ভিদবিজ্ঞানীর। ১৮৩৯-এ তার গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেন ওষুধের কারবারে কুইনাইনের মাধ্যমে অর্থাগমের সম্ভাবনার কথা। তিনি বলেন, কুইনাইন সিঙ্কোনা-বাণিজ্যের সমস্ত অনিশ্চয়তা দূর করেছে। রাসায়নিক পরীক্ষা বলে দিতে পারে কোন সিঙ্কোনায় মূল্যবান অ্যালকালয়েড মজুত আছে। কুইনাইনের ব্যাপক চাহিদার ফলে রীতিমতো ভেজাল কুইনাইনও এসেছিল বাজারে। লুকার বলেন, রাসায়নিক পরীক্ষা যাচাই করবে কুইনাইনের উৎকর্ষের মান। কারণ, ভাল-মন্দ সব সিঙ্কোনাই উৎকৃষ্ট কুইনাইনের উৎস বলে প্রচার করা হতো।
কুইনাইনের চাহিদার রেখাচিত্র ঊর্ধ্বগামী হয় বাজার ও চিকিৎসকদের প্রচারের ফলে। ১৮২০-র দশক থেকে বিদ্বজ্জন এবং বাণিজ্য জগতের মানুষ হাত মিলিয়েছিলেন পরস্পরের সঙ্গে। চিকিৎসক জন স্যাপিংটন, যিনি বিশাল সম্পদের মালিক হয়ে বসেছিলেন কেবল কুইনাইনের বড়ি বিক্রি করে, সেই ব্যবসা ছেলেদের হাতে তুলে দিয়ে শুরু করেন জমির দালালি। পরিত্যাগ করেন চিকিৎসকের পেশা।
লন্ডনের হাওয়ার্ড পরিবারের সদস্যদের প্রজ্ঞা এবং ব্যবসায়িক আকাঙ্ক্ষা ধাবিত হয় এই দিকে। গোটা উনিশ শতক ধরে হাওয়ার্ডরা ছিলেন কুইনাইন ব্যবসার সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষ। লুক হাওয়ার্ড ওষুধ নির্মাতা হলেও তার বিশেষ আগ্রহ ছিল আবহবিদ্যায়। রয়্যাল সোসাইটির ফেলোশিপও পেয়েছিলেন ১৮২১-এ। সব জলাঞ্জলি দিয়ে ১৮২৩-এ তিনি দাবি করে বসলেন, নিম্নমানের সিঙ্কোনা থেকেও তিনি মূল্যবান অ্যালকালয়েড বিযুক্ত করতে পারেন। জন এলিয়ট হাওয়ার্ড বাজার ধরার জন্য কুইনাইনের কারখানা স্থাপন করে প্রচার করেন, তার উৎপাদিত কুইনাইন ইংল্যান্ডে সর্বোৎকৃষ্ট।
কুইনাইন কেবল ম্যালেরিয়া নয়, হয়ে উঠেছিল সর্বরোগ বিনাশকারী ওষুধ। এমন বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল মানুষের মনে যে, কুইনাইন সেবনে আরোগ্য লাভ করা যেতে পারে আমাশা, গলায় ক্ষত, স্নায়ু দুর্বলতা, দাঁতের যন্ত্রণা প্রভৃতি থেকে। মানুষের এই অসহায়তা এবং বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে বিশ্বের নানা দেশ মত্ত হয়ে উঠেছিল যেকোনো ভাবে কুইনাইনের বাজার দখল করতে।
বর্তমান বিশ্বে করোনার আবহে সৃষ্ট পরিস্থিতির সুযোগে বিভিন্ন দেশ যে যথাসম্ভব দ্রুত তাদের ভ্যাকসিন বাজারে ছেড়ে মুনাফা লুটতে বেপরোয়া, সেটা কি তবে ২০০ বছর আগেকার সেই ছবির পুনঃপ্রদর্শন?
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা