চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বে পাকিস্তানের লাভ-ক্ষতি
চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বে পাকিস্তানের লাভ-ক্ষতি - ছবি : সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্র আসলেই চীনকে দূরে ঠেলে দেয় কিনা সেটা এখনো দেখার বিষয়। তবে বিশ্বের দুই শীর্ষ অর্থনীতি আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্তের গুরুতর প্রভাব পড়বে গোটা বিশ্বের উপর। এটা বিশেষ করে এশিয়ার জন্য সত্য হবে। কারণ এখানে চীনের যেমন অবস্থান, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মিত্রও আছে এখানে। আফগানিস্তানে (চীনের কাছাকাছি) এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি। তারা এই উপস্থিতিকে আরো গভীর করতে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক চাঙ্গা করতে চায় যাতে চীন ও রাশিয়া দুই দেশের সঙ্গেই প্রতিযোগিতার পথ তৈরি করা যায়।
পাকিস্তানের মতো যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ের সঙ্গে গভীর অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক রয়েছে এমন দেশগুলোর জন্য এই বিচ্ছিন্নতার মানে হবে এক দুর্লঙ্ঘনীয় কূটনৈতিক বাধা। পররাষ্ট্রনীতিকে আঞ্চলিকীকরণ করা হবে কিনা (আরো গভীরভাবে চীনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে কিনা) অথবা মাইক পম্পেওর ভাষায় ‘চীনা প্রভাব’ ঠেকাতে একটি বৈশ্বিক জোটের অংশ হবে কিনা তা বেছে নিতে হবে।
পাকিস্তানে চীনের উপস্থিতি প্রবল এবং এরই মধ্যে সিপিইসি যে গতি পেয়েছে তাতে পাকিস্তানের পক্ষে দ্বিতীয় বিকল্পটি বেছে নেয়া কথা চিন্তা করা যায় না। আবার আফগানিস্তানের শেষ খেলায় মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ও যুদ্ধ অবসানের জন্য পাকিস্তানের ভূমিকাটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক নৈকট্যকেই তুলে ধরছে। বাস্তবতা হলো, সিপিইসি’র বিনিয়োগ সত্ত্বেও অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার জন্য পাকিস্তান অব্যাহতভাবে আইএমএফের (মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতাপুষ্ট) বেইলআউট প্যাকেজের উপর নির্ভর করছে।
তাই গুরুতর ‘বিচ্ছিন্নতা’ পাকিস্তানের মতো দেশগুলোর জন্য অনিবার্যভাবে স্নায়ুযুদ্ধকালী ভূ-রাজনৈতিক উদ্বেগ ফিরিয়ে আনবে। তখন চ্যালেঞ্জটি হবে সুক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষার। প্রবলভাবে বিভক্ত বিশ্বে এমন ভারসাম্য রক্ষা করা সবময়ই কঠিন।
যদিও পাকিস্তান ও এশিয়ার অন্যান্য দেশ — শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় — চীনা প্রকল্প/চীনের সঙ্গে আরো শক্তভাবে বোঝাপড়া করতে পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশকে পাশে চাইতেই পারে যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু বিচ্ছিন্নতা প্রথমে ও সবার আগে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনা বিনিয়োগ একই সঙ্গে গ্রহণ করা হবে কিনা সেই প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসবে। এবং এর সঙ্গে আসবে বিভিন্ন বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ইস্যুতে কৌশলগত পররাষ্ট্রনীতি পছন্দের প্রশ্নটি।
এশিয়ার বেশিরভাগ দেশে চীন এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে ছায়ার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এরপরও সত্যিকারের বিচ্ছিন্নতা এই সব দেশকেই ঝাঁকুনি দেবে। আবার, যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কোম্পানির উৎপাদন ইউনিট রয়েছে চীনে, তাই বিচ্ছিন্নতার ফলে এসব ইউনিটকে অভিন্ন সাপ্লাই চেইন রক্ষা করে এশিয়ার অন্য কোনা দেশে সরিয়ে নেয়ারও প্রশ্ন উঠবে।
এদের মধ্যে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের মতো কিছু দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ দিনের অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক রয়েছে। এসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ও সাহায্য দুটিই ভোগ করে আসছে। কারখানা স্থানান্তরের ঘটনা ঘটলে এসব দেশ তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাব্য সুযোগটি দ্রুত গ্রহণ করতে পারে, বিশেষ করে চলমান মহামারীর কারণে যে অর্থনৈতিক বিঘ্নতা তৈরি হয়েছে তা থেকে মুক্তি পেতে।
যদিও পুরোপুরি স্থানান্তর সম্পন্ন হতে কয়েক দশক লেগে যাবে এবং পুরোপুরি সম্ভব নাও হতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা হলো এ ধরনের উদ্যোগ আরো বিনিয়োগ নিয়ে আসবে এবং তাতে এসব দেশের অন্তত কয়েকটি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করবে।
এই বিচ্ছিন্নতা ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে এবং এর উত্তেজনা সৃষ্টির বিষয়টি তাইওয়ানের মতো ‘স্পর্শকাতর’ ক্ষেত্রে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
আরিজোনার একটি চিপ প্লান্টে ১২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার কথা ঘোষণা করেছে তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর মেনুফেকচারিং কোম্পানি (টিএসএমসি)। স্যামসাং ও ইনটেলকে পেছনে ফেলে ২০২০ সালে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানিতে পরিণত হয় টিএসসিএম। তাইওয়ানের কোম্পানি মার্কিন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারে, কিন্তু যে উভয়সঙ্কট পাকিস্তানের মতো এশিয়ার বেশ বেশ কিছু দেশের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক সেটা হলো এই পরিস্থিতি অনিবার্যরূপে উত্তেজনা ও ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত তৈরি করবে, এসব দেশকে সরাসরি বন্দুকের নলের মুখে দাঁড় করিয়ে দেবে।
তবে চীনের উত্থান রোধের আকাঙ্ক্ষার কারণে ভারতের মতো এশিয়ার কিছু দেশ এই চীন-মার্কিন বিচ্ছিন্নতার কারণে স্বস্তি বোধ করবে। যেমন, চীন-মার্কিন উত্তেজনা বাড়লে ভারত নিজেকে নিরপেক্ষ ও এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মিত্র হিসেবে দেখানোর সুযোগ পাবে। তখন আমেরিকান কোম্পানিগুলোর সম্ভাব্য পুনঃস্থাপন ক্ষেত্রও হয়ে উঠতে পারে তারা।
ভারতে চীন ও চীনা পণ্য বয়কটের জন্য স্বদেশ জাগরণ মঞ্চের (এসজেএম) মতো আন্দোলন তৈরি হয়েছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হলে তখন এ ধরনের আন্দোলনের পক্ষে চীন থেকে ভারতকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা আরো বেগবান করা সহজ হবে।
তবে এ ধরনের ‘বিচ্ছিন্নতা’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চীনের অবস্থানকে মুছে ফেলবে না। এর বদলে প্রতিযোগিতা বহুগুণ তীব্র হবে, যা বৈশ্বিক দ্বিমেরু অর্থনীতির জন্মও দিতে পারে।
চীনের নিজস্ব প্রতিযোগিরাও এই বিভক্তির মধ্যে সুযোগ দেখতে পারে। তবে যেসব দেশ চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে চায় তাদেরকে বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্য পথ বের করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়তে হবে।
সূত্র : সাউথ এশিয়ান মনিটর