হুয়াওয়ে ও ফাইভ-জি : পার্থক্য যেখানে
হুয়াওয়ে ও ফাইভ-জি - ছবি : সংগ্রহ
হুয়াওয়ে ও ফাইভ-জি : বাংলাদেশে ফোন সার্ভিসে ব্যবহারকারীদের কাছে টু-জি, থ্রি-জি ও ফোর-জি সার্ভিস দেয়া হচ্ছে। তাতে কিছুই ফারাক বোঝা যায় না। কারণ সার্ভিস কোম্পানির সব টাওয়ার থেকেই ফোর-জি উচ্চমানের গতির সার্ভিস দেয়া হচ্ছে এমন কোনো কোম্পানি বাংলাদেশে নেই। এমনকি সব টাওয়ার থ্রি-জি পর্যায়ের কি না সেই নিশ্চয়তাও নেই। কিন্তু যেসব দেশে এসব ধাপ্পাবাজি নেই, যা সার্ভিস দেবে বলে দাবি করে তাই দিতে হয়; এর জন্য তদারকি মনিটরিং ও শাস্তিবিধান আছে সেখানে টু-জি, থ্রি-জি না ফোর-জি কত স্পিডের সার্ভিস তা গুরুত্বপূর্ণ। এই জগতেরই লেটেস্ট টেকনোলজি হলো ফাইভ-জি টেকনোলজি। ফাইভ-জি একেবারেই ব্যতিক্রমী ও আলাদা, ফাইভ-জি ফোন সেটও আলাদা হবে, যা এখনো বাজারে আসেনি। কেন আলাদা? কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের কথা শুনেছেন অনেকে। তারা বুঝবেন আগামী দিনে কারখানা ম্যানুফাকচারিং বা এমনকি রেস্টুরেন্টে খাবার বিতরণ করবে রোবট। দূর থেকে বা নির্দিষ্ট রেঞ্জের মধ্যে বসে দূর থেকে রোবটকে নির্দেশ দিয়ে চালাতে যে হাইস্পিডের মোবাইল টেকনোলজি লাগবে সেটাই ফাইভ-জি পর্যায়ের হতে হবে। আর হুয়াওয়ে হলো ফাইভ-জি টেকনোলজিতে সবার চেয়ে আগে বা পাইওনিয়ার কোম্পানি। এ ক্ষেত্রে টেকনোলজিতে বিনিয়োগ অর্থে আমেরিকা কয়েক বছর পেছনে পড়ে গেছে, কিছু টেক সিদ্ধান্ত সময়মতো নিতে না পারায়। তাই এই খাতে ইউরোপীয় অরিজিনের নোকিয়া, এরিকসন, এলকাটেল কমবেশি থাকলেও আমেরিকান অরিজিন কোনো কোম্পানি এখন প্রতিযোগিতাতেই নেই। এর কারণ হিসেবে আমেরিকাতেই বলা হয়, সেখানকার কোম্পানিগুলোর সবাইকে একই টেকনোলজিকে স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলতে হবে এমন সরকারি বাধ্যবাধকতা বা স্ট্যান্ডার্ড বলে কিছু না রাখা হয়।
এর সুযোগে জিএসএম, সিডিএমএ প্রভৃতির অন্তত পাঁচ ধরনের টেক একই সাথে আমেরিকায় ব্যবহৃত হতো। আমাদের গ্রামীণসহ সবাই এখন এই জিএসএম স্ট্যান্ডার্ড, আমাদের বন্ধ হওয়া সিটিসেল ছিল সিডিএমএ। এতে অসুবিধা হলো, মোবাইল টেকে ক্রমাগত গবেষণা ও উন্নয়নে প্রচুর বিনিয়োগ লাগে। একটা দেশে টেক স্ট্যান্ডার্ডের বালাই না থাকলে পাঁচ ধরনের টেক প্রচলিত থাকা মানে হবে, নতুন গবেষণা ও উন্নয়নে পাঁচগুণ বিনিয়োগ লাগবে। অথচ দেশে একটাই স্ট্যান্ডার্ড থাকলে গবেষণা ও উন্নয়নে ওই একই বিনিয়োগ পাঁচ কোম্পানি শেয়ার করতে পারত। আমেরিকায় পুরো নব্বইয়ের দশক এই স্ট্যান্ডার্ডহীন থাকার সুযোগে বা দুর্যোগে কোম্পানিগুলো কমতে বা ডুবতে থাকে। একপর্যায়ে ইউরোপের নকিয়া বা এরিকসন ধরনের কোম্পানির মধ্যে বিক্রি হয়ে এরা সবাই বিলীন হয়ে যায়। এককথায়, স্ট্যান্ডার্ডের বালাই না থাকাটাই আমেরিকার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর ঠিক এর উল্টোটা করে উঠে আসে হুয়াওয়ে, যে আমেরিকার ওই পিছিয়ে পড়াটাকেই টার্গেট করেছিল। আজ অবস্থা এমন যে, নোকিয়া বা এরিকসনও কিছু কিছু যন্ত্রাংশে হুয়াওয়ের ওপর নির্ভরশীল। অনেক সময় যার কারণ হুয়াওয়ের যন্ত্রাংশ দামে অনেক সস্তা।
মনে করা হয়, আমেরিকার এই পিছিয়ে পড়া ব্যবসায়ীরা নিজেদের প্রবল দুর্দশায় পড়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘাড়ে এক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে সওয়ার হয়েছিলেন। তত্ত্বটা হলো, হুয়াওয়ে চীনা সরকারের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করে, বিশেষত গোপনে হুয়াওয়ের যন্ত্রপাতি দিয়ে। তাই আমেরিকার সরকারি কোনো ক্রয়ে হুয়াওয়ে বা জেডটিই কোম্পানির কোনো কিছু নিষিদ্ধ করে ট্রাম্প আইন করেছেন। আর এ নিয়ে এরপর ইউরোপের সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হয় ট্রাম্প প্রশাসনের। এ ক্ষেত্রে মূলত সবচেয়ে ভোকাল জার্মান চ্যান্সেলার মার্কেল। তিনি দাবি করেন আমেরিকা চীনা গোয়েন্দাগিরির কোনো প্রমাণ দেখাতে না পারলে ইউরোপ এটি মানবে না। ইউরোপ-আমেরিকার এই বিবাদে ইউরোপও আর এক থাকতে পারেনি। মূলত সস্তা হুয়াওয়ের টেকনোলজি কেনার হাতছানি এক দিকে। অন্য দিকে নাকি নিজেদের বিনিয়োগে যেতে হবে এর অনিশ্চয়তা, আর যতই দিন চলে যাচ্ছে ততই তারা ব্যবসায় পিছিয়ে পড়ছেন- এভাবে সব মিলিয়ে এই খাত এক ব্যাপক এলোমেলো বিশৃঙ্খলায় এখনো ডুবে আছে, আরো যাচ্ছে ক্রমেই।