মহররম আশুরা কারবালা
মহররম আশুরা কারবালা - ছবি : সংগৃহীত
মহররম, আশুরা ও কারবালা মুসলমানদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মহররম হিজরি সনের প্রথম মাস। আশুরা, মহররমের দশ তারিখ। বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত একটি দিন। আর কারবালা হলো ইরাকের ফোরাত নদীর তীরের একটি ঐতিহাসিক প্রান্তর, যেখানে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন রা: ও তাঁর পরিবারবর্গ ৬১ হিজরির দশ মহররমে এজিদ বাহিনীর হাতে শহীদ হয়েছিলেন।
পবিত্র আশুরা রোববার (৩০ আগস্ট)। সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে আশুরার দিনটি মহিমান্বিত ও তাৎপর্যময়। মহররম শুনলেই আসে আশুরার কথা। আর আশুরা মানেই আমাদের এ অঞ্চলে মনে করা হয় কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা। কিন্তু আশুরা মানে শুধুই কারবালার ঘটনা নয়। আশুরার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সা:-এর সুন্নাহ পালন। আশুরা সেই দিনটিকে বলা হয়, যে দিন তাওহিদ শিরকের ওপর বিজয়ী হয়েছিল।
রাসূলুল্লাহ সা: এ দিনের তাৎপর্য বর্ণনা করে গেছেন এবং এ দিবসে কী করণীয় তাও শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। আর কারবালায় হোসাইন ইবনে আলীর রা: শাহাদতের ঘটনা ঘটেছে রাসূলুল্লাহর সা: ওফাতের ৫০ বছর পর ৬৮০ সালে। দশ মহররম সংঘটিত অলৌকিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ধর্মীয় ঘটনার কারণেই মুসলমানদের কাছে আশুরা দিবসটি বিশেষভাবে মহিমান্বিত।
বছরের শ্রেষ্ঠতম রমজান মাসের পর মহররম ফজিলতের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। মহররম শব্দের অর্থ সম্মানিত। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছ, ‘ইন্না ইদ্দাতাশ শুহুরি ইন্নাল্লাহিছনা আশরা শাহরা, ওয়া মিনহুম আরবাআতুন হুরুম।’ অর্থাৎ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা বারো, এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। (সূরা তাওবা, আয়াত ৩৬)
হাদিস শরিফে চান্দ্রবর্ষের ১২ মাসের মধ্যে মহররমকে ‘শাহরুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর মাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সব মাসই আল্লাহর মাস। তবে মহররমের মর্যাদা বোঝাতেই হাদিসে কথাটি এসেছে। পবিত্র কুরআনে সূরা তাওবার ৩৬ নম্বর আয়াতাংশে ‘আরবাআতুন হুরুম’ অর্থাৎ অতি সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ চার মাস বলতে জিলকদ, জিলহজ্, মহররম ও রজব- এ চার মাসকেই বোঝানো হয়েছে। এ মাসগুলো হারাম বা নিষিদ্ধ মাস হিসেবে অভিহিত অর্থাৎ এ মাসে যুদ্ধবিগ্রহ করাও নিষিদ্ধ।
আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জাহেলি যুগে কুরায়েশরা আশুরার রোজা পালন করত। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সা: মদিনায় এসে নিজে আশুরার রোজা রাখেন এবং সাহাবিদেরও এ রোজা রাখার নির্দশ দেন। কিন্তু দ্বিতীয় হিজরিতে রমজানের রোজা ফরজ হলে এ রোজা নফল হয়ে যায়। যার ইচ্ছা রাখত, যার ইচ্ছা রাখত না। তবে রমজানের রোজা রাখার পর আশুরার রোজা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ। মদিনায় সাহাবিরা শিশুদেরও এ রোজা রাখাতেন।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলে করিম সা: হিজরত করে মদিনায় এসে দেখলেন, ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা রাখে। নবী সা: তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কিসের রোজা রাখো? তারা বলল : এটি একটি কল্যাণময় দিন। এ দিন হজরত মুসা আলাইহিস সালাম ও বনি ইসরাইলকে আল্লাহ তায়ালা ফেরাউনের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। তাই হজরত মূসা আ: এ দিন শুকরিয়া হিসেবে এ রোজা রেখেছেন। তাঁকে অনুসরণ করে আমরা এ রোজা রাখি। তা শুনে রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, হজরত মুসা আ:-এর অনুসরণের ব্যাপারে আমি তোমাদের চেয়ে বেশি হকদার ; তাই এই দিনে তিনি রোজা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার ব্যাপারে হুকুম দেন। (বুখারি, মুসলিম)
ইবনে আব্বাস রা: হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সা: যখন আশুরার দিন রোজা রাখলেন এবং অন্যদেরও রাখার আদেশ দিলেন, তখন সাহাবিগণ নবী সা: কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সা: এ দিনটিকে তো ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা সম্মান করে। তখন রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, তাহলে আগামী বছর ইনশা আল্লাহ ৯ মহররমও রোজা রাখব। অন্য বর্ণনায় আছে, যদি আমি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে অবশ্যই মহররম মাসের ৯ তারিখেও সওম অর্থাৎ রোজা পালন করব। (মুসলিম ১১৩৪, ইবনু মাজাহ ১৭৬৭, আবু দাউদ ২৪৪৫) অর্থাৎ নবীজী সা: সাহাবিদের নির্দেশ দিয়েছেন, ‘তোমরা ইহুদিদের থেকে ব্যতিক্রম করো, আশুরার এক দিন আগে বা এক দিন পরে রোজা রাখো;” এ অর্থে মহররমের ৯, ১০ অথবা ১০, ১১ এই দু’দিন রোজা রাখা। যাতে ইহুদিদের সাথে সাদৃশ্য না হয়।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ আশুরার আগে ও পরে দু’দিন এবং আশুরাসহ তিন দিন সিয়াম পালন করাকে আশুরার সিয়ামের ক্ষেত্রে উত্তম এবং পরিপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
উম্মুল মুমিনিন হজরত হাফসা রা: বলেন, রাসূলে পাক সা: চারটি কাজ কখনো ত্যাগ করেননি। আশুরার রোজা, জিলহজের নয় দিনের রোজা, আইয়ামে বিজের রোজা তথা প্রতি হিজরি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা এবং ফজর ওয়াক্তে ফরজের আগে দুই রাকাত সুন্নত নামাজ।
হজরত কাতাদা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলে পাক সা: বলেছেন, আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী, আল্লাহ তায়ালা এর অছিলায় অতীতের এক বছরের গোনাহ মাফ করে দেবেন। (তিরমিজি, মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ:) হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, রমজানের রোজার পরে মহররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ, যেমন ফরজ নামাজের পরে শেষ রাতের নামাজ অর্থাৎ তাহাজ্জুদ নামাজ বেশি মর্যাদাসম্পন্ন। (মুসলিম)
আশুরা শব্দটি আরবি ‘আশারা’ থেকে এসেছে। এর অর্থ হচ্ছে দশ। ইসলামী পরিভাষায় মহররমের ১০ তারিখ পবিত্র আশুরা হিসেবে অভিহিত। সৃষ্টির শুরু থেকে আশুরার দিনে বহু ঘটনা ঘটেছে। তবে কারবালার ঘটনা মানুষের মনে এতটাই রেখাপাত করেছে যে, আশুরা বলতে আমাদের দেশেও অনেকেই কারবালার ঘটনাকেই মনে করে। নিঃসন্দেহে কারবালার নির্মম ঘটনা ১০ মহররম সঙ্ঘটিত হয়েছে। কিন্তু কারবালার জন্য আশুরা নয়। আশুরা মুসলমানরা পালন করে রাসূলুল্লাহ সা:-এর সুন্নত তথা হাদিসের আলোকে। আর আশুরায় কারবালার ঘটনাটি হচ্ছে ইতিহাসের আলোকে। হক্কানি উলামায়ে কেরামের মতে, আশুরায় রোজা রাখাই হচ্ছে মূল আমল। শোক পালন, মিছিল বা মাতম করা শরিয়তসম্মত নয়।
তবে এটা ঠিক কারবালা প্রান্তরে হজরত ইমাম হোসাইন রা: জুলুমের শিকার হয়েছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি শহীদ হয়েছেন। তাঁর অনন্য শাহাদত আমাদের শিখিয়েছে, অন্যায় অবিচার জুলুম শোষণের কাছে মাথা নত করা যাবে না। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিবাদ করতে হবে। প্রয়োজনে জীবন বিলিয়ে দিতে হবে।
আরেকটি বিষয় অনেকই বর্ণনা করে থাকেন, আশুরার দিনে আসমান ও জমিন সৃষ্টি করা হয়েছিল। এ দিনেই মহান আল্লাহ পৃথিবীর প্রথম মানব হজরত আদম আ: কে সৃষ্টি করেছেন। এ দিনে তাঁকে বেহেশতে পাঠানো হয়, এ দিনেই তাঁকে এবং বিবি হাওয়াকে বেহেশত থেকে দুনিয়ায় পাঠানো হয়। আরাফাতের ময়দানে এ দিনে তাদের একত্র করা হয় এবং তাঁদের মাফ করে দেয়া হয়। এ দিনেই তাঁদের মৃত্যুও হয়। কেয়ামতও হবে আশুরার দিনে।
আরো বলা হয়, আশুরার দিনে আল্লাহ নবীদের নিজ নিজ শত্রুর হাত থেকে আশ্রয় প্রদান করেছেন। যেমন নুহ আ:-এর প্লাবন এ দিন শেষ হয় এবং তাঁর জাহাজ ‘জুদি’ পর্বতে গিয়ে থামে। হজরত ইব্রাহিম আ: নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে এদিন মুক্তিলাভ করেন। হজরত ইউনুস আ: মাছের পেট থেকে মুক্তি পান। হজরত আইয়ুব আ: দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভ করেন। হজরত সুলায়মান আ: হারানো রাজত্ব ফিরে পান। হজরত ইয়াকুব আ: ৪০ বছর পর তাঁর হারানো ছেলে হজরত ইউসুফ আ: কে ফিরে পেয়েছিলেন। হজরত ঈসা আ: এ দিনে জন্মগ্রহণ করেন এবং এ দিনেই তাঁকে দুনিয়া থেকে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু ইসলামী গবেষক ও স্কলারদের মতে, এসবের কোনো সঠিক ও বিশুদ্ধ প্রমাণ নেই। এ সম্পর্কে বর্ণিত হাদিসগুলো দুর্বল ও বানোয়াট।
ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক ও আলেম ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর, ড. মনজুর এলাহী, ড. মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ, শায়খ আহমাদুল্লাহর লেখা ও বর্ণনা থেকে জানা যায়, আশুরার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সা:-এর সুন্নতকেই অনুসরণ করতে হবে। হিজরতের আগে মক্কায় থাকাকালেও নবীজী সা: আশুরার রোজা রাখতেন। আল্লাহর নবী মুসা আ: এ দিন ফেরাউন ও তাঁর বাহিনীর ওপর বিজয় লাভ করেছিলেন। আশুরার দিনটি হচ্ছে, বাতিলের বিরুদ্ধে হকের বিজয়। তাগুতের ওপর রিসালতের বিজয়ের দিন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক