উম্মে আইমান : এক মহান সাহাবা
মদিনা শরিফ - ছবি : সংগৃহীত
দুনিয়ার ক্ষণস্থায়িত্বে পূর্ণ মানসিক তৃপ্তির বাসনা হলো বেখেয়ালে কল্পলোকে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে চলার মতো। কোনো কিছুকেই সব দিক থেকে ভালোবাসা সম্ভব নয় একমাত্র রব্বে কারিম ছাড়া; দুঃখ-দুর্দশার চড়া গন্ধ থেকে বেরিয়ে আসতে অবশ্যই জান্নাতি মানুষদের জীবনী জানতে হবে, কেমন ছিলেন তারা? ইতিহাসের প্রতিটি পাতায় রয়েছে সে বর্ণনা। ইসলামের ইতিহাস; সোনালি দিনের ঘটনাবলিকে সৃজনশীলতার উৎকর্ষে এক অন্যরকম বিশিষ্টতার রূপ দিয়েছে। রাসূল সা:-এর জীবনের একজন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মানুষ ছিলেন নাজদিয়া। তার জন্ম সিরিয়া রাজ্যের রামাল্লা শহরে, মতান্তরে ইথিওপিয়ায়। পিতা ফররুখ ইবনে মাসরুখ, মাতা উযরা। ইতিহাসবিদদের মতানুযায়ী দস্যু কর্তৃক আক্রমণের শিকার হয়ে মক্কার দাস ব্যবসায়ীদের বিক্রীত হন তিনি। ঘটনাক্রমে রাসূল সা:-এর পিতাগৃহের কাজ-কর্মের জন্য নয় কি দশ বছরের নাজদিয়াকে খরিদ করেছিলেন।
রাসূল সা:-এর সম্মানিত মা (আমেনা) লক্ষ করেন নাজদিয়া আসার পর গৃহে রহমত-বরকত পূর্বের তুলনায় বেড়ে গেছে, তাই নাজদিয়ার নতুন নাম দেন বারাকাহ। কৃষ্ণ বর্ণের বারাকাহ এভাবেই নবী পরিবারের একজন সদস্য হয়ে ওঠেন। অতঃপর রাসূল সা:-এর যখন জন্ম হয় তখন তিনি আমেনার পাশেই ছিলেন, বারাকাহ রাসূল সা: কে আমেনার কোলে তুলে দেন আর বলেন, ‘আমি কল্পনা করেছিলাম সে চাঁদের মতোন সুন্দর হবে, এখন দেখছি চাঁদের চেয়েও সুন্দর।’
রাসূল সা:-এর জন্মের সময় প্রথম রাসূল সা:-কে যিনি স্পর্শ করেছিলেন তিনি এই সৌভাগ্যের অধিকারী নারী বারাকাহ। রাসূল সা:-এর মায়ের সাথে তিনি রাসূল সা: কে গোসল করিয়েছেন, দেখাশোনা করেছেন। নবী সা:-এর মায়ের মৃত্যুর পর ছোট্ট বয়সেই রাসূল সা: দাস প্রথার বিলুপ্তি চেয়েছেন, রাসূল সা: বলেছেন উম্মি (হাবিবে রাসূল উম্মি বলে সম্বোধন করতেন) আপনি মুক্ত, যেখানে খুশি যেতে পারেন। কিন্তু তিনি যেতে চাননি; কারণ মৃত্যুর সময় আমেনাকে কথা দিয়েছিলেন রাসূলের দেখাশোনা করবেন বলে। হাবিবে রাসূল বিয়ের পর স্ত্রী খাদিজা রা:-কে বারাকাহ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘উনি আমার মায়ের পর আরেক মা’। রাসূলুল্লাহ ও খাদিজা রা: দু’জন মিলে (বারাকাহ) তাকে উবাইদ ইবনে জায়েদের সাথে বিয়ে দেন। এরপর তাদের একটি পূত্র সন্তান হয় নাম আইমান, মক্কার সংস্কৃতি ছিল সন্তানের নামে মায়ের পরিচিতি, সে সূত্রে বারাকাহর নতুন নাম হয় উম্মে আইমান।
উম্মে আইমানের প্রতি রাসূল সা:-এর শ্রদ্ধার কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা :
উবাইদ ইবনে জায়েদের মৃত্যুর পর রাসূল সা: সাহাবিদের বললেন, আমি একজন নারীকে জানি যার কোনো সম্পদ নেই, বয়স্ক এবং সাথে একজন ইয়াতিম সন্তান আছে কিন্তু তিনি জান্নাতি, তোমাদের মধ্যে কেউ কি জান্নাতি নারীকে বিয়ে করতে চাও?
এ বক্তব্যের পর জায়েদ ইবনে হারিসা রা: নবীজীর কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেন। অতঃপর উম্মে আইমান রা:-এর মত অনুযায়ী বিয়ে হয়। রাসূল সা: জায়েদ ইবনে হারিসকে বলেন, জানো তুমি কাকে বিয়ে করেছ? জায়েদ রা: বলেন, উম্মে আইমানকে।
রাসূল সা: অত্যন্ত খুশির সাথে বললেন না তুমি বিয়ে করেছ আমার মাকে।
মদিনায় হিজরতের পর দীর্ঘ যাত্রা শেষে যখন উম্মে আইমান ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন তখন হাবিবে রাসূল সা: নিজের গায়ের চাদরের এক অংশ ভিজিয়ে উম্মে আইমান রা:-এর মুখের ঘাম ও ধুলাবালু মুছে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন ‘উম্মি জান্নাতে আপনার এমন কোনো কষ্ট হবে না।’
রাসূল সা:কে খাবার নিয়ে জোর করলে তিনি অসন্তুষ্ট হতেন; উম্মে আইমান একমাত্র নারী যিনি রাসূল সা:কে খাবারের কথা বারবার বলতেন।
উম্মে আইমানের আরেক ছেলে উসামা ইবনে যায়িদ, যিনি অনেক যুদ্ধে সেনাপতিত্ব করেন। ক্রীতদাসী মায়ের সন্তানকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে রাসূল সা: কুরাইশদের অহঙ্কারী আভিজাত্যকে ধুলোয় মিশিয়ে দেন।
মৃত্যুর পূর্বে রাসূল সা: সাহাবিদের বলেছিলেন, ‘উম্মে আইমানের যত্ন নেবে, তিনিই একমাত্র নারী যিনি আমাকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দেখেছেন।’
হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর ওফাতের পর; হজরত আবুবকর সিদ্দিক রা: হজরত ওমর রা: কে বললেন, ‘চলেন আমরা উম্মে আইমানের সাথে দেখা করতে যাই, যেমন নবীজী সা: দেখা করতে যেতেন।’
অতঃপর উভয়েই যখন তার কাছে পৌঁছালেন তখন তিনি (উম্মে আইমান) কেঁদে ফেললেন। তারা তাকে বললেন, ‘তুমি কাঁদছ কেন? তুমি কী জানো না যে আল্লাহর কাছে যা রয়েছে তা রাসূল সা: এর জন্য দুনিয়া থেকে অধিক উত্তম?’
উম্মে আইমান বললেন, আমি এ জন্য কাঁদছি যে আসমান থেকে ওহি আসা বন্ধ হয়ে গেল। উম্মে আইমান তার এই কথার দ্বারা উভয়কেই কাঁদতে বাধ্য করলেন, ফলে তারাও তার সাথে কাঁদতে লাগলেন। (মুসলিম :২৪৫৪/ ইবন মাজাহ :১৬৩৫)
বলিষ্ঠ কণ্ঠ : জান্নাতি নারী হজরত উম্মে আইমান রা: মক্কা বিজয়ের সময় বালক পুত্র যায়েদকে নবীজীর খাদেম হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। একজন এসে বললেন, ‘তোমার ছেলে যদি কাফেরদের হাতে শহীদ হয়?’
উত্তেজিত কণ্ঠে উম্মে আইমান রা: বলেছিলেন, ‘আল্লাহর ইচ্ছে হলে শহীদ হবে, আল্লাহ যদি আমাকে একটি সন্তান না দিয়ে এক হাজার সন্তান দিতেন তবে প্রতিটি সন্তানকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পথে কোরবান করে দিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করতাম।’
ইন্তেকাল : হজরত হাসান রা:-এর খেলাফতকালে, জুমার রাতে সূরা ইয়াসিন তিলাওয়াতরত অবস্থায় ১০৫ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। জান্নাতুল বাকিতে তাঁকে দাফন করা হয়।
ইসলামের ইতিহাসে আসহাবে রাসূল সা:-এর প্রতিটি ঘটনা দীপ্তিস্বরূপ।
একজন মুসলিম বা মুসলিমাহর জন্য সোনালি জীবন থেকে শিক্ষা নেয়া কর্তব্য নয় কী? রাব্বুল আলামিন আমাদের মানসিক এবং বাস্তবিক অর্থেই সে তাওফিক দান করুন!