আরব বিশ্বে বিভক্তির আয়োজন

মাসুম খলিলী | Aug 27, 2020 06:01 pm
আরব বিশ্বে বিভক্তির আয়োজন

আরব বিশ্বে বিভক্তির আয়োজন - ছবি : সংগ্রহ

 

বিভাজন ও মুখোমুখি করার চেষ্টা
মধ্যপ্রাচ্য এবং মুসলিম বিশ্বে এখন যা হচ্ছে তার পেছনে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলোর একাধিক গ্রুপ তৈরি করে তাদের মুখোমুখি দাঁড় করানো ছিল ইসরাইরের মূল উদ্দেশ্য। একই সাথে, মুসলমানদের এক রাষ্ট্রকে অন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, এক জাতিকে অন্য জাতির বিরুদ্ধে উসকে দিয়ে সঙ্ঘাত সৃষ্টি করা আর এভাবে শক্তিশালী মুসলিম দেশগুলোকে দুর্বল ও ভাঙনের মুখোমুখি করার কৌশল ছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে স্বায়ু যুদ্ধকালে আমেরিকার সামনে প্রধান শত্রু ছিল কমিউনিজম।

কমিউনিজমের বিস্তার তথা সোভিয়েত প্রভাব ঠেকানোর জন্য একটি আদর্র্শবাদী প্রতিরোধ শক্তির প্রয়োজন ছিল। এই হিসেবে মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামের আদর্শিক পুনরুত্থানে ব্যাপকভাবে বাধা দেয়া হয়নি। শুধু এটি নিশ্চিত করা হয়েছে যে, তাদের হাতে যেন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ চলে না যায়। বিশ্ব রাজনীতিতে কমিউনিজমের আবেদন ফুরিয়ে যাওয়ার পর পাশ্চাত্যের বিশ্ব ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকরা আদর্শিক শক্তি হিসেবে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে ইসলামকে। এরপর প্রফেসর হান্টিংটনের ‘সভ্যতার দ্বন্দ্ব’ তত্ত্ব দাঁড় করানো হয়। সেই সাথে টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর বাস্তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ শুরু করেন ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’। এর প্রত্যক্ষ নিশানা বানানো হয় শক্তিমান ইসলামী রাষ্ট্র ও জাতিগোষ্ঠীকে। আফগানিস্তানকে এই লড়াইয়ের ক্ষেত্র বানিয়ে একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য শক্তিধর রাষ্ট্র ইরাকের শাসক সাদ্দাম হোসেনকে উসকে দিয়ে প্রথমে ইরানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামানো হয়; পরে কুয়েত দখলে প্ররোচিত করা হয় তাকে। এরপর অব্যাহত অবরোধের পথ ধরে সাদ্দামের পতন ঘটানো এবং তাকে হত্যার পর একটি ভঙ্গুর ও অস্থির রাষ্ট্র বানানো হয়েছে ইরাককে।

‘আরব বসন্ত’ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ইসলাম বা ইসলামী আন্দোলনকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক শাসকদের ক্ষমতার সামনে হুমকি হিসেবে তুলে ধরা হয়। এর মধ্য দিয়ে একসময় উপসাগরীয় যে শাসকরা পরোক্ষভাবে সেসব দেশের ইসলামিস্টদের পৃষ্ঠপোষকতা করত অথবা কাজ করতে সুযোগ দিতেন তাদের বিরুদ্ধে নিশ্চিহ্নকরণ অভিযানে নামেন। আরব বসন্তের পথ ধরে লিবিয়ায় গাদ্দাফির মতো শক্তিমান শাসকের অবসান ঘটানো হয় কিন্তু গৃহযুদ্ধে দেশটিতে এখন এক ক্ষতবিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তিউনিশিয়ায় রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের বিচক্ষণতার কারণে সেখানে অরাজক অবস্থা সৃষ্টি করা যায়নি। তবে এমন এক অস্থির অবস্থায় দেশটিকে ফেলে দেয়া হয়েছে, যেকোনো সময় একনায়কত্ব আবার জেঁকে বসার খড়গ তৈরি হয়ে আছে। এ জন্য আমিরাত চক্র অব্যাহতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ইয়েমেনে আলি আবদুল্লাহ সালেহর পতনের পর চার বছরের যুদ্ধ দেশটিকে নিঃশেষ করে ফেলছে। দেশটিতে অনাহারে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে।

সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের শাসন অবসানের জন্য জনগণকে রাস্তায় নামিয়ে বিদ্রোহীদের সমর্থন যুগিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, আমিরাত আর তুরস্ক। কিন্তু বিদ্রোহীরা জয়ের দ্বারপ্রান্তে চলে গেলে হাত গুটিয়ে নেয় সৌদি-আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়ার সাথে সৌদি-মিসর-আমিরাতের গোপন সমঝোতার কথা এখন জানা যাচ্ছে। এর আওতায় মুসলিম ব্রাদারহুডের ক্ষমতাকে ধ্বংস করতে রাশিয়ার সাথে আমিরাত মিসর সৌদি ব্লকের এক গোপন সমঝোতা হয়, যার অংশ হিসেবে রাশিয়ার বিমান হামলায় তিন লাখের বেশি সিরীয়কে হত্যার মাধ্যমে বাশার আল আসাদের শাসনকে রক্ষা করা হয়েছে। ইরান-রাশিয়া এ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করলেও নেপথ্যে ছিল ‘আমিরাত-মিসর-সৌদি’ বলয়। সিরিয়ায় তুরস্কের বিরুদ্ধে একটি কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আয়োজনকেও অনেকদূর এগিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু তুর্কি এস্টাবলিশমেন্টের কঠোর মনোভাবের কারণে সেটিকে এখনো সফল করে তোলা সম্ভব হয়নি। তবে তুরস্ককে সীমিত করার জন্য ‘ইসরাইল মিসর গ্রিস সাইপ্রাস ফ্রান্স’ অক্ষ তৈরি করা হয়েছে। এটি এখন লিবিয়া এবং ভূমধ্যসাগরীয় ফ্রন্টে বেশ সক্রিয়। এই অক্ষের সাথে সুবিধামতো, যুক্তরাষ্ট্র অথবা রাশিয়াকে সক্রিয় করার প্রচেষ্টা রয়েছে।

এরপর কী?
বর্তমান আয়োজনের মধ্য দিয়ে মুসলিম বিশ্বকে ত্রিধা বিভক্ত করার একটি কৌশলগত উদ্যোগ রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল মিসর সৌদি আরব আমিরাত এবং মিত্র দেশগুলোর একটি বলয়, ইরান ইরাক সিরিয়া লেবানন ইয়েমেনের হুতিদের নিয়ে একটি বলয় এবং তুরস্ক-কাতার-পাকিস্তান-আজারবাইজান-লিবিয়া নিয়ে একটি বলয় তৈরি হয়েছে। মধ্যবর্তী দেশগুলোকে এই তিন বলয়ের দিকে টানার প্রচেষ্টা রয়েছে।

ইউরোপ ও আমেরিকার মধ্যে ফ্রান্স সক্রিয়ভাবে ইসরাইল আমিরাত বলয়ের পক্ষে এবং জার্মানি, ইতালি ও ব্রিটেন মধ্যবর্তী স্থানে থেকে সঙ্ঘাতকে বাড়তে না দেয়ার চেষ্টায় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইল-আমিরাত-সৌদি বলয়ের মূল সমর্থক হলেও অন্য পক্ষগুলোর সাথেও সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে। রাশিয়ার ভূমিকা অনেকখানি দেশটির স্বার্থকেন্দ্রিক, যেখানে যে ভূমিকা নিতে হয় সেটি নিচ্ছে মস্কো।

পরবর্তী বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াইয়ে চীনকে সর্বাত্মক প্রতিপক্ষ বানানোর চেষ্টার মুখে নিজস্ব বলয় তৈরি করছে যুক্তরাষ্ট্র। এর বিপরীতে, রাশিয়ার সাথে চীন কৌশলগত সমঝোতায় উপনীত হয়েছে। পাকিস্তানকে সর্বাত্মকভাবে সমর্থন করছে বেইজিং। আর দেশটির প্রতি মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব গ্রহণের আহ্বান জানানোর মধ্য দিয়ে সর্বাত্মক কৌশলগত সমর্থনের বার্তাই দেয়া হয়েছে ইসলামাবাদকে। ইরানের সাথে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ সংবলিত দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মধ্য দিয়ে বেইজিং নিজের এশীয় বলয়কে সম্প্রসারণ করছে। এদিকে চীনবিরোধী ভবিষ্যৎ লড়াইয়ে আমেরিকা প্রধান সহযোগী করতে চাইছে ইসরাইল, ফ্রান্স ও ভারতকে। এর বিপরীতে ‘চীন-রাশিয়া-ইরান-পাকিস্তান’ একটি অক্ষ তৈরি করতে চাইছে বেইজিং।

করোনাভাইরাসের বিদায়ের সাথে সাথে এই মেরুকরণ অনেকখানি নির্দিষ্ট অবয়ব নিতে পারে। ইরান-চীন সমঝোতার পর চীনে সৌদি আরবের ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব স্থগিত ঘোষণা করেছে রিয়াদ। একই সাথে, ভারতের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক তৈরির স্বার্থে কাশ্মির ইস্যুতে ওআইসিকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে সৌদি আরব। এই ধারা চলতে থাকলে পাকিস্তান-সৌদি সম্পর্ক আরো অবনতির দিকে যাবে। এমনকি, একপর্যায়ে সৌদি আরবে পাকিস্তানের সামরিক উপস্থিতিরও অবসান ঘটানো হতে পারে। ‘সৌদি-আমিরাত-ইসরাইল-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র’ বলয়ে বাংলাদেশ গেলে এই শূন্যস্থান ঢাকাকে দিয়ে পূরণ করার বার্তা সম্প্রতি দেয়ার কথা জানা যাচ্ছে। নেপথ্যের এসব ঘটনা ও মেরুকরণ নানা কারণে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us