কী কী হয়েছিল আশুরার দিনে?
কী কী হয়েছিল আশুরার দিনে? - ছবি : সংগ্রহ
মহররম মাসের ১০ তারিখ ইতিহাসে ‘আশুরা’ নামে অভিহিত। প্রাচীনকালের নানা জনগোষ্ঠীর কাছেও ‘আশুরা’ পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ ছিল। ইহুদিদের কাছে ‘আশুরা’ জাতীয় মুক্তি দিবস হিসেবে পরিচিত। আশুরার মর্যাদা ইসলামে বিশেষভাবে স্বীকৃত। মুসলমানরা রোজা পালনের মাধ্যমে আশুরার মাহাত্ম্য স্মরণ করে থাকে। এ দিনে পৃথিবীর বহু চাঞ্চল্যকর ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আসমান-জমিন, আরশ-কুরসি ও আদি পিতা আদম আ:-এর সৃষ্টি, ধরাপৃষ্ঠে প্রথম বারিবর্ষণ, হজরত নূহ আ:-এর জাহাজ মহাপ্লাবন শেষে জুদি পাহাড়ে অবতরণ, ফিরাউনের নির্যাতন থেকে হজরত মুসা আ: কর্তৃক ইহুদিদের উদ্ধার, দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে হজরত আইয়ুব আ:-এর সুস্থতা লাভ, মৎস্যউদর থেকে হজরত ইউনুস আ:-এর নির্গমন, হজরত সুলায়মান আ:কে পৃথিবীর একচ্ছত্র রাজত্ব প্রদান, নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে হজরত ইবরাহিম আ:-এর নিষ্কৃতি, হজরত ইয়াকুব আ:-এর চক্ষুজ্যোতি পুনঃপ্রাপ্তি, কূপ থেকে হজরত ইউসুফ আ:কে উদ্ধার, হজরত ইদরিস আ: ও হজরত ঈসা আ:কে আসমানে উত্তোলন, কারবালায় হজরত হোসাইন রা:-এর শাহাদতসহ বহু ঐতিহাসিক ঘটনার নীরব সাক্ষী আশুরা।
মদিনায় হিজরতের পর রাসূলুল্লাহ সা: লক্ষ্য করেন, ইহুদিরা আশুরা দিবসে রোজা রাখছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কোন দিন যাতে তোমরা রোজা রেখেছ’? তারা বলল, এটা এমন এক মহান দিবস, যেদিন আল্লাহ তায়ালা হজরত মুসা আ: ও তার সম্প্রদায়কে মুক্তি দিয়েছিলেন, ফেরাউনকে তার সম্প্রদায়সহ ডুবিয়ে মেরেছিলেন। তাই হজরত মুসা আ: কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এদিন রোজা রেখেছেন, এ জন্য আমরাও রোজা রাখি।’ এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তোমাদের চেয়ে আমরা মূসা আ:-এর অধিকতর ঘনিষ্ঠ ও নিকটবর্তী। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সা: রোজা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার নির্দেশ দেন’ (সহিহ মুসলিম, ১/৩৫৯)।
রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা ছিল ফরজ। হিজরতের পর রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার নির্দেশ এলে আশুরার রোজা নফল হয়ে যায়। হজরত আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘রমজানের পর সব রোজার (নফল) মধ্যে আশুরার রোজা সর্বশ্রেষ্ঠ’ (জামে তিরমিজি ১/১৫৬)। পবিত্র আশুরার দিন রোজা রাখার ফজিলত সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, ‘আমি আশা করি, যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে রোজা রাখবে তার এক বছরের গুনাহের কাফফারা হয়ে যাবে (মুসলিম, ১/৩৬৭)। আশুরার দিন রোজা রাখলে ইহুদিদের সাথে সাদৃশ্য হয়ে যায় বিধায় রাসূলুল্লাহ সা: তার আগের বা পরের দিন আরেকটি রোজা রাখার পরামর্শ দেন (মুসনাদ আহমদ)। শায়খুল হাদিস আল্লামা মুফতি তকী ওসমানী বলেন, হাদিসের এক দুর্বল বর্ণনায় আছে আশুরার দিন কেউ যদি পরিবার পরিজনের জন্য অপেক্ষাকৃত ভালো ও উন্নত খাবারের ব্যবস্থা করে, আল্লাহ তায়ালা তার রুজি রোজগারে বরকত দান করবেন (ইসলাহি খুতবাত, ১৪ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬২-৬৩)।
হজরত মুয়াবিয়া রা: জীবিত থাকতেই স্বীয় পুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী খলিফা নিযুক্ত করে যান। মক্কা, মদিনা, কুফা ও দামেস্কের মসজিদে ইয়াজিদের পক্ষে প্রতিনিধির মাধ্যমে তিনি বাইয়াতও নিয়েছিলেন। শায়খুল ইসলাম বিচারপতি মুফতি তকী ওসমানী ‘আমির মুয়াবিয়া রা: ওয়া তারিখি হাকায়েক’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে বলেন, এ জাতীয় মনোনয়ন পদ্ধতি ছিল হজরত মুয়াবিয়া রা:-এর ‘গবেষণাধর্মী ভুল’ (ইজতিহাদি গালতি)। এ ভুলকে কেন্দ্র করে মারওয়ান ও পরবর্তী শাসকরা অবৈধ সুযোগ নিয়েছেন। হজরত আমির মুয়াবিয়া রা: ইয়াজিদকে যে ওসিয়ত করে যান তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ইন্তেকালের আগে তিনি ইয়াজিদকে ডেকে বলেন, ‘বৎস, কষ্টকর অভিযাত্রা থেকে তোমাকে বাঁচিয়েছি। দুশমনদের দুর্বল করে দিয়েছি। আরব নেতাদের গর্দান তোমার সামনে অবনত করে দিয়েছি। হিজাযবাসীদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখবে। তাদের মধ্যে যদি কেউ কাছে আসে সম্মান দেখাবে; কেউ যদি দূরে চলে যায় তার খেয়াল রাখবে। ইরাকবাসীদের প্রতি বিশেষ নজর রাখবে। প্রতি দিন যদি তারা গভর্নর পরিবর্তনের দাবি জানায়, তাদের এই দাবি মেনে নেবে। একজন গর্ভনরের পরিবর্তন অনেক বেশি ভালো মনে করি এক লাখ তরবারি তোমার বিরুদ্ধে উত্তোলনের চেয়ে। সিরিয়াবাসীকে আপন করে নেবে, তাদের বন্ধু বানিয়ে রাখবে। কুরাইশ বংশের চার ব্যক্তি ছাড়া কারো ব্যাপারে আমার ভয় নেই।
হোসাইন ইবন আলী রা:, আবদুল্লাহ ইবন ওমর রা:, আবদুর রহমান ইবন আবু বাকর র: ও আবদুল্লাহ ইবন যুবায়ের রা:। আবদুল্লাহ ইবন ওমর রা:-এর প্রতিটি মুহূর্ত দ্বীনদারিতে নিমগ্ন। তিনি তোমার কাছে কিছুই চাইবেন না। তিনি যদি দেখেন- তার আশপাশে আর কেউ নেই, তিনিই একদিন তোমার বাইয়াত গ্রহণ করবেন। আবদুর রহমান ইবন আবু বাকর রা: খেলাধুলা ও নারী নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে তার অন্য দিকে নজর দেয়ার অবকাশ নেই। তার বন্ধুবান্ধবরা যে দিকে মত দেন, তিনিও সে দিকে ধাবিত হন। যিনি সুযোগ পেলে বাঘের মতো তোমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন, শিয়ালের মতো তোমাকে ধোঁকায় ফেলবেন, তিনি হলেন আবদুল্লাহ ইবন যুবায়ের রা:। তিনি যদি তোমার সাথে প্রতারণাপূর্ণ আচরণ করেন, তার মুকাবেলা করো এবং তাকে যদি তোমার আওতায় আনতে পারো তাহলে টুকরো টুকরো করে উড়িয়ে দেবে। তিনি যদি সমঝোতা করতে আগ্রহী হন, তাহলে তোমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব, সমঝোতার প্রস্তাব মেনে নেবে।
নিজের জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে রক্তপাত হতে দেবে না। হোসাইন ইবন আলী রা: স্বাধীনচেতা ব্যক্তি। আমার প্রত্যাশা যেসব ব্যক্তি তার বাবাকে হত্যা করেছে, ভাইয়ের পক্ষ ত্যাগ করেছে, আল্লাহ তায়ালা তাদের মাধ্যমে হোসাইনের রা:-এর ব্যাপারে চিন্তা থেকে তোমাকে মুক্তি দেবেন। আমার মনে হয়, ইরাকবাসী তাকে তোমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী না বানিয়ে ছাড়বে না। তুমি যদি তার (হোসাইন রা:) ওপর বিজয় লাভ করো, তাকে ক্ষমা করে দিও। এ জাতীয় ঘটনা আমার সময়ে হলে অথবা কোনো প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে এলে আমিও ক্ষমা করে দিতাম। এতে কোনো সন্দেহ নেই, তিনি আমাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তার বিরাট হক রয়েছে। হজরত মুহাম্মদ সা:-এর নিকটতর বংশধর তিনি (ইবন জারির, তারিখে তাবারি, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫১-১৫২)।
হজরত হোসাইন রা:-এর ব্যাপারে হজরত আমির মুয়াবিয়া রা: যে ওসিয়ত করেন সেটা যদি ইয়াজিদ প্রতিপালন করতেন এবং কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইবন জিয়াদকে সেমতে কঠোর নির্দেশ দিতেন, হয়তো কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা এড়ানো যেত এবং ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হতো। শেষাবধি শান্তি, ঐক্য ও সমঝোতার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল। এ থেকে প্রমাণিত হয়, রাজনীতিতে মুয়াবিয়া রা: যে বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন, ইয়াজিদ তার ধারেকাছেও যেতে পারেননি।
৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ অক্টোবর (৬০ হিজরির ১০ মহররম) ইরাকের কারবালা প্রান্তরে মহানবী সা:-এর দৌহিত্র হজরত হোসাইন রা:-এর মর্মান্তিক শাহাদাত আশুরাকে তাৎপর্যমণ্ডিত করেছে। খিলাফত ব্যবস্থার পুনর্জ্জীবন ছিল হজরত হোসাইন রা:-এর সংগ্রামের মূল লক্ষ্য। অনস্বীকার্য যে, মুসলিম জাহানের বিপুল মানুষের সমর্থন ছিল তার পক্ষে। তার গৃহীত পদক্ষেপ ছিল সাহস ও বীরত্বপূর্ণ। মদিনার পরিবর্তে দামেস্কে রাজধানী স্থানান্তর, উমাইয়া বংশীয়দের অনৈসলামিক কার্যকলাপ, কুফাবাসীদের বিশ্বাসঘাতকতা- সর্বোপরি ইহুদি আবদুল্লাহ ইবনে সাবার ষড়যন্ত্র কারবালা হত্যাকাণ্ডের জন্ম দিয়েছে। ইয়াজিদের বিরুদ্ধে কুফাবাসীর সাহায্যের প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত হয়ে হজরত হোসাইন রা: স্ত্রী, পুত্র, বোন ও ঘনিষ্ঠ ২০০ জন অনুচরসহ ৬৮০ সালে ইরাকের কুফার উদ্দেশে রওনা হন। ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালা নামক স্থানে পৌঁছলে কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ তাকে বাধা দেয়।
ইতিহাসবিদ ইবন জারির তাবারির মতে, তখন রক্তপাত বন্ধের উদ্দেশ্যে ইমাম হোসাইন রা: তিনটি প্রস্তাব পেশ করেন। প্রথমত, তাকে মদিনায় ফিরে যেতে দেয়া হোক নতুবা দ্বিতীয়ত, পাশ্ববর্তী যেকোনো সীমান্তে যেতে দেয়া হোক; অথবা তৃতীয়ত, ইয়াজিদের সাথে আলোচনার জন্য তাকে দামেস্কে পাঠানো হোক। তার সাথে তিনি বোঝাপড়া করে নেবেন। এতে উম্মতের কল্যাণ নিহিত (তারিখে তাবারি, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৪০-১)। কিন্তু ইবনে জিয়াদ নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে তার হাতে আনুগত্যের শপথ নিতে আদেশ দিলেন। হজরত হোসাইন রা: ঘৃণাভরে তার এ আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন। ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুইর ইমাম হোসাইন রা:-এর প্রস্তাব সম্পর্কে বলেন, ‘সংলাপের এ অনুরোধ যদি মেনে নেয়া হতো, উমাইয়াদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনত’ (Well had it been for the Umayyad house, if the prayer had been agreed to. (ড. এ কে এম ইয়াকুব হোসাইন, ইসলামের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ৫৩০)।
অবশেষে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের চার হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী ইমাম হোসাইন রা:কে অবরুদ্ধ করে ফেলে এবং ফোরাত নদীতে যাতায়াতের পথ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। হজরত হোসাইন রা:-এর শিবিরে পানির জন্য হাহাকার ওঠে। তিনি ইয়াজিদ বাহিনীর উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে বলেন, ‘আমি যুদ্ধ করতে আসিনি, এমনকি নিছক ক্ষমতা দখল করা আমার উদ্দেশ্য নয়; খিলাফতের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করাই আমার কাম্য।’ ১০ মহররম ইয়াজিদ বাহিনী তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ অসম যুদ্ধে হোসাইন রা:-এর একমাত্র পুত্র ইমাম যায়নুল আবেদীন ব্যতীত ৭০ জন পুরুষ শহীদ হন। ইমাম হোসাইন রা: মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বীর বিক্রমে লড়াই করে যান; অবশেষে শাহাদত বরণ করেন। হোসাইন রা:-এর ছিন্ন মস্তক বর্ষাফলকে বিদ্ধ করে রাজধানী দামেস্কে পাঠানো হলো। তবে ক্ষমতাসীন ইয়াজিদ ভীত ও শঙ্কিত হয়ে কারবালায় পবিত্র দেহ সমাধিস্থ করার আদেশ দেয়। ইতিহাসবিদ গিবন বলেছেন, ‘সেই দূরবর্তী যুগে ও পরিবেশে হজরত হোসাইনের মৃত্যুর শোকাবহ দৃশ্য কঠিনতম পাঠকের হৃদয়ে, সমবেদনার সঞ্চার করবে’ (In a distant age and climate the tragic scene of the death of Husayn will awaken the sympathy of the coldest reader.)। ইতিহাস সাক্ষী, ইমাম হোসাইন রা:কে কারবালা প্রান্তরে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল, মাত্র ৫০ বছরের মধ্যেই তাদের প্রত্যেকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে করুণ পন্থায়। ইয়াজিদ বাহিনী কর্তৃক পবিত্র মক্কা নগরীর কাবাগৃহ অবরোধকালে স্বয়ং ইয়াজিদের মৃত্যু ঘটেছিল (আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ শফী রহ.)।
‘আশুরা’-এর শিক্ষা বহুমাত্রিক; ১. অন্যায় ও অসত্যের কাছে মাথা নত না করা; ২. আলোচনা ও সংলাপের সুযোগ থাকলে তা গ্রহণ করা; ৩. জালিম ও ঘাতকের বিচার পৃথিবীতেই হয়ে যায়, তবে বাকি থাকে পরকালীন বিচার ও শাস্তি; ৪. স্বৈরাচারী শাসকদের পতন অনিবায ও অবশ্যম্ভাবী; ৫. জালিম ও খুনিকে মানুষ কিয়ামত পর্যন্ত ঘৃণা করতে থাকবে; ৬. সত্যের সৈনিক ও মজলুমের প্রতি সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন ও শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পায়; ৭. যেকোনো ত্যাগের বিনিময়ে মুসলমানদের ঐক্য ধরে রাখা জরুরি।
কারবালার মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডে দুনিয়ার মুসলমানরা ইয়াজিদের ওপর এমনভাবে ক্ষুব্ধ হন যে ১৩৮২ বছরেও কোনো মা তার ছেলের নাম ইয়াজিদ রাখেননি। অপর দিকে ‘হোসাইন’ নামের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা এমনভাবে বৃদ্ধি পায় যে, ৫৭টি মুসলিম অধ্যুষিত দেশের প্রতিটি গলি ও মহল্লায় ‘হোসাইন’ নামধারী বিপুল মানুষ দেখা যাবে। নামের আগে পরে ‘হোসাইন’ শব্দযুক্ত মানুষের সংখ্যা কোটি কোটি। উল্লেখ্য, কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছিল। তার মস্তকও দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। তার রাজপ্রাসাদ কালের আবর্তে মাটির সাথে মিশে গেছে। এদিকে, ইয়াজিদের কবর অযত্নে পড়ে আছে সিরিয়ার এক কবরস্থানে।
কারবালার যুদ্ধে জয়লাভ ইয়াজিদ তথা উমাইয়া বংশের জন্য ছিল মূলত পরাজয়ের নামান্তর। এ বিয়োগান্তক ঘটনা মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্ম দেয়। বিশেষ করে শিয়া মতাদর্শ দ্রুত মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এটা পারস্যে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটায় এবং সর্বোপরি, ইসলামী খিলাফতের জন্য সমূহ পতন ডেকে আনে। কারবালার শোকাবহ হত্যাযজ্ঞ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র শিহরণ জাগিয়ে তোলে। কারণ ইমাম হোসাইন রা: অন্যায় ও অসাধুতার সাথে বিন্দুমাত্র আপস করেননি। তার এ সুমহান শাহাদত গৌরবোজ্জ্বল আদর্শরূপে পরিগণিত হয়। তাই আশুরা মুসলমানদের আত্মোপলব্ধিকে জাগ্রত করে তোলে।
অপরদিকে কারবালার ঘটনার প্রতিত্রিয়া মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও সঙ্ঘাতের স্থায়ী বীজ বপন করে দিয়েছিল। উমাইয়া, আব্বাসীয়, ফাতেমি, সাফাভি, সামানি, বুয়াহিদ, সেলজুক এবং পরবর্তী সময়ে এমনকি একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভেও দেশে দেশে উমাইয়া-আব্বাসীয়, আলাভ-খারিজি, শিয়া-সুন্নি সঙ্ঘাতে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে এবং আজো ঘটছে। ‘সুন্নি’ খলিফা মুসতাসিম বিল্লাহকে ‘শায়েস্তা’ করার জন্য ‘শিয়া’ প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ বিন আল কামি ১২৫৮ সালে মঙ্গল নেতা হালাকু খানকে বাগদাদ আক্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। দুর্ধর্ষ হালাকু খান বাগদাদ দখল করে পৈশাচিকতার তাণ্ডব চালিয়ে ৫০০ বছরের ইসলামী সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র বাগদাদ নগরী ধ্বংস করে দেয় এবং ১৮ লাখ মানুষকে হত্যা করে। জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা শাখার কোটি কোটি গ্রন্থের পাণ্ডুলিপিপূর্ণ পাঠাগারকে মঙ্গল সেনাবাহিনী আগুনে পুড়িয়ে ভস্মাধারে পরিণত করে দিয়েছিল। চলমান সৌদি আরব-ইয়ামেন যুদ্ধেও কারবালার রেশ লক্ষ করা যায়। ইয়ে হুতি গেরিলারা শিয়া আর সৌদি সরকার সুন্নি। সিরিয়ার শাসকগোষ্ঠী আসাদ পরিবার রাজনৈতিক চিন্তাধারায় কমিউনিস্ট হলেও ধর্মীয় আকিদায় তারা শিয়া মতাবলম্বী। ফলে এই পরিবারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য ইরানের সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রয়াসের কমতি নেই বেশ কয়েক দশক ধরে।
স্মর্তব্য, আশুরাকে কেন্দ্র করে শিয়া মুসলিম জনগোষ্ঠী দুলদুল বানিয়ে তাজিয়া মিছিল বের করে। ‘ইয়া হোসাইন, ইয়া হোসাইন বলে মাতম করে থাকে এবং তাদের অন্যকে বুকে-পিঠে ছুরিকাঘাতের মাধ্যমে নিজেদের রক্তাক্ত করে। ১০ মহররম একজন ‘শিয়া’ ইমামের জন্ম হওয়ায় আনন্দে হালুয়া রুটি বিতরণ করা হয়। তবে এমন কিছু কর্মকাণ্ড করা অনুচিত, যা শরিয়াহ দ্বারা সমর্থিত নয়। আলোকসজ্জা, আতশবাজি, হালুয়া-রুটি বিতরণ, দুটি কবুতর জবাই, ‘সত্তর দানা ভাত’ পাকানো, কালো কাপড় পরিধান, বিয়ে শাদী না করা, নতুন ঘর নির্মাণ বন্ধ রাখা, নতুন জামা পরিধান না করা, জারিগান, বুকে-পিঠে ছুরিকাঘাত প্রভৃতির সাথে আশুরার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এসব কর্মকাণ্ড আশুরার গাম্ভির্য, মর্যাদা ও তাৎপর্যকে ম্লান করে দেয়।
প্রাচীন বঙ্গের শাসক, অমাত্য, সৈনিক ও কর্মচারীদের মধ্যে অনেকে ছিলেন শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাসী। তারা নানা দেশ থেকে ১২০৫ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ের পর এ দেশে আগমন করেছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীর বঙ্গ সাহিত্যে তাদের ইমামবাড়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে মনে করা যায়, সুলতানি আমলে বঙ্গে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে মহররম উৎসব পালিত হতো (অধ্যাপক কে আলী, বাংলাদেশের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ১৭৫)। নবাবী আমলে আলিবর্দী খান, নবাব সিরাজুদ্দৌলা, মুর্শিদ কুলিখানসহ অনেকেই ছিলেন শিয়া মতাবলম্বী মুসলমান। তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে আশুরা পালন করতেন। ফলে বাংলার মুসলিম সমাজে আশুরার অনুষ্ঠানে শিয়াদের প্রভাব লক্ষ করা যায় আজো।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ওমর গণি এমইএস ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।