মুসলমানের প্রতি নজরুলের দান
কাজী নজরুল ইসলাম - ছবি : সংগ্রহ
হুগলি থেকে ২৩ অগ্রহায়ণ (১৩৩২ সনে) আনওয়ার হোসেনকে কাজী নজরুল ইসলাম একটি চিঠিতে লেখেন-
‘মুসলমান সমাজ আমাকে আঘাতের পর আঘাত দিয়েছে নির্মমভাবে। তবু আমি দুঃখ করিনি বা নিরাশ হইনি। তার কারণ, বাংলার অশিক্ষিত মুসলমানরা গোঁড়া এবং শিক্ষিত মুসলমানরা ঈর্ষাপরায়ণ। এ আমি একটুও বানিয়ে বলছিনে। মুসলমান সমাজ কেবলই ভুল করেছে আমার কবিতার সঙ্গে আমার ব্যক্তিত্বকে অর্থাৎ নজরুল ইসলামকে জড়িয়ে। আমি মুসলমান- কিন্তু আমার কবিতা সকল দেশের, সকল কালের এবং সকল জাতির। কবিকে হিন্দুকবি, মুসলমানকবি ইত্যাদি বলে বিচার করতে গিয়েই এত ভুলের সৃষ্টি।’
আমার মনে হয়, কাজী নজরুল ইসলামকে সামগ্রিকভাবে বোঝার জন্য এ ছোট্ট চিঠিটি খুবই কাজে লাগবে।
অন্নদাশঙ্কর রায় যতই আশ্বস্ত করুন যে, নজরুল ভাগ হয়নি- কিন্তু একটি পর্যায়ে নজরুল যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন (আগস্ট ১৯৪২) তখন দেখা গেল, খুব বাজেভাবেই ভাগ হয়েছেন। অর্থাৎ কারো কাছে তিনি ‘যবন কবি’, কারো কাছে ‘হন্দিুঘেঁষা কবি’। যুগের হুজুগটা তার ওপর দিয়েই গেল। চিকিৎসা হলো না, ওষুধ-পথ্য পেলেন না, শেষের দিকে চিকিৎসার জন্য রাঁচি এবং পরে (’৫৩-এ) জেনেভায় নেওয়া হলেও তার কাজ হলো না। পাকিস্তান হওয়ার পর আমাদের দেশে উঠে পড়ে লাগা হলো তাঁর রচনায় কী পরিমাণ ইসলামবিরোধী বক্তব্য আছে, সে সব রচনাই খুঁজে পেতে বের করার কাজে। প্রেমে ও বিদ্রোহে যিনি নিত্যসঙ্গী, সেই কাজী নজরুলকে এ দেশের মানুষ নতুন করেই আবিষ্কার করে ভাষার বিকাশে, আধুনিকতায়, সামাজিক আন্দোলনে, রাজনৈতিক আকাক্সক্ষায়। আর তখন, নজরুল আক্ষরিক অর্থেই নিশ্চল, নিশ্চুপ।
মধ্যযুগের সৈয়দ সুলতান। (ষোড়শ শতাব্দী), আব্দুল হাকিম (সপ্তদশ শতাব্দী) থেকে শুরু করে গত শতাব্দীর হামেদ আলী (১৯০৯), সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী (১৯১৪), মৌলভী তাসাদ্দুক আহমদ (১৯৭২), ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (নভেম্বর ১৯৪৭), ডা. আবু আহামেদ হাবিবুল্লাহ (১৯৪৮) এবং আরো অনেক মনীষী বাংলা ভাষার ব্যাপারে বাঙালি মুসলমানকে সতর্ক ও সজাগ করার প্রয়াস নিয়েছিলেন- কিন্তু একা, কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি মুসলমানকে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে নিয়ে এলেন। নজরুল ইসলাম কবিতা, গান, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, অভিভাষণ, নাটক দিয়ে যেমন, তেমনি সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে অর্থাৎ প্রামোফোন, সিনেমা, বেতারের মাধ্যমে শুধু ব্রিটিশ বিরোধিতাই নয়, শুধু সৌন্দর্য সৃষ্টিই নয়- অন্য ধরনের ভূমিকাও পালন করেছিলেন। ১৯৪১ সালের একটি লেখায় তিনি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন :
“আমার কবিতা আমার শক্তি নয়; আল্লার দেওয়া শক্তি- আমি উপলক্ষ মাত্র। বীণার বেণুকে সুর বাজে কিন্তু বাজান যে- গুণী, সমস্ত প্রশংসা তারই। আমার কবিতা যারা পড়েছেন, তাঁরাই সাক্ষী। আমি মুসলিমকে সঙ্ঘবদ্ধ করার জন্য তাদের জড়ত্ব, আলস্য কর্মবিমুখতা, ক্লৈব, অবিশ্বাস দূর করার জন্য আজীবন চেষ্টা করেছি। বাংলার মুসলমানকে শির উঁচু করে দাঁড়াবার জন্য- যে শির এক আল্লাহ ছাড়া কোন সম্রাটের কাছেও নত হয়নি; আল্লাহ যতটুকু শক্তি দিয়েছেন তাই নিয়ে বলেছি, লিখেছি ও নিজের জীবন দিয়েও তার সাধনা করেছি। আমার কাব্যশক্তিকে তথাকথিত ‘খাট’ করেও গ্রামোফোন রেকর্ডে শত শত ইসলামী গান রেকর্ড করে নিরক্ষর তিন কোটি মুসলমানের ইমান অটুট রাখারই চেষ্টা করেছি। আমি এর প্রতিদানে সমাজের কাছে জাতির কাছে কিছু চাইনি।
আমি আজ জিজ্ঞাসা করি : আমি লীগের মেম্বার নই বলে কি কোন লীগ-কর্মী বা নেতার চেয়ে কম কাজ করেছি? আজও ‘নবযুগে’ এসেছি শুধু মুসলমানকে সঙ্ঘবদ্ধ করতে- তাদের প্রবল করে তুলতে- তাদের আবার ‘মার্টায়ার’-শহীদি সেনা করতে। বাংলার মুসলমান বাংলার অর্ধেক অঙ্গ। কিন্তু এই অঙ্গ আলস্যে জড়তায় পঙ্গু। এই অঙ্গকে প্রবল না করলে বাংলা কখনো পূর্ণাঙ্গ হবে না। বাংলার এই ছত্রভঙ্গ ছিন্নমূল মুসলমানদের আবার এক আকাশের ছত্রতলে, এক ঈদগাহের ময়দানে সমবেত করার জন্যই আমি চিরদিন আজান দিয়ে এসেছি। ‘নবযুগ’-এ এসেও সেই কথা বলছি ও লিখেছি।
এই ‘নবযুগ’-এ আসার আগে বাংলার মুসলমান নেতায় নেতায় যে ন্যাতা টানাটানির ব্যাপার চলেছিল- সেই গ্লানিকর বিদ্বেষ ও কলহকে দূর করতেই আমি লেখনী ও তলোয়ার নিয়ে আমার অনুগত নির্ভীক, দুর্জয়, মৃত্যুঞ্জয়ী ‘নৌ-জোয়ানদের’ নিয়ে ভাই-এ ভাই-এ পূর্ণ প্রচেষ্টা চালাতে এসেছি। আমি কোনো ব্যক্তিকে সাহায্য করতে আসিনি। আল্লাহ জানেন, আর জানেন- যাঁরা আমার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত তাঁরা- আমি কোনো প্রলোভন নিয়ে এই কলহের কুরুক্ষেত্রে যোগদান করিনি ‘লীগ’ কেন, ‘কংগ্রেসেকে’ও আমি কোন দিন স্বীকার করিনি। আমার ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা তার প্রমাণ। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে কোন দিন লিখিনি- কিন্তু তার নেতাদের বিরুদ্ধে লিখেছি। যে কোনো আন্দোলনেরই হোক নেতারা যদি পূর্ণ নির্লোভ, নিরহঙ্কার ও নির্ভর না হন, সে আন্দোলনকে একদিন না একদিন ব্যর্থ হতেই হবে।
মুসলমানের জন্য আমার দান কোন নেতার চেয়ে কম নয়; যে সব মুসলমান যুবক আজ নব জীবনের সাড়া পেয়ে দেশের জাতির কল্যাণে সাহায্য করছে তাদের প্রায় সকলেই অনুপ্রেরণা পেয়েছে এই ভিক্ষুকের ভিক্ষা-ঝুলি থেকে।
আল্লাহর সৃষ্টি এই পৃথিবী আজ অসুন্দরের নির্যাতনে, বিদ্বেষে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। মানুষ মাত্রেই আল্লাহর সৈনিক। অসুন্দর পৃথিবীকে সুন্দর করতে সব নির্যাতন, সব অশান্তি থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করতে মানুষের জন্ম। আমি সেই কথাই আজীবন বলে যাব, লিখে যাব, গেয়ে যাব; এই জগতের মৃত্তিকা, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশকে আবার পূর্ণ শুদ্ধ পূর্ণ নির্মল করব- এই আমার সাধনা। পূর্ণ চৈতন্যময় হবে আল্লাহর সৃষ্টি এই আমার সাধ।
পূর্ণ আনন্দময়, পূর্ণ শান্তিময় হবে এ পৃথিবী- এ আমার বিশ্বাস। এ বিশ্বাস আল্লাহতে বিশ্বাসের মতোই অটল।”
ইরাক আফগানিস্তানের ধ্বংসস্তূপ তিনি দেখেননি। হিরোশিমা নাগাসাকির ধ্বংসযজ্ঞও তিনি দেখেননি। ভিয়েতনাম, রোডেশিয়া- এসব তাকে দেখতে হয়নি। ফিলিস্তিনে প্রতিদিন মানবতার মনুষ্যত্বের যে অবমাননা হচ্ছে, তাও তাকে দেখতে হয়নি। ১৯৪১-এর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-সমিতির রজত-জুবিলী উৎসব অনুষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর জীবনের শেষ অভিভাষণে বলেন।
‘হিন্দু-মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ- স্তূপের মতো জমা হয়ে আছে- এই অসাম্য, এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সঙ্গীতে, কর্মজীবনে, অভেদ-সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম- অসুন্দরকে ক্ষমা করতে, অসুরকে সংহার করতে এসেছিলাম- আপনারা সাক্ষী আর সাক্ষী আমার পরম সুন্দর। আমি যশ চাই না, খ্যাতি চাই না, প্রতিষ্ঠা চাই না, নেতৃত্ব চাই না- তবু আপনারা আদর করে যখন নেতৃত্বের আসনে বসান, তখন অশ্রু সংবরণ করতে পারি না।’
আমাদের দুর্ভাগ্য এই নজরুলকে পরে সেভাবে আর পাই না। মাত্র ২২-২৩ বছরের সৃষ্টিশীল জীবনে, মোমবাতির দুই দিক থেকে নিজেকে জ্বালিয়ে অধিক আলো দিতে গিয়ে তিনি নিজেই নিঃশেষ হয়ে গেলেন। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। যাকে বলে জীবন্মৃত।
চল্লিশের সেই উত্তাল দিনগুলোতে মনুষ্যত্বের, মহত্ত্বের এবং মানবিকতার মশালটি যেন তাঁর হাতেই ছিল। উভয় সম্প্রদায়ের কাছ থেকে যে ব্যবহার তিনি পেয়েছিলেন, সে তো এক উগ্র সময়ে, তবু জাহান্নামের আগুনে বসেই তিনি পুষ্পের হাসি হেসেছিলেন। তার উক্তি-
আমি চিরবিদ্রোহী বীর
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা
চির-উন্নত শীর।
আমাদের পরম সৌভাগ্য, এই উন্নত-মস্তকটি অনেক দেরিতে হলেও পৃথিবীর নজরে পড়তে শুরু করেছে। বড় বিষজ্বালা বুকে নিয়েই বলছি, আমরাও অনেক দেরি করে ফেলেছি, এখন রচনাবলী পাওয়া যায়। অনেক গান সুরসহ সংগৃহীত হয়েছে। নজরুল প্রতিভার বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। তার রচনার অনুবাদ হচ্ছে (না, যেনটা হওয়া উচিত ছিল, সে রকমভাবে হচ্ছে না যদিও)। আহা, নজরুল যদি এসব সামান্য হলেও দেখে যেতে পারতেন।