গাদ্দাফির সোনার লিবিয়াকে শ্মশান করল কে

আবদুর রহমান খান | Aug 27, 2020 02:42 pm
গাদ্দাফি

গাদ্দাফি - ছবি : সংগ্রহ

 

২০১১ সালে আরব বসন্তের নামে বিদ্রোহ উসকে দিয়ে, জাহাজবোঝাই অস্ত্র পাঠিয়ে বিদ্রোহীদের শক্তি যুগিয়ে এবং সর্বশেষ মার্কিন, ব্রিটিশ আর ফরাসি বিমানবাহিনীর টানা ছ’মাস ধরে সমন্বিত হামলার মাধ্যমে পতন ঘটানো হয় কর্নেল গাদ্দাফির সরকারকে। ২০১১ সালের ২০ অক্টাবর চরম বর্বরতার সাথে হত্যা করা হয় গাদ্দাফি, তার পুত্র ও তার সেনাপ্রধানকে। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো সেদিন চরম উল্লাসে স্বাগত জানিয়েছিল লিবিয়ার এ পতনকে।

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনি সামজ্যবাদের লুন্ঠন নীতির ঘোর বিরোধিতা করতেন গাদ্দাফি। প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে দৃঢ় সুসম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন আর ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর সাথে করেছিলেন মিত্রতা। এগুলো ছিল পশ্চিমা শক্তির রোষের রাজনৈতিক কারণ।

মৃত্যুর আগে গাদ্দাফি তার জন্মস্থান সিতরেতে শেষ ভাষণে দেশবাসীকে সতর্ক করে বলেছিলেন, লিবিয়ার তেল সম্পদ ও সমৃদ্ধির ওপর নজর পড়েছে সাম্রাজ্যবাদী শকুনদের। ওরা লিবিয়াকে ছিঁড়ে খেতে চায়। আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের সম্পদ রক্ষা করি। তিনি নিজেও শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করার আঙ্গীকর ব্যক্ত করেছিলেন সেদিন।

ইরাকে সাদ্দাস হোসেনকে উৎখাতের পর ২০০৮ সলে দামেস্কে আরব লীগের শীর্ষ সম্মেলনে লিবিয়র নেতা গাদ্দাফির ভাষণ আজ নতুন করে মনে করিয়ে দিচ্ছে আরবদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বের ষড়য়ন্ত্রের কথা। সেদিন গাদ্দাফি আরব নেতাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, আপনারা যদি ঐক্যবদ্ধ হতে না পারেন, তাহলে এর পর অন্য আরব দেশেরও ইরাকের মতো পরিণতি হতে পারে অ এমনকি আপনি নিজেও সাদ্দামের মতোই নিহত হতে পারেন।

মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক পর্যবেক্ষকরা আজ গাদ্দাফির ওই ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা আনুধাবন করছেন।

কেমন আছে লিবিয়া?

বিগত নয় বছর ধরে চলমান গৃহযুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত দেশটিতে একটি কেন্দ্রীয় শাসনের অনুপস্থিতে চরম নিরাপত্তাহীনতা আর ব্যাপক দারিদ্রের মাঝে বেঁচে থাকা লিবিয়ার মানুষেরা আজ নিজেদের অভিশাপ দিচ্ছে, কেন তারা সেদিন গাদ্দাফির বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে মেনে নিয়েছিল।

লিবিয়ার দীর্ঘদিনের শাসক রাজা ইদ্রিসেরর বিরুদ্ধে ১৯৬৯ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লিবিয়ার শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন কর্নেল গাদ্দাফির নেতৃত্বে বিপ্লবী সরকার। গাদ্দাফির সরকার প্রথমেই পশ্চিমা তেল কোম্পানির দখলে থাকা লিবিয়ার সবগুলো তেলখনি জাতীয়করণ করে নেন। আর তেলবিক্রির মুনাফা প্রত্যেক নাগরিকের মধ্যে বণ্টন করার একরকম সমাজতান্ত্রিক নীতি গ্রহণ করেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যাপকভাবে উচ্চাভিলাসী প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন। অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুত উৎপাদন, দরিদ্র নাগরিকের জন্য আবাসন এবং মৌলিক খাদ্য চাহিদা নিশ্চিতকরণ- এসব ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি অর্জন করে লিবিয়া। সামাজিকভাবেও লিবিয়া দ্রুতই এগিয়ে যায় একটি সমৃদ্ধশালি দেশ হিসেবে।

২০১০ সালে জাতিসঙ্ঘ উন্নয়ন সংস্থার হিসাবে ৮৮.৪ ভাগ স্বাক্ষরতার হার,৭৪.৫ বছরের গড় আয়ু এবং নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করে লিবিয়া তখন গোটা আফ্রিকা মহাদেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্য এগিয়ে থাকা উচ্চ-উন্নয়নশীল একটি দেশ। আর এসবই হয়ে দাঁড়ায় পশ্চিমাদের চক্ষুশূলের কারণ।

লিবিয়ায় রয়েছে ছোটবড় ১৪০টি গোত্র। এদের প্রত্যেকটির রয়েছে স্বতন্ত্র ঐতিহ্য এবং স্বতন্ত্র গোত্র ইতিহাস। আর এটাই লিরিয়ার জনগোষ্ঠীর অনৈক্যের বড় কারণ।

বর্তমানে লিবিয়ার দু’টি অঞ্চল শাসন করছে দু’টি অলাদা সরকার। রাজধানী ত্রিপোলিতে ক্ষমতায় রয়েছে জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত গভর্নমেন্ট অব ন্যশনাল একর্ড (জিএনএ) সরকার। আর পুব দিকের বন্দর নগরী অল-বায়দাতে রয়েছে সাবেক জেনারেল খলিফা হাফতারের আরেটি সমান্তরাল সরকার।
ওদিকে বিভিন্ন তেল ক্ষেত্র দখল নিয়ে যুদ্ধলিপ্ত রয়েছে কয়েকটি মিলিশিয়া বাহিনী।

আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত হয়ে যুদ্ধরত মিলিশিয়া বাহিনীর নিজেদের মধ্যে এবং সরকারি বাহিনির সাথে ধারাবাহিক সঙ্ঘাতে প্রতিদিন মানুষ মরছে, সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে। চলাচল আর পণ্য পরিবহন ব্যহত থাকায় মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগ আর আতঙ্কের মাঝে দিন কাটাচ্ছে।

জাতিসঙ্ঘের হিসাব মতে, চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত তিন মাসে লিবিয়ায় সামরিক সঙ্ঘাতে মারা গেছে ১০২ জন বেসামরিক নাগরিক আর আহত হয়েছেন ২৫৪ জন। এবছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় পরের তিন মাসে ১৭২ শতাংশ বেড়েছে মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা।

লিবিয়ার নাগরিকদের তাদের দেশের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার নেই। তাদের প্রধান সম্পদ তেলখনি এমন কী তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপরও নেই তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ। এগুলো পরিচালিত হচ্ছে বিদেশীদের নির্দেশে ।

তেল মজুদের দিক থেকে লিবিয়া হচ্ছে বিশ্বের প্রধান দশটি তেল ভাণ্ডারের একটি। আর অফ্রিকার মধ্যে সর্ববৃহৎ। ২০১০ সালের হিসাবে লিবিয়ার তেল মজুদ ছিল ৪৬.৪ বিলিয়ন ব্যারেল। ওই সময় দৈনিক উত্তোলন হতো ১.৬ মিলিয়ন ব্যারেল। নতুন কোনো তেল ক্ষেত্র আবিষ্কার না হলেও ওই পরিমাণ মজুত দিয়ে লিবিয়া ৭৭ বছর চলতে পারতো।

এ ছাড়া লিবিয়ার রয়েছে ১.৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক মিটার প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ। আরো রয়েছে রফতানিযোগ্য খনিজ লবণ, জিপসাম, পটাশিয়াম, ও ম্যাগনেসিয়ামসহ নানা খনিজ পদার্থের পর্যাপ্ত মজুদ।

বিশ্ববাজারে লিবিয়ার তেলের চাহিদা বেশি কারণ সেখানে উৎপাদন ব্যয় সর্বনিম্ন। লিবিয়ার তেলকে বলা হয় সুইট ক্রুড। কারণ তাতে রয়েছে কম পরিমাণে সালফার। ইউরোপের দেশগুলোতে শতকরা ১১ ভাগ তেল আসে লিবিয়া থেকে। সেখানে লিবিয়া হচ্ছে তৃতীয় বৃহৎ তেল সরবরাহকারী।

লিবিয়ার এসব সম্পদের প্রতি পশ্চিমা লুটেরাদের নজর ছিল আগ থেকেই। গাদ্দাফিকে উৎখাতের পর এসবের প্রতি লোলুপ হয়ে উঠেছে প্রতিবেশী মিসর, তুরস্ক ও কাতার। তারাও বিভিন্ন যুদ্ধবাজ মিলিশিয়া গোষ্ঠির প্রতি সমর্থন ও অস্ত্র সহযোগিতা বজায় রেখে সঙ্ঘাতকে প্রলম্বিত হতে সহায়তা করছে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us