প্রশান্ত আর রাহুল : নতুন পথের দিশা দিচ্ছেন?

প্রশান্ত আর রাহুল - ছবি : সংগৃহীত
‘প্রশান্ত’ নামে অর্থ পুরোপরি অচঞ্চল। কিন্তু প্রশান্ত ভূষণ অন্তত এমন নন। আদি উপনিষদ অনুযায়ী ‘রাহুল’ মানে সব দুঃখ জয়ী।কিন্তু রাহুল গান্ধী জানেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির স্বেচ্ছাচারি শাসিনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস করায় তিনি বিরল বিরোধী নেতা হিসেবে প্রশংসা পাওয়ার দাবিদার হলেও তিনি এর জন্য উপযুক্ত নন। তারা যদি তাদের বিপুল শক্তি নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতেন, তারা ভারতীয় গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারতেন।
এ দুজনের সম্মিলনে কী হতে পারে, তা বিবেচনা করা যাক। লোকসভায় কংগ্রেসের আসন ১০ ভাগেরও কমে নেমে যাওয়া সত্ত্বেও এটিই একমাত্র দল যারা কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
আবার গত কয়েক দশকে এমন কিছু ভুলের সাথেও কংগ্রেস জড়িয়ে আছে, যার পরিণতিতে ডানপন্থী লোকরঞ্জক বক্তারা ক্ষমতা দখলের পথ খুঁজে পেয়েছে। কংগ্রেস সরকার ‘ক্রনি ক্যাপিটালিজম’কে প্রশ্রয় দিয়েছে, একইসাথে ভারতকে ছিনতাইকারী সামাজিকভাবে বিভক্তকারী লবির জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
প্রশান্ত উভয় দিক থেকেই সবকিছুকে ঠিক করতে চেয়েছেন। তিনি ধনী ও রাজনৈতিক শ্রেণির মধ্যকার আঁতাতকে হত্যা করার প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তিনি কাশ্মিরের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য কথা বলার পাশাপাশি দলিত ও মুসলিমদের পক্ষেও অবস্থান গ্রহণ করেছেন।
এই আইনজীবী অ্যাক্টিভিস্ট বিক্ষুব্ধ ও আমূল পরিবর্তনের জন্য নিবেদিতপ্রাণ অসংখ্য লোকের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। তিনি অরুন্ধতী রায়ের প্রশংসা করেন, অরুন্ধতীও তাকে পছন্দ করেন। অরুন্ধতী আদালত অবমাননার জন্য জেল খেটেছেন, এবার প্রশান্তর পালা।সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনলে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। প্রশান্তও তাই করেছেন। তিনি আদালতকে, তার রায় সোমবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে, বলেছেন যে তিনি নিজের বিবেকের প্রতি সৎ থেকে ওই মন্তব্যগুলো করেছিলেন। তার পুরনো ও সাম্প্রতিক কিছু টুইট কয়েকজন বিচারকের মানহানি হয়েছে বলে তাকে আদালত অবমাননার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
প্রশান্তের রাজনীতির ব্যপ্তি অনেক বেশি। ২০১৫ সালে মোদির যাত্রা প্রতিরোধকারী আম আদমি পার্টিকে সহায়তা করেছিলেন তিনি। তবে অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে তিনি পরিত্যাগ করেন যখন তার মতে, একসময় কেজরিওয়াল যাদের সমালোচনা করেছেন, তাদেরই অনুকরণ করতে শুরু করায়। অবশ্য, তার প্রধান টার্গেট করপোরেট টাকাওয়ালারা। তারাএ এখন ভারতের রাজনীতি পরিচালনা করেন।
প্রশান্ত ভূষণ জানেন, তিনি একা লড়াই করতে পারবেন না। তাকে কে সহায়তা করতে পারেন? তাত্ত্বিকভাবে সাধারণ মানুষ ও সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে কথা পারাটা যেকোনো রাজনীতিবিদের স্বপ্ন। প্রশান্ত এই ধারারই প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি কংগ্রেস আমলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। আবার মোদির আমলে করা সন্দেহজনক চুক্তিগুলোর বিরুদ্ধেও জোরালভাবে কথা বলছেন।
প্রশান্ত ভূষণের কাজে কিভাবে সহায়তা করতে পারেন রাহুল গান্ধী? তরুণ গান্ধী জানেন, বিরোধীরা তাকে ‘জনি-কাম-লেটলি’ হিসেবে তাকে কলুষিত করছে। প্রধানমন্ত্রী তাকে গালাগাল করেন, তিনি ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে কংগ্রেস দলকে নির্মূল করার ঘোষণা দিয়েছেন।
হিসাবটি মিলিয়ে দেখুন। মোদি চান গান্ধীবিহীন কংগ্রেস। কেন? রাহুল চীনের ব্যাপারটি যথাযথভাবে সামাল দিতে না পারায় সরকারের সমালোচনা করেছেন। রাফাল যুদ্ধবিমান ক্রয়ে গোপন চুক্তির জন্য তিনি সরকারের সমালোচনা করেছেন। করোনাভাইরাস দমনে ব্যর্থতার জন্য তিনি সরকারের সমালেচানা করেছেন। ক্ষমতায় আসতে অযোধ্যার রামমন্দির প্রকল্পকে ব্যবহার করার সমালোচনা করেছেন।
বেশির ভাগ টিভি চ্যানেল যখন দলের নেতৃত্ব দিতে রাহুল মানসিকভাবে অক্ষম হিসেবে প্রচার করে তখন দুর্নীতির সুবিধাভোগী হিসেবে পার্লামেন্টে ও এর বাইরে খুবই ধনী যাদের নাম বলেন, তারা খুবই খুশি হয়।
রাহুল ঘোষণা দিয়েছেন, তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও যদি বিসর্জন দিতে হয়, তবুও তিনি সরকারের গণবিরোধী কার্যকলাপের সমালোচনা করে যাবেন।এমন সাহস দেখানোর মতো একজন রাজনীতিবিদও এখন আর ভারতে নেই।
১৯৯৬ সালে পি ভি নরসীমা রাও যখন দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন, তখন কংগ্রেসের কোষাধ্যাক্ষ সীতারাম কেসরিকে দলের সভাপতি নির্বাচন করা হয়। তিনি ছিলেন বিহারের নিম্নবর্ণের হিন্দু। ওই সময় ১৯৯১ সালের নির্বাচনী সমাবেশে বক্তৃতা করতে গিয়ে আত্মঘাতী বোমা হামলায় রাজীব গান্ধীর মৃত্যুজনিত সমস্যায় ছিল গান্ধী পরিবার।
আসন ও মর্যাদা হ্রাস পেয়েছিল কংগ্রেসের। কেসরি তখন জোট গড়ার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এখনকার চেয়ে তখন জোটের দরকার ছিল কংগ্রেসের অনেক বেশি। মায়াবতীর মতো দলিত নেতা, বাম ফ্রন্ট ও অন্যান্য নিম্নবর্ণের নেতাদের কাছে যান তিনি। মুম্বাইয়ের ব্যবসায়ী লবি এতে আপত্তি করেছিল। ওই সময়ই প্রণব মুখার্জি কেসরির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন। কংগ্রেস সভাপতিকে টয়লেটে আটকে রাখা হয়, তার বিছানা সরিয়ে নেয়া হয়। সবকিছুই করা হয় সোনিয়া গান্ধীর নামে।
কেসরি তার ঘনিষ্ঠজনদের বলেছিলেন, তার বিদায়ে সোনিয়ার হাত ছিল না। বরং ব্যবসায়ী ক্লাবের সাথে ঘনিষ্ঠ একজনকে তার জায়গায় বসানোর জন্য সোনিয়ার নাম ব্যবহার করা হয়েছে। তারা বাজারমুখী মনমোহন সিংকে সামনে আনার জন্যও সোনিয়া গান্ধীর নাম ব্যবহার করেছে। মনমোহনের দ্বিতীয় মেয়াদ বিশৃঙ্খল হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু নয়। ওই সময় সিনিয়র সাংবাদিকেরা সরকারকে পরামর্শ দিতেন কোন মন্ত্রণালয়ে কোন মন্ত্রীকে নিয়োগ করতে হবে। তারা আসলে মুম্বাইয়ের হয়ে কাজ করতেন।
সোমবার কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনের সময়ও একই চিত্রনাট্য অভিনীত হয়েছে। সোনিয়া ছিলেন অন্তর্বর্তী সভাপতি। অন্তর্বর্তী সভাপতি কিভাবে পদত্যাগ করতে পারেন? তিনি কোনোভাবেই সভাপতি হতে চাননি।
আশার কথা হলো প্রশান্ত ভূষণ ও রাহুল গান্ধী ভাগ্য তাদেরকে যেখানে নিক্ষেপ করেছে, ওই সুযোগটি গ্রহণ করবেন। তারা তাদের বিভ্রান্তকর নাম নিয়ে সাফাই গাচ্ছেন না।
সূত্র : ডন