করোনায় কোন ভ্যাকসিন সবচেয়ে ভালো হবে?
করোনা ভ্যাকসিন - ছবি : সংগৃহীত
করোনা মহামারীর এ সময়টিতে মৃত্যুহার কিছুটা কমে এলেও সংক্রমণের হারে কিন্তু এখনো ঊর্ধ্বগতি। গোটা বিশ্বে গত ৮ মাসে এই করোনাতে আক্রান্ত হয়েছে ২ কোটি ৩৫ লাখ মানুষ, যার ভেতরে মারা গেছে ৮ লাখের উপরে। বাংলাদেশে মৃতের সংখ্যা ৪ হাজার ছাড়িয়েছে আর ভারতে এ সংখ্যাটি ৫৮ হাজার। আমরা এখন অবস্থান করছি মহামারীর এপিসেন্টার বা কেন্দ্রে। করোনাভাইরাস কবে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিবে তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। তবে এই মহামারী থেকে বাঁচার জন্য খুব দ্রুত যে একটি নিরাপদ ও কার্যকরী ভ্যাকসিন প্রয়োজন তা নিয়ে কারো দ্বিমত নেই।
ভ্যাকসিন তৈরির কাজ শুরু হয়েছে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকেই। বিভিন্ন দেশের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এবং কোম্পানি ১৬৫টি ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছে। এদের ভেতরে ৮টি ভ্যাকসিন এখন রয়েছে শেষ ধাপ বা ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে। শেষ ধাপে থাকা অক্সফোর্ডের চ্যাডক্স-১, মডার্নার এমআরএনএ, জার্মানির বায়োন্টেক (ফাইজার), চীনের সিনোভ্যাক, সিনোফার্ম ও ক্যানসিনোবায়ো এবং রাশিয়ার স্পুটনিক-৫ আগামী বছরের শুরুতেই তাদের ভ্যাকসিন বাজারে আনার আশা ব্যক্ত করেছে। এদের মধ্যে অক্সফোর্ড/অ্যাসট্রাজেনিকা আগামী অক্টোবরেই তাদের ভ্যাকসিনটি বাজারে আনার ব্যাপারে খুবই আশাবাদী। সাম্প্রতিক নোভাভ্যাকস ভ্যাকসিনটিও সামনের সারিতে চলে এসেছে।
অবশ্য ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন হওয়ার আগে কোনোভাবেই নিশ্চিত করে বলা যায় না যে কোন ভ্যাকসিনটি আসলে কাজ করবে। একটি ভ্যাকসিনকে কার্যকরী হিসেবে বিবেচনা করতে হলে অবশ্যই ফেইজ-৩ ট্রায়ালে ৫০%-৭০% রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা প্রদর্শন করতে হবে।
একটা ভ্যাকসিন কতটুকু কার্যকরী হতে পারে তা অনেকটা বৈজ্ঞানিকভাবে আন্দাজ করা যায় ওই ভ্যাকসিনটি মানুষের ওপর ফেইজ-১/২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে। এ ছাড়াও কোনো ভ্যাকসিনের সম্ভাব্য কার্যকারিতা এবং তার স্থায়িত্ব নির্ভর করে ভ্যাকসিনটির কার্যপদ্ধতি ও ডিজাইনের ওপর। উপরে উল্লিখিত ভ্যাকসিনগুলোর ডিজাইন ও কার্যকারণ একেকটার একেক রকম। তাহলে আমাদের জন্য, দেশের জন্য আমরা কোন ভ্যাকসিনটি নির্বাচন করব? আমরা যখন দোকান থেকে একটা ওষুধ কিনি তখন চেষ্টা করি ভালোটা কিনতে, তাই না? ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও তা সমানভাবে প্রযোজ্য।
এখানে আমি উপরে উল্লিখিত আটটি ভ্যাকসিনের একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছি, যা থেকে বোঝা যাবে কোন ভ্যাকসিনটি বেশি কার্যকর ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
একটা কার্যকরী ভ্যাকসিন আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে প্রস্তুত করে রাখে এমনভাবে যাতে করে শরীরে কোনো ভাইরাস বা জীবাণু প্রবেশ করা মাত্রই তা নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে। ভ্যাকসিনের মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে এই রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা তৈরি হয় দুইভাবে : (১) জীবাণুটির বিরুদ্ধে নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি করে এবং (২) টি-সেলকে (এক ধরনের শ্বেত কণিকা) যথাযথ ট্রেনিং বা প্রস্তুতিকরণের মাধ্যমে। আধুনিক বিজ্ঞান মতে, যে ভ্যাকসিনটি এ দু’টি প্রক্রিয়াকে একই সাথে উজ্জীবিত করতে পারবে সেই ভ্যাকসিনটি হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর এবং দিতে পারে দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা।
গবেষণা থেকে জানা যায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণে শরীরে যে নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি হয় তা তিন মাসেই প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়! তবে অ্যান্টিবডি কমে গেলেও শরীরে থেকে যায় ওই ভাইরাস বিরোধী টি- সেল (ঈউ৪+ ও ঈউ৮+ ঞ পবষষং) যারা করোনাভাইরাসকে শনাক্ত করতে পারে এবং বি-সেলকে সক্রিয় করার মাধ্যমে নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি (ঈউ৪+ ঞ পবষষ কর্তৃক) ও সরাসরি ভাইরাস সংক্রমিত কোষকে ধ্বংস করতে পারে (ঈউ৮+ ঞ পবষষ কর্তৃক)। এ কারণেই ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি একমত যে, করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনকে কার্যকরী ও দীর্ঘস্থায়ী হতে হলে ভ্যাকসিনটিকে ভাইরাস নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরির পাশাপাশি টি-সেল রেসপন্সও ঘটাতে হবে।
অক্সফোর্ডের শিম্পাঞ্জি অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর ভ্যাকসিনটির প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানো হয় ইঁদুর ও বানরের ওপর। এতে দেখা যায়, ভ্যাকসিনটি প্রয়োগের ১৪ দিন পরে ইঁদুরের রক্তে পর্যাপ্ত পরিমাণ নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি (ওমএ) তৈরি হয়েছে এবং ভাইরাস বিরোধী ইন্টারফেরন-গামা সমৃদ্ধ টি-সেল রেসপন্স ঘটেছে। ইন্টারফেরন-গামা ভাইরাস নিধনে সরাসরি সহায়তা করে। এ ছাড়াও দেখা যায়, ভ্যাকসিন দেয়া বানর করোনা ইনফেকশন থেকে মুক্ত (নেচার, ২০ জুলাই)। পরে ভ্যাকসিনটির ফেইজ-১/২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানো হয় যুক্তরাজ্যের ৫টি সেন্টারে ১,০৭৭ জন ভলান্টিয়ারের ওপর। ফলাফলে দেখা যায় প্রথম ডোজ দেয়ার ১৪ দিন পর ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের বিপরীতে পর্যাপ্ত পরিমাণ টি-সেল তৈরি হয়েছে রক্তে এবং ২৮ দিন পরে দ্বিতীয় ডোজ দেয়ায় ১০০% টিকা গ্রহীতার রক্তে স্পাইক প্রোটিনের বিপরীতে অ্যান্টিবডি (ওমএ) তৈরি হয়েছে, যার গড় টাইটার ছিল ৬৩৯। চজঘঞ পদ্ধতিতে জীবিত করোনাভাইরাসের ওপর নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি টেস্ট করে দেখা যায় ১০০% টিকা গ্রহীতার রক্তেই অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, যার টাইটার ২১৮ এবং তা জীবিত ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম। উভয় ক্ষেত্রেই নির্ণীত অ্যান্টিবডি টাইটার ছিল কনভালসেন্ট প্লাজমায় প্রাপ্ত অ্যান্টিবডি টাইটারের সমান (ল্যানসেট, ২০ জুলাই)।
চীনের ক্যানসিনোবায়ো। ভ্যাকসিনটিও একটি অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর ভ্যাকসিন। তবে এ ক্ষেত্রে হিউম্যান অ্যাডিনোভাইরাস-৫ (অ্যাড-৫) ভেক্টর ব্যবহার করা হয়েছে। এই ভ্যাকসিনটির ফেইজ-১ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানো হয় ১০৮ জন ভলান্টিয়ারের ওপর। ফলাফল অনেকটা অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের মতোই। এক ডোজ ভ্যাকসিন দেয়ার ১৪ দিন পরেই রক্তে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভাইরাস বিরোধী ইন্টারফেরন-গামা সমৃদ্ধ টি-সেল (ঈউ৪+ ও ঈউ৮+ ঞ পবষষং) তৈরি হয়। আর ২৮ দিনে রক্তে ভাইরাসের রিসিপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইনের (জইউ) বিপরীতে অ্যান্টিবডির টাইটার দাঁড়ায় ১,০৪৫। ভাইরাস নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডিও তৈরি হয় রক্তে, ঊখওঝঅ পদ্ধতিতে যার টাইটার ছিল ৩৪ (ল্যানসেট, ২২ মে)।
রাশিয়ার স্পুটনিক-৫ ভ্যাকসিনটিতে ব্যবহার করা হয়েছে দুইটি হিউম্যান অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর অ্যাড-৫ ও অ্যাড-২৬। প্রথম ডোজে ব্যবহার করা হবে অ্যাড-২৬ ভেক্টর এবং দ্বিতীয় ডোজে অ্যাড-৫। এই ভ্যাকসিনের বিস্তারিত ফলাফল বা রিপোর্ট এখনো কোনো জার্নাল বা প্রি-প্রিন্টে প্রকাশিত হয়নি। তবে স্পুটনিকভ্যাকসিন ডট কম ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ভ্যাকসিনটির ফেইজ-১/২ ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছে ১ আগস্টে এবং ভ্যাকসিনটি মানবদেহে নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি এবং টি-সেল রেসপন্স ঘটাতে সক্ষম হয়েছে।
এমআরএনএ আরেকটি আলোচিত ভ্যাকসিন। আমেরিকার মডার্না এবং জার্মানির বায়োন্টেক/ফাইজার তৈরি করছে এই নতুন ধরনের ভ্যাকসিনটি। মডার্না তাদের ভ্যাকসিনটির প্রি-ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চালায় বানরের ওপর। ভ্যাকসিন প্রয়োগে বানরের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরি হয় ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের বিপরীতে। রক্তে নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি ও ইন্টারফেরন-গামা সমৃদ্ধ টি-সেলের (ঈউ৪+ ঞ পবষষ) উপস্থিতি নির্ণীত হয় আশানুরূপ (নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন, ২৮ জুলাই)। এরপর মডার্না তাদের ভ্যাকসিনের ফেইজ-১ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালায় ৪৫ জন ভলান্টিয়ারের ওপর।
ভ্যাকসিনের দু’টি ডোজ দেয়া হয় ২৮ দিন অন্তর। ভ্যাকসিনটি ১৫-২৯ দিনে রক্তে তৈরি করে ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি, যা কনভালসেন্ট প্লাজমার অ্যান্টিবডির সমান। নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডিও তৈরি হয় রক্তে, চজঘঞ পদ্ধতিতে ১০০ মাইক্রোগ্রাম ভ্যাকসিন ডোজে ৪৩ দিন পরে, যার টাইটার ছিল ৬৫৪, যা কনভালসেন্ট প্লাজমার নির্ণীত অ্যান্টিবডি টাইটারের সমান। এ ছাড়াও ভ্যাকসিনটি সফল টি-সেল রেসপন্স ঘটাতে সক্ষম হয় যেখানে ঈউ৪+ সেলের আধিক্য ছিল (নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন, ১৪ জুলাই)।
বায়োনটেক তাদের দুটো ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেটের ফেইজ-১ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালিয়েছে আমেরিকা ও জার্মানিতে। দুটো ভ্যাকসিনই নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি করলেও শুধু একটি ভ্যাকসিন (ইঘঞ১৬২ন১) টি-সেল রেসপন্স ঘটাতে পেরেছে। তবে কোম্পানিটি তাদের আরেকটি ভ্যাকসিনকে (ইঘঞ১৬২ন২) ফেইজ-২/৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য নির্বাচিত করেছে। তাদের ধারণা ইঘঞ১৬২ন২ ভ্যাকসিনটি বেশি টি-সেল রেসপন্স ঘটাতে সক্ষম। তারা এ নিয়ে আরো পরীক্ষা চালাচ্ছে। বায়োনটেকের কোনো গবেষণাপত্র এখনো কোনো জার্নালে প্রকাশিত হয়নি। তবে তারা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ওপর দুটো পেপার জমা দিয়েছে অনলাইন প্রি-প্রিন্ট পোর্টাল সবফজিরা তে। এই পেপার থেকে দেখা যায়, ভ্যাকসিনটির দুইটি ডোজ দেয়ার পর রক্তে পর্যাপ্ত ভাইরাস নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, যার টাইটার কনভালেসেন্ট প্লাজমার টাইটারের সমান (সবফজিরা, ২০ আগস্ট এবং ফাইজার ডট কম)। এই ভ্যাকসিনটি এখনো নিশ্চিত করে দেখাতে পারেনি এটা পর্যাপ্ত টি-সেল রেসপন্স ঘটাতে পারে।
এবার আসি চীনের আরো দু’টি ভ্যাকসিন নিয়ে। একটি সিনোভ্যাকের করোনাভ্যাক এবং আরেকটি সিনোফার্ম ভ্যাকসিন। দুটো ভ্যাকসিনই তৈরি করা হয়েছে ইনেক্টিভেটেড বা নিষ্ক্রিয় করোনাভাইরাস ব্যবহার করে। ভ্যাকসিন তৈরির এই পদ্ধতি প্রাচীন। সিনোভ্যাক তাদের ভ্যাকসিনের প্রি-ক্লিনিক্যাল স্টাডি চালায় ইঁদুর ও বানরের ওপর। ভ্যাকসিন প্রয়োগের ২-৬ সপ্তাহে ইঁদুর ও বানরের রক্তে পর্যাপ্ত পরিমাণ স্পাইক প্রোটিন অ্যান্টিবডি এবং নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। তারা আরো দেখায় যে, ভ্যাকসিন দেয়া বানর করোনা সংক্রমণ থেকে মুক্ত। তবে ভ্যাকসিন দেয়া বানরের রক্ত পরীক্ষা করে তারা দেখতে পায়, তাদের ভ্যাকসিনটি টি-সেলের ওপর বিন্দু মাত্রও প্রভাব ফেলে না (সাইন্স, ৩ জুলাই)!
এরপর তারা ভ্যাকসিনটির ফেইজ-২ ট্রায়াল চালায় ৬০০ জন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের ওপর। ভ্যাকসিন দেয়ার ৭ ও ২৮ দিন পরে তাদের রক্ত পরীক্ষা করে দেখা যায়, প্রায় ৯৫ শতাংশ ভ্যাকসিন গ্রহীতার রক্তে নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, তবে তার টাইটার ছিল মাত্র ২৩.৮ (লো-ডোজে) থেকে ৬৫.৪ (হাই-ডোজে), যা কি না কনভালসেন্ট প্লাজমায় প্রাপ্ত নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি টাইটারের চেয়ে যথাক্রমে ৭ ও ২.৫ গুণ কম। এই টাইটার নির্ণীত হয় দুই ডোজ ভ্যাকসিন দেয়ার পরে। তাদের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষিত কনভালসেন্ট প্লাজমায় অ্যান্টিবডির টাইটার ছিল ১৬৩.৭। এই ট্রায়ালে টি-সেল রেসপন্স পর্যবেক্ষণ করা হয়নি। বেশির ভাগ বিজ্ঞানীদের মতে, একটি ভ্যাকসিন কাজ করতে হলে তা দিয়ে উৎপাদিত ভাইরাস নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডির টাইটার অন্ততপক্ষে কনভালসেন্ট প্লাজমায় প্রাপ্ত অ্যান্টিবডির টাইটারের সমান হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই ট্রায়ালের ফলাফল এখনো কোনো জার্নালে প্রকাশিত হয়নি, তবে অনলাইন প্রি-প্রিন্ট সার্ভারে একটি পেপার জমা দেয়া হয়েছে (সবফজিরা, ১০ আগস্ট)।
অন্য দিকে সিনোফার্ম তাদের ভ্যাকসিনটির ফেইজ-১ ও ফেইজ-২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালায় যথাক্রমে ৯৬ ও ২২৪ জন ভলান্টিয়ারের ওপর। দুই ডোজ ভ্যাকসিন প্রয়োগের ১৪ দিন পরেই রক্তে তৈরি হয় পর্যাপ্ত ভাইরাস নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি, যার সর্বোচ্চ টাইটার ছিল ২৪৭। এই ট্রায়ালে দেখা যায় ১০০ শতাংশ ভ্যাকসিন গ্রহীতার শরীরে পর্যাপ্ত নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি করতে হলে প্রয়োজন হয় ২৮ দিন অন্তর ৩ ডোজ ভ্যাকসিন। দুই ডোজে শুধু ৮৬ শতাংশ মানুষের দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় (ঔঅগঅ জার্নাল, ১৩ আগস্ট)। এই ট্রায়ালে ভ্যাকসিন পরবর্তী টি-সেল রেসপন্স পর্যবেক্ষণ করা হয়নি।
সিনোভ্যাক বা সিনোফার্ম কোনো ভ্যাকসিনই পশু বা মানব শরীরে টি-সেল রেসপন্স ঘটাতে পারেনি। তার কারণ হলো এ দুটোই ইনেক্টিভেটেড বা কিল্ড ভ্যাকসিন। এ ধরনের ভ্যাকসিন টি-সেল মেডিয়েটেড ইমিউন রেসপন্স করাতে অক্ষম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভ্যাকসিন ইমিউনোলজি চ্যাপ্টারের দিকে তাকালে দেখা যায় ঐতিহাসিকভাবে কোনো কিল্ড ভ্যাকসিনই টি-সেল রেসপন্স ঘটাতে পারে না। সম্প্রতি আরেকটি আলোচিত ভ্যাকসিন হচ্ছে আমেরিকার নোভাভ্যাক্স। এটি একটি রিকম্বিনেন্ট স্পাইক প্রোটিন ভ্যাকসিন, সেখানে এই প্রোটিনটি তৈরি করা হয়েছে মথের শরীরে। এই প্রোটিনটি ম্যাট্রিক্স-এম অ্যাডজুভেন্টের সাথে মিশিয়ে মাংসপেশিতে দেয়া হবে ভ্যাকসিন আকারে। নোভাভ্যাক্সের ফেইজ-১ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানো হয়েছে ১৩১ জন ভলান্টিয়ারের ওপর। ২১ দিন অন্তর দুই ডোজ ভ্যাকসিন যথেষ্ট পরিমাণ নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি করে, রক্তে যার টাইটার ছিল কনভালসেন্ট প্লাজমার নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডির চার গুণ বেশি। ভ্যাকসিনটি টি-সেল রেসপন্স ঘটাতেও সক্ষম হয়েছে শতভাগ (সবফজিরা, ৬ আগস্ট)।
সুতরাং দেখা যায় এতগুলো ভ্যাকসিনের ভেতরে সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম ভ্যাকসিন দু’টি ছাড়া বাকি সব ভ্যাকসিন কাজ করে নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি ও টি-সেল অ্যাকটিভেশনের মাধ্যমে। অন্য দিকে সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম ভ্যাকসিন কাজ করার জন্য নির্ভর করে শুধু নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডির ওপর।
আবার অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর ভ্যাকসিনগুলোরও কিছুটা সমস্যা রয়েছে। একে বলে অ্যান্টি-ভেক্টর ইমিউনিটি। অ্যাডিনোভাইরাস যেহেতু খুব কমন ভাইরাস আমাদের জন্য, তাই অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের শরীর এই অ্যাডিনোভাইরাসের বিরুদ্ধে আগেভাগেই ইমিউনিটি তৈরি করে রাখে। এমনটি হলে অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টরের কার্যকারিতা বাধাপ্রাপ্ত হয়, সেই সাথে ভ্যাকসিনটিরও কার্যকারিতা হ্রাস পায়। এই সমস্যা দেখা দিয়েছে ক্যানসিনোবায়োর ভ্যাকসিনে। কারণ তারা ভেক্টর হিসেবে ব্যবহার করেছে হিউম্যান অ্যাডিনোভাইরাস-৫ (অ্যাড-৫)। এই ভাইরাসটি আমাদের খুব পরিচিত। এই বিপত্তি এড়ানোর জন্যই কিন্তু অক্সফোর্ড ব্যবহার করেছে মানুষের পরিবর্তে শিম্পাঞ্জির অ্যাডিনোভাইরাস, যার বিপরীতে আমাদের ইমিউনিটি নাই বললেই চলে। অন্য দিকে রাশিয়া ব্যবহার করেছে অ্যাডিনোভাইরাস-২৬ (অ্যাড-২৬) ভেক্টর, যা আমাদের কাছে একটি বিরল ভাইরাস।
সম্ভাব্য কার্যকারিতা ও দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষার দিক বিচার করে ভ্যাকসিনগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় : (ক) প্রথম সারির কার্যকরী ভ্যাকসিন : (১) মডার্না, (২) অক্সফোর্ডের চ্যাডক্স-১ ও (৩) নোভাভ্যাক্স; (খ) মধ্যম সারির কার্যকারী ভ্যাকসিন (১) বায়োন্টেক/ ফাইজার (২) ক্যানসিনোবায়ো;
(গ) নিম্নসারির স্বল্পমেয়াদি ভ্যাকসিন (১) সিনোফার্ম (২) সিনোভ্যাক; রাশিয়ার ভ্যাকসিনের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশের পর যদি দেখা যায় যে তাদের ভ্যাকসিনটি কার্যকরী তাহলে তার অবস্থান হবে প্রথম সারির ভ্যাকসিনে। তবে শুধু ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পরেই নিশ্চিত করে বলা যাবে কোন ভ্যাকসিনগুলো প্রকৃতভাবেই কার্যকরী।
ডা: খোন্দকার মেহেদী আকরাম, এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য