থ্যালাসেমিয়া : যেভাবে প্রতিরোধ সম্ভব

ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন | Aug 25, 2020 03:42 pm
থ্যালাসেমিয়া : যেভাবে প্রতিরোধ সম্ভব

থ্যালাসেমিয়া : যেভাবে প্রতিরোধ সম্ভব - ছবি : সংগ্রহ

 

থ্যালাসেমিয়া একটি অনিরাময়যোগ্য বংশগত রক্তরোগ। বাংলাদেশে এ রোগের নীরব মহামারী চলছে। কিন্তু দেশের বেশীর ভাগ মানুষ এই রোগটি সম্পর্কে রয়েছে অজ্ঞাতসারে। বায়োমেডিকেল রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (বিআরএফ) উদ্যোগে পরিচালিত প্রকাশিত (২০১৭) “থ্যালাসেমিয়া ইন সাউথ এশিয়া : ক্লিনিক্যাল লেসনস ল্যার্ন্ট ফ্রম বাংলাদেশ” শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধে প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের শতকরা ১০-১২ ভাগ মানুষ এই রোগের বাহক; অর্থাৎ প্রায় দেড় থেকে দুই কোটির মত মানুষ তাদের অজান্তে এই রোগের বাহক। একই গবেষণায় দেখা গেছে দেশে কমপক্ষে ৬০-৭০ হাজার থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু-কিশোর রয়েছে। গবেষণা প্রবন্ধটি বিখ্যাত ‘অরফানেট জার্নাল অফ রেয়্যার ডিজিজেস’-এ প্রকাশিত হয়। শুধু অসচেতনতার কারনে সহজে প্রতিরোধযোগ্য রোগ হওয়া সত্ত্বেও প্রতি বছর প্রায় ৭-১০ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে।

অন্যের দান করা রক্তই থ্যালাসেমিয়া রোগীদের একমাত্র অবলম্বন
থ্যালাসেমিয়া রোগীকে প্রতিমাসে ১ থেকে ৪ ব্যাগ পর্যন্ত রক্ত নিতে হয়। রোগীরা নিয়মিত রক্ত নিলেও অনেক ধরনের সমস্যা হয়, যার ফলে স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয়। প্রায় ৩০-৩৫ বছরের মধ্যে বেশির ভাগ রোগী মৃত্যুবরণ করে। আমাদের একই গবেষণায় দেখা গেছে এই রোগের চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসে প্রায় ১০-২৫ হাজার টাকা খরচ হয়, যার ভার বহন করার বেশির ভাগ পরিবারের সাধ্যের বাইরে। আক্রান্ত রোগীর পাশাপাশি পুরো পরিবার মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীর দেহে লোহিত রক্তকনিকা ঠিকমতো তৈরি হতে পারে না। এর ফলে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। শিশু জন্মের কয়েক মাস বা বছরের মধ্যে এই রোগটির লক্ষণ প্রকাশ পায়। অন্যতম লক্ষণগুলো হচ্ছে- ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, প্রচণ্ড দুর্বলতা, বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া, জন্ডিস, ঘন ঘন ইনফেকশন হওয়া প্রভৃতি।

বাহকরা শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ
বাহক সাধারণত সুস্থ, তাদের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। এ জন্য অনেকেই বুঝতে পারে না তিনি থ্যালাসেমিয়ার বাহক। অন্যান্য দুরারোগ্য ব্যাধি যেমন ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও ক্যান্সারের চেয়ে থ্যালাসেমিয়া খুব কম খরচে এবং নিশ্চিতভাবে প্রতিরোধ করা যায়। মাত্র কয়েক শ’ টাকা ব্যয় করে জানতে হবে আপনি বাহক কি না। শুধু দু’জন বাহকের বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে সন্তানে এ রোগটি দেখা দিতে পারে। দুই বাহকের মাঝে বিয়ে বন্ধ হলো কখনো এই রোগটি হবে না। তাই সচেতনতা-ই থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের প্রধান হাতিয়ার।

দেশের বেশির ভাগ মানুষ থ্যালাসেমিয়া নামক রোগের নাম-ই শুনেনি!
এ বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা পেতে বিআরএফ একটি গবেষণা করে জামালপুর জেলার চারটি উপজেলার ১১টি কলেজে। মোট ১৫৭৮ জন ছাত্রছাত্রীদের ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ স্টুডেন্ট থ্যালাসেমিয়া নামক রোগের নাম-ই শুনেনি, যদিও এই জরিপের মাসখানেক আগে ডিজি হেলথ সচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশের সব মোবাইলে ফোনে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে খুদে বার্তা পাঠিয়েছিল! যারা নাম শুনেছেন তাদের বেশির ভাগ সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের (৮২.২%)। অন্য দিকে আর্টস (১৬%) এবং কমার্স (২২%) ব্যাকগ্রাউন্ডের ছাত্রছাত্রীদের বেশির ভাগ নাম শুনেনি। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে বিজ্ঞান শাখার নবম শ্রেণীর বায়োলজির পাঠ্যক্রমে থ্যালাসেমিয়া বিষয়ে কয়েক লাইন আলোকপাত করা হয়েছে, যার তারা নাম শুনেছে। দেশে প্রায় ২০ ভাগ স্কুল স্টুডেন্ট সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করে যারা মূলত শহরকেন্দ্রিক। দেশের প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ গ্রামাঞ্চলে বাস করেন। যারা এই রোগের নাম শুনেছেন তাদের জ্ঞানের স্বল্পতা এবং সামাজিক কুসংস্কারাচ্ছন্নতার কারণে থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করেন। বাহকরা সুস্থ হলেও সচেতনতার অভাবে প্রায় ৭০% স্টুডেন্ট বাহকদে সুস্থ মনে করেন না।

পিতামাতারা অনুশোচনায়
বিআরএফ এবং বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি হাসপাতাল (আক্রান্ত সন্তানের পিতামাতা দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠান) সাম্প্রতিককালে ৩৬৫ থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত পরিবার নিয়ে একটি গবেষণা করে যেখানে ৬০টি পরিবারে কমপক্ষে দু’জন সন্তান থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ছিল। সন্তানের মাতা বা পিতাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- আপনারা যদি থ্যালাসেমিয়ার ভয়াবহতার কথা জানা থাকলে তবে কি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতেন? পূর্ব থেকে এই বিষয়ে আঁচ করতে পারলে শতকরা ৯৭% পিতামাতা কখনোই বিয়ে করতেন না বলে জানাম। প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ পিতামাতা এই রোগ হওয়ার জন্য নিজেদের দোষী মনে করেন আফসোস করেন। সন্তানের এই রোগ হওয়ার আগে তারা থ্যালাসেমিয়ার নাম শুনেননি। ৪০ ভাগ ভোক্তভোগী পিতামাতা সামাজিকভাবে অপবাদ বা বঞ্চনার শিকার এবং ৭৭ ভাগ পরিবার সন্তানের জন্য নিয়মিত রক্ত জোগাড় করতে সমস্যার মুখোমুখি হন যা আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে।

করোনায় রোগীরা চরম দুর্গতিতে
লকডাউন ও করোনার সংক্রমণের ভয়ের কারণে রক্তদাতারা রক্ত দান করতে আগ্রহী নয়। এ জন্য গত কয়েক মাসে রোগীরা পর্যাপ্ত রক্ত সংগ্রহ করতে পারেনি, যা আমাদের মাঠপর্যায়ের স্টাডিতে উঠে এসেছে। কমিউনিটি পর্যায়ে দেশে রক্তের বড় ক্রাইসিস রয়েছে। রক্তদান কর্মসূচির মাধ্যমে দেশে মূলত রক্ত সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জেলা পর্যায়ের ব্ল্যাড ব্যাংকে সংরক্ষিত রক্ত বেশিদিন রাখা যায় না। অপর্যাপ্তভাবে রক্ষিত রক্ত দিয়ে ট্রান্সফিউশন করলে ইমিউনোলজিক্যাল রিঅ্যাকশনের কারণে রোগী মারা যেতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে মাত্র ৩০ ভাগ রক্ত সংগ্রহ করা হয় ভলান্টারি ডোনারে মাধ্যমে। স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতা সংস্থা বা ক্লাবগুলোর কার্যক্রম মূলত শহর বা সিটি এলাকায় সীমাবদ্ধ।

সচেতনতাই প্রতিরোধের প্রধান হাতিয়ার
শুধু অবিবাহিত তরুণ-তরুণীর মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি এবং থ্যালাসেমিয়ার বাহক নির্ণয়ের হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস টেস্ট সহজলভ্য এবং সহজপ্রাপ্ত করার মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। বর্তমানে দেশে মূলত ঢাকায় থ্যালাসেমিয়া বাহক নির্ণয়ে টেস্ট করার ব্যবস্থা রয়েছে। জীবনে মাত্র একবার টেস্ট করাই যথেষ্ট। বিয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে (যখন সব কিছু প্রায় পাকাপাকি) থ্যালাসেমিয়া বাহক বা স্ক্রিনিং টেস্ট বাধ্যতামূলক করার কার্যক্রম মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো কার্যকরী হয়নি। বর-কনে দু’জনে বাহকের অবস্থা জানার পরও বিয়ে করেছে, কেননা শেষ সময়ে কেউ বিয়ে ভেঙে দিতে চায় না। প্রসঙ্গত, সৌদি আরবে বিয়ে রেজিস্ট্রির সময় থ্যালাসেমিয়াসহ অন্যান্য রক্তের টেস্ট রিপোর্ট জমা দেয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে সৌদি আরবে কলেজ স্টুডেন্টদের শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ থ্যালাসেমিয়া নামক রোগের নাম-ই শুনেনি! তাই যথাযথ সচেতনতা ছাড়া আইন করে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ করা দুরুহ ব্যাপার। থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের সরকারি পলিসি গ্রহণের সময় এই বিষয়টি মাথায় রাখা জরুরি।

সবচেয়ে আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে গুরুত্ব না দেয়া হলে আমাদের অজান্তে দিন দিন বাহক এবং রোগীর সংখ্যা বাড়তেই থাকবে যখন সুখী পরিবার গড়ে তোলা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হবে। থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের মাধ্যমে একটি পরিবারের দুর্বিষহ জীবন থেকে পরিত্রাণের পাশাপাশি দেশের স্বাস্থ্যখাতের অনেক রিসোর্চ এবং অর্থ সাশ্রয় হবে।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন (বিআরএফ), বাংলাদেশ ও
এসোসিয়েট প্রফেসর, ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ (আইইউবি)


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us