‘সাধারণ সম্পদ’ আত্মসাতের ভয়াবহ পরিণতি
‘সাধারণ সম্পদ’ আত্মসাতের ভয়াবহ পরিণতি - ছবি : সংগ্রহ
‘সাধারণ সম্পদ’ হলো সেই সম্পদ, যার মালিক কোনো একক ব্যক্তি নয়; বরং কোনো দেশ বা সমাজের অনেকে বা সবাই এতে অংশীদার। সব ধরনের রাষ্ট্রীয় ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সম্পদ, ধর্মীয় ও সামাজিক সম্পদ, কোনো জনগোষ্ঠীর যৌথ সম্পদ যেমন- কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ, ত্রাণ তহবিল, জাতীয় খাদ্যভাণ্ডার, রেলওয়ের জমিজমা, মন্ত্রী-এমপিদের থোক বরাদ্দ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের সম্পদ, ত্রাণের মাল ইত্যাদি সবই ‘সাধারণ সম্পদ’ হিসেবে গণ্য।
বিধিবহির্ভূতভাবে, প্রভাব খাটিয়ে, ছলচাতুরী করে, তথ্য গোপন করে অন্যায়ভাবে ‘সাধারণ সম্পদ’ ভোগ-ব্যবহার করা, আত্মসাৎ করা এবং স্বজনপ্রীতি করে, পক্ষপাতিত্ব করে তা অন্যকে দিয়ে দেয়া বা পাইয়ে দেয়া অথবা আত্মসাতে সহযোগিতা করা স্পষ্টত হারাম কাজ। ইসলাম এই কাজকে ‘জুলম’ হিসেবে গণ্য করেছে। রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন : তোমরা জুলুম থেকে বিরত থাকো, কেননা জুলুম কিয়ামতের দিন ‘জুলুমাত’ বা গহিন অন্ধকারে পরিণত হবে। ইসলাম এই সীমালঙ্ঘনের আকার ও গুরুত্ব বিবেচনায় ‘হাদ’ (যেমন চুরি করা প্রমাণিত হলে হাত কেটে দেয়া) ও ‘তাজির’ (দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি)-এর বিধান দিয়েছে। এক্ষেত্রে ‘জুলম’ করা মানে হলো অন্যের ওপর জুলুম করা এবং নিজের ওপরও জুলুম করা। কারণ, অন্যের অধিকার হরণ করা বা নষ্ট করা যেমন জুলুম তেমনি নিজেকে অপরাধের দিকে ধাবিত করে নিজের ক্ষতি করা ও নিজেকে জাহান্নামের দিকে চালিত করাও জুলুম হিসেবে গণ্য। আর আল্লাহ তায়ালা জালিম বা অত্যাচারীকে পছন্দ করেন না।
যুদ্ধলব্ধ গণিমতের মাল ‘সাধারণ সম্পদ’ হিসেব গণ্য। গণিমতের মাল আত্মসাৎ করার পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘যে ব্যক্তি আত্মসাৎ করবে, কিয়ামাতের দিন সেই আত্মসাৎকৃত বস্তু নিয়ে সে উপস্থিত হবে। অতঃপর সে যা (পাপ) অর্জন করেছে তা তাকে পরিপূর্ণভাবে দেয়া হবে। আর তাদের প্রতি কোনো অন্যায় করা হবে না।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৬১)
‘সাধারণ সম্পদ’ আত্মসাৎ করা এমন একটি মারাত্মক পাপ যা থেকে তওবা করার সুযোগ খুবই সঙ্কীর্ণ। কেউ যদি কোনো ব্যক্তিবিশেষের সম্পদ আত্মসাৎ করে তাহলে কোনো একসময় শুভ বুদ্ধির উদয় হলে এবং কৃত অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হলে পাওনাদারকে তার প্রাপ্য সম্পদ পরিশোধ করে দিয়ে অথবা তার কাছে ক্ষমা চেয়ে তা থেকে তওবা করার সুযোগ পাওয়া সম্ভব। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সম্পদের সাথে লক্ষ কোটি মানুষ কিংবা কখনো দেশের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার জড়িত থাকতে পারে, যা থেকে তওবা করা প্রায় অসম্ভব।
মনে করুন, কোনো একজন কর্তাব্যক্তি ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে নির্মাণাধীন একটি সেতু নির্মাণের কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য কোনো দেশী বা বিদেশী কন্ট্রাকটরের কাছ থেকে ৫% হারে ১০০ কোটি টাকা ঘুষ নিলো। অতঃপর সেই কন্ট্রাকটর নিম্নমাণের কাজ করে পুরো বিল তুলে নিলো। এরপর এই অর্থের কিছু অংশ বিদেশে পাচার করে দিলো এবং বাকিটা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সামাজিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন কাজে খরচ করে ফেলল। জীবনের শেষে এসে তার এই পাপ থেকে তওবা করার ইচ্ছা হলো। এখন হয়তো তার কাছে এমন পরিমাণ জমাকৃত অর্থ নেই যার মাধ্যমে অতীতের দোষ স্বীকার করে ১০০ কোটি টাকা ফেরত দিয়ে সে তওবা করতে পারে। আবার এই সম্পদের মালিক দেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যেকের কাছ থেকে আলাদাভাবে ক্ষমা চেয়ে তাদের কাছ থেকে ক্ষমা আদায় করাও অতিশয় কঠিন একটি কাজ। এটি এমন বড় একটি বিপদ যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
অথবা মনে করুন, কেউ বন বিভাগের তত্ত্বাবধানকারী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বছরের পর বছর ধরে ঘুষ খেয়ে লোকদের বনের ছোটো-বড় গাছপালা চুরি করার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছেন। জীবনের শেষ ভাগে এসে তিনি যদি তওবা করতে চান তাহলে এই ব্যক্তি ১৬ কোটি মানুষের মালিকানাধীন রাষ্ট্রীয় সম্পদের কী পরিমাণ ক্ষতি করেছেন তা পরিমাপ করতেও সক্ষম হবেন না; তা ফেরত দেয়া তো দূরের কথা।
অথবা কোনো দুর্নীতিবাজ সিটি মেয়র বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াম্যান বা মেম্বারের কথা ধরি। তিনি যেসব মানুষের রিলিফ/ত্রাণ চুরি করেছেন তা থেকে কি তার পরিত্রাণ পাওয়া সহজ? তিনি কি পারবেন প্রতিটি হকদারের কাছে চুরিকৃত সম্পদ বা অর্থ ফেরত দিতে অথবা জীবিত-মৃত প্রত্যেক হকদারের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে ক্ষমা নিতে?
অনেকে মনে করেন, সরকারের সম্পদ তো নির্দিষ্ট ব্যক্তির সম্পদ নয়, আর এতে তো আমারও ভাগ আছে। সুতরাং সুযোগ পেয়েছি এখন অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করে ধনী হয়ে নেই। পরে ভালো কাজ করে, নামাজ রোজা হজ জাকাতের মাধ্যমে এবং দান-সদকা করে তওবা করে নেবো। এই সম্পদ যেমন তার দুনিয়ার শান্তি স্বস্তি কেড়ে নেবে তেমনি আখিরাতে লক্ষ কোটি পাওনাদারের ক্ষতিপূরণস্বরূপ তার কৃত নেক আমলগুলো পরিশোধ করতে নিঃস্ব অবস্থায় সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, তোমরা কি জান নিঃস্ব ব্যক্তি কে?
সাহাবিগণ বললেন, আমাদের মধ্যে নিঃস্ব হলো সেই ব্যক্তি যার কোনো অর্থ-কড়ি ও ধন-সম্পদ নেই। তখন তিনি বললেন, বরং আমার উম্মতের মধ্যে সেই ব্যক্তিই নিঃস্ব যে কিয়ামতের দিন সালাত, সাওম ও জাকাত নিয়ে উপস্থিত হবে। অতঃপর সে এমন অবস্থায় আসবে যে, সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, অমুকের সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, অমুকের রক্ত ঝরিয়েছে, অমুককে প্রহার করেছে। অতঃপর একজন লোকদের তার নেক আমল থেকে দিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর যদি সব পাওনাদারের পাওনা পরিশোধ করার আগেই তার নেক আমল শেষ হয়ে যায় তাহলে (সে ঋণের পরিবর্তে) তাদের পাপের একাংশ তার প্রতি নিক্ষেপ করা হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সহিহ মুসলিম)
আর মানুষের সম্পদ আত্মসাৎ করে হৃষ্টপুষ্ট হওয়া শরীর ও পোশাক নিয়ে যে ব্যক্তি ইবাদাত বন্দেগি করবে তার ইবাদত ও দোয়া আল্লাহ্ তায়ালা কবুল করবেন এবং এর বিনিময়ে তাকে জান্নাত দিয়ে দেবেন এমনটি আশা করাও সঠিক নয়। হজরত আবু হুরাইরা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র তিনি পবিত্র বস্তু ছাড়া কিছুই কবুল করেন না। আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর প্রেরিত রাসূলদের যে নির্দেশ দিয়েছেন মুমিনদেরকেও সে নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ‘হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র ও হালাল জিনিস আহার করো এবং ভালো কাজ করো। আমি তোমাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে জ্ঞাত। (আল-মু’মিনুন : ৫১) তিনি (আল্লাহ) আরো বলেছেন, ‘তোমরা যারা ঈমান এনেছো, শোনো, আমি তোমাদের যেসব পবিত্র জিনিস রিজিক হিসেবে দিয়েছি তা খাও। (সূরা : বাকারা : ১৭২) অতঃপর তিনি এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত দীর্ঘ সফর করে ক্লান্ত-শ্রান্ত। ফলে সে ধুলায়-ধূসরিত রুক্ষ কেশধারী হয়ে পড়ে। অতঃপর সে আকাশের দিকে হাত তুলে বলে, ‘হে আমার রব! হে আমার রব! অথচ তার খাবার হারাম, পানীয় হারাম, পরিধেয় বস্ত্র হারাম এবং সে হারাম খাদ্য খেয়ে বেঁচে আছে। কাজেই এমন ব্যক্তির দোয়া কিভাবে কবুল করা হবে? (সহিহ্ মুসলিম)
এক সাহাবি তার ওপর অর্পিত রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকালে প্রাপ্ত কিছু উপহার-সামগ্রীকে নিজের হক মনে করেছিলেন। তিনি জাকাত সংগ্রহকারী হিসেবে জাকাত সংগ্রহ করে জাকাতের বাইতুল মালে সঠিকভাবে জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু লোকজন তাকে ভালোবেসে যেসব উপহার সামগ্রী দিয়েছিল তা তিনি তার নিজের জন্য রেখে দিয়ে ছিলেন। তখন রাসূল সা: তাকে উদ্দেশ করে বলেন : সে কেন তার বাবা-মায়ের বাড়িতে বসে থাকে না, তখন সেখানে তার নিকট উপহার সামগ্রী পৌঁছবে। কিয়ামতের দিন এই আত্মসাৎকৃত সম্পদ আত্মসাৎকারীর বিরুদ্ধে স্বাক্ষী হিসেবে উপস্থিত হবে মর্মেও তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন। তখন সে উক্ত সম্পদ পিঠে বহন করবে এবং তাকে এ অবস্থা থেকে মুক্ত করার মতো কেউ থাকবে না। (বুখারি ও মুসলিম)
খোলাফায়ে রাশেদিন ও সালফে সালেহিন (সৎকর্মশীল পূর্বসূরিগণ) সাধারণ সম্পদ তসরুফ করা বা আত্মসাৎ করা থেকে নিজেদের বিরত রাখার ক্ষেত্রে উত্তম অনুসরণীয় আদর্শ ছিলেন। তাঁরা ‘বায়তুল মাল’ (সরকারি কোষাগার) থেকে অতীব প্রয়োজন ছাড়া কিছুই গ্রহণ করতেন না। তারা ইয়াতিমের অভিভাবকের ন্যায় মুসলিমদের সম্পদের অভিভাবক ছিলেন। ফরাসি সৈন্যরা মুসলিমদের কাছে পরাজিত হওয়ার পর একজন সৈনিক কিসরার মূল্যবান সম্পদরাজি নিয়ে এলো এবং তা মদিনায় এসে পুরোপুরিভাবে উমার রা:-এর নিকট হস্তান্তর করল। তখন উমার রা: ওই ব্যক্তির আমানতদারিতে আশ্চর্য হলেন। অথচ এই দীর্ঘ সফরের মধ্যে সে যা ইচ্ছা আত্মসাৎ করতে পারত।
অবৈধ সম্পদের ফলে বেড়ে ওঠা প্রতিটি মাংস পিণ্ডের জন্য আগুনই অধিক উপযোগী। তাই ব্যক্তি বিশেষের হক নষ্ট করা থেকে যেমন বিরত থাকতে হবে তেমনি জনসাধারণের সম্পদ আত্মসাৎ করা, আত্মসাতে সহযোগিতা করা এবং এর সাথে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হওয়া থেকে সাবধান থাকতে হবে। কারণ তা জান্নাত নয় জাহান্নামের পথকেই সুগম করবে। আল্লাহ্ তায়ালা সবাইকে এই মারাত্মক অপরাধ থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দিন। আমিন!
লেখক : তুলনামূলক ফিক্হ, দাওয়াহ্ ও ইসলামী ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞ, শরিয়াহ্ পরিদর্শক, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক লিঃ।
ই-মেইল : mizanbd2004@gmail.com