সিনহা : পরিবর্তনের পথিকৃত
মেজর (অব:) সিনহা - ছবি : সংগ্রহ
জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য, একমাত্র ভাষা আন্দোলন ছাড়া জনগণের কোনো আন্দোলন সফল ও সার্থক হয়নি। কারণ শিক্ষিত ও সচেতন লোকেরা মনে করেন এটা রাজনীতির ব্যাপার। রাজনীতিবিদরা যা করবেন সেটাই সঠিক। মুক্তচিন্তার সচেতন বুদ্ধিজীবীর অভাবে জনগণের সংগ্রাম ও রক্তদান অনেকটাই বিফলে গেছে। জনগণের রক্তে অর্জিত স্বাধীন দেশের জনগণই আজ অধিকারহীন ও অসহায়। অর্থাৎ স্বাধীন হয়েও স্বাধীন নই।
মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা ছিল দেশের জনগণের মুক্তি বা অধিকার নিশ্চিত করা এবং ব্যক্তির মুক্তিকে শাশ্বত করে তোলার ব্যাপারে এবং জনগণের অধিকার বা ফ্রিডম রক্ষায় দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের থাকবে আধিপত্য, এমনটিই আশা করা স্বাভাবিক ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ ছিল আমাদের নিজস্ব যুদ্ধ, মূল দায়িত্ব ছিল আমাদের মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্থবহ করার সাহসী ভূমিকা পালনের। আমরা তো তাদের বীরত্বের স্বীকৃতি হিসেবে নানাভাবে ভূষিত করেছি। অনেক পদক দিয়েছি। এখনো অনেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। ভালো কথা।
একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারকে পুলিশ নৃশংসভাবে হত্যা করায় মুক্তিযোদ্ধা ও সামরিক বাহিনীর লোকেরা বিক্ষুব্ধচিত্তে সুবিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। অবশ্যই এটা তারা ঠিক কাজ করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশটির জন্মলগ্ন থেকেই যে ক্রসফায়ারে হত্যা, নির্যাতন এবং জোরপূর্বক অপহরণের ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে তাও তো তাদের অজানা থাকার কথা নয়। বিচারব্যবস্থা যদিও ভেঙে পড়েছে; তার পরও আমরা প্রত্যাশা করব হত্যাকারীরা সাজা পাবে। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা আর তার জীবন ফিরে পাবেন না কিংবা লুটপাটের জন্য মানুষ হত্যা করার সহজ ব্যবস্থাও বদলাবে না। তবু স্বীকার করতে হবে সিনহার হত্যা নিয়ে যেভাবে ক্ষোভের প্রকাশ পেয়েছে তাতে জনমনে কিছুটা সাহস এনেছে।
বিষয়টি ভুলবার মতো নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, মেজর সিনহার খুনিদের বিচার হলেও খুন-গুমের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থেকে জনগণ কতটা মুক্তি পাবে। বিষয়টির তদন্ত গভীরে গেলে দেখা যাবে কত ব্যাপক। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে থেকে একজন ওসির নির্দেশে পুলিশ মেজর সিনহার ওপর একের পর এক গুলি ছুড়েছে। পুলিশ অফিসারকে কোনো কিছু ভাবতে হয়নি। জনগণ অধিকারহীন অসহায় বলেই যে যেভাবে পারছে তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের ধন-সম্পত্তি নিয়ে নিচ্ছে। টেকনাফ থানার ওসির নির্দেশে পুলিশের লোকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহাকে প্রকাশ্যে গুলি করে মেরে ফেলল। অন্য ওসিরাও বহু লোক হত্যা করে প্রচুর অর্থ কামিয়েছে। তারা অনেকেই সাধারণ জনগণের জমিজমা অন্যায়ভাবে হাতিয়ে নিয়েছে। ক্রসফায়ারে মানুষ মারা পুলিশের জন্য স্বাভাবিক হয়ে গেছে। পুলিশকে সঠিক পথে রাখা যে কত কঠিন হয়ে গেছে; তা একটু নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করলেই বোঝা যাবে। এটাও সত্য যে, একশ্রেণীর ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়ে থেকে পুলিশের অপরাধপ্রবণতা বেড়ে গেছে।
স্বাধীন হওয়ার পরপরই রক্ষীবাহিনী গঠনের পর বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করে তার কাছে এ কথা ব্যাখ্যা করেছিলাম যে, নয় মাস ধরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অত্যাচারের পর এখন আর পাকিস্তানপন্থী শত্রু বলতে কেউ নেই। সবাই চেয়েছেন সামরিক নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে। পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে। বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ ঐক্যবদ্ধ দেশ হিসেবেই আছে। বিনাবিচারে হত্যা করার মতো শত্রু দেশের মধ্যে নেই।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, গুপ্ত হত্যার অনুশীলন শুরু করাটাই ছিল একটা মারাত্মক ভুল পদক্ষেপ। হত্যা, গুমের যে রাজনীতি চলছে; তা থেকে বেরিয়ে আসা খুবই কঠিন হবে। কিছু বুদ্ধিজীবী জাতির প্রত্যাশা পূরণে নির্যাতন সহ্য করেছেন, কারাবরণ করেছেন অথবা তাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছেন। কিন্তু তাদের এই ভূমিকা রাষ্ট্রীয় শক্তির সহযোগিতার মাধ্যমে নস্যাৎ করা হয়েছে। দেশটিকে হত্যা, গুম ও দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করা হয়েছে, যার বিরুদ্ধে বাধা দেয়ার মতো শক্তি অর্জন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। হতেও পারে না। ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রত্যেকের অধিকার ও মর্যাদার বিষয়। তাই অধিকার সচেতন শিক্ষিত লোকেরা সুবিধাবাদী ভূমিকায় থাকলে দেশ জমিদারি স্টাইলে চলবে। জনগণ রক্ত দেবে কিন্তু অধিকার বঞ্চিত থাকবে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এমন কিছু মারাত্মক ত্রুটি রয়েছে, যা শিক্ষিতদের চাকরিপ্রার্থী ও নতজানু হতে শেখাচ্ছে। স্বাধীন দেশে শিক্ষিত লোকদের জ্ঞান এবং দূরদৃষ্টিকে দেশের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষায় অপরিহার্য মনে করা হয়। শিক্ষিত সচেতন লোকেরাও সেভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেন। দেশ ও জনগণের স্বার্থকে বড় করে দেখেন। কিন্তু সাধারণভাবে বলতে গেলে আমাদের শিক্ষিতজনেরা এ সত্য উপলব্ধি করতে পারছেন না। নিজেদের সুবিধার জন্য তারা মনে করেন দেশ রাজনীতিবিদদের, নিজেদের সুযোগ-সুবিধা ঠিক থাকলেই হলো। বিষয়টি তাদের নিজেদের জন্যও লজ্জাকর।
সরকার পরিচালনায় যেখানে সুশিক্ষা, সৎ চরিত্রের অভাব প্রকট সেখানে বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা তো থাকবেই। একজন বাস চালকেরও তার নিজস্ব পেশাগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় নেতৃত্বদানের জন্য জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ লোকের প্রয়োজন নেই। ফলে রাজনীতি দাঁড়িয়েছে পুরোপুরি টাকা-পয়সা অর্জনের ব্যবসা হিসেবে।
আমরা কথায় কথায় এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের কথা বলে থাকি। কাদের রক্তে? জনসাধারণের রক্তে। জনগণের রক্তেই দেশ স্বাধীন হয়েছে। ভারতসহ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পাওয়া গেছে। নেতারা তো কেউ দেশেই ছিলেন না।
দেশ স্বাধীন করার কয়েক বছরের মধ্যেই কয়েক মিনিটের ব্যবধানে জাতিকে সব অধিকার ও জনগণপ্রদত্ত শাসনতন্ত্র থেকে বঞ্চিত করা হলো। এ পরিবর্তনকে সাংবাদিক, শিক্ষক এবং অসংখ্য শিক্ষিত লোককে মিছিল করে স্বাগত জানাতে দেখা গেল। আনন্দ উৎসবও কম করা হয়নি। তাদের অশিক্ষিত, আহম্মক বলা যাবে না। বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা হলো। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সব রাজনৈতিক অর্জন ম্লান হয়ে গেলও শিক্ষিত লোকেরা কোনো প্রতিবাদ করলেন না।
এদেশের জনগণ জীবন দিয়েছে বাংলাদেশকে আর একটি স্বৈরশাসনের পাকিস্তান সৃষ্টি করার জন্য নয়। জনগণ চেয়েছে বাংলাদেশ হবে গণতন্ত্রভিত্তিক একটি আদর্শ রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের নেতারাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জনগণের শক্তি সমর্থন ব্যবহার করেছেন। দুঃখের বিষয় তাদের হাতেই গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটেছে। জনগণের ভোটের অধিকার তাদের স্বাধীনতার অধিকার। আমাদের ভোটের অধিকার তাই তামাশার ব্যাপার হয়েছে।
বিগত নির্বাচন সম্পর্কে রসিকতা করে বলা হয়, পুলিশ স্বাধীনভাবে ব্যবহৃত হয়েছে নির্বাচনী ফল ঘোষণা করার কাজে। অর্থাৎ নির্বাচনী ফল ভোটের আগেই চূড়ান্ত করা হয়েছে।
দ্বিতীয় বিপ্লবী রাজনীতি শেষ হওয়ার পরও যেকারো পক্ষে দেশের জনগণকে তাদের মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত করতে অসুবিধা হচ্ছে না। জনগণের ভোটের তোয়াক্কা না করে সরকার গঠন করা যায়, রাষ্ট্রীয় শক্তিগুলোর সমর্থন পাওয়া যায়। জনগণের পক্ষে কাউকে পাওয়া যায় না। যারা জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করল সেই জনগণের প্রতি এতটুকু কৃতজ্ঞতাবোধও দেখানো হচ্ছে না। স্বাধীন দেশের বড় কথাই হলো দেশের মালিক জনগণের ভোটাধিকার।
স্বাধীনতা অর্জন করার অর্থ হচ্ছে জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা, যার দায়িত্ব জনস্বার্থ ও জনগণের অধিকার এবং জনগণ প্রদত্ত শাসন মেনে চলা। ক্ষমতাসীনরা সেই শপথ নিয়ে মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হন। রাজনীতিতে তর্ক-বিতর্ক, সমালোচনা থাকবে, বাদ-প্রতিবাদও থাকবে কিন্তু জনগণের সরকার হবে আমাদের সকলের সরকার। সরকার কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্য হবে না।
পাকিস্তানের সংহতি বিনাশের পেছনে কাজ করেছিল কিছু রাজনৈতিক নেতা এবং সামরিক জেনারেল। ১৯৭১ সালে পূর্ব-পাকিস্তানে দীর্ঘ নয় মাস ধরে সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ চালানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। এ দেশের মালিক যে জনগণ তারা ছিল অন্ধকারে, কী ঘটেছে এবং তার পরিণতি কী হবে সে সম্পর্কেও তারা কিছুই জানতো না। হঠাৎ করে ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী আক্রমণ করল। জনগণের পাশে থেকে দুর্গ গড়ে তোলা তো দূরের কথা, নেতারা কে কোথায় গেলেন তাও বলে যাননি।
আমি যা বলতে বা বোঝাতে চাইছি তা হলো, সব দেশেই শিক্ষিত লোকদের দায়িত্ব হচ্ছে দেশ শাসনে জনগণের মালিকানা এবং অধিকার ভোগে সচেতন থাকা। শিক্ষিত লোকদের সচেতনা ভিন্ন কোনো দেশেই জনগণের অধিকার সংরক্ষিত থাকতে পারে না। সব ধরনের অন্যায়-অবিচার মানব না বলেই তো আমরা পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি।
জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে রাজনৈতিক নেতাদের প্রয়োজন জনমতের ভিত্তিতে দেশের সঠিক নেতৃত্বদানের জন্য। কিন্তু দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাদের উপর জনগণের অন্ধ আস্থা কোনো দেশেই রাখা হয় না। বিষয়টি প্রতিটি শিক্ষিত লোকের জানার কথা। ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সংরক্ষণ করা হয়। সংবাদপত্র ও বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয় যাতে ক্ষমতাসীনরা সমালোচনা বা আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে না পারেন। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের জবাবদিহি অপরিহার্য করা হয়।
শিক্ষিত লোকদের মানসিক সঙ্কট এখানেই যে, তারা জনগণের সুখ-দুঃখের সাথে একাত্ম হতে পারছেন না। নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষা ছাড়াও প্রয়োজন হয় নাগরিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা। এই উপলব্ধির অভাবে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ শেষ হচ্ছে না। সম্পূর্ণ ভয়-ভীতির মধ্যে থাকতে হচ্ছে।
আমেরিকার মতো শক্তিশালী দেশের দিকে লক্ষ করুন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখনই নিজের খেয়াল-খুশি মতো ক্ষমতা প্রয়োগ করতে যাচ্ছেন সাথে সাথে সেখানকার বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষিত লোকেরা তার বিরোধিতা করছেন। ট্রাম্প নিজে তার সরকার পরিচালনায় যাদের নিয়োগ দিয়েছেন; তারা দেশের প্রতি পর্যাপ্ত দায়িত্ববোধে উজ্জীবিত হয়ে চাকরি হারাবার ঝুঁকি নিয়ে বিরোধিতা করে যাচ্ছেন। দেশ পরিচালনায় ট্রাম্প যে আনারি এবং তার দ্বারা যে জাতীয় স্বার্থের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, এসব কথা তারাই উচ্চকণ্ঠে প্রচার করছেন। অর্থাৎ, সরকারকে জনস্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব সম্পর্কে চিন্তায় থাকতে হয়।
দেশ রাজনৈতিক নেতাদের নয়, দেশ জনগণের। যে যেখানে থাকি না কেন, শিক্ষিত লোকদের চেতনায় ও উপলব্ধির ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন আসতে হবে। পুরনো দিনের গোলামি মানসিকতা বর্জন করতে হবে।