নিঃসঙ্গ ভিক্ষুর জীবন বেছে নিয়েছেন সিকিমের এই রাজা
নিঃসঙ্গ ভিক্ষুর জীবন বেছে নিয়েছেন সিকিমের এই রাজা - ছবি : সংগৃহীত
ওই দিনের বিকালটা ছিল ঠাণ্ডা। জোর বাতাস বইছিল। তারিখটা হলো ১৯৮২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকমুখী পাহাড়ে ৩৪১ বছরের এক রাজত্বের অবসান হচ্ছিল ওই দিন।
শহর থেকে অনেক উঁচুতে লুকশ্যামার রাজকীয় দাহচত্বরে সিকিমের ক্ষমতাচ্যুত ১২তম চোগিয়াল পালডেন থোনদুপ নামগ্যালের প্রাণহীন শরীরটাকে পুড়িয়ে ছাই করা হচ্ছিল।
কিন্তু দাহচত্বরের সাত কিলোমিটার দূরে কিছুটা নীরবে আরেক আনুষ্ঠানিকতা চলছিল। ঊনবিংশ শতকের ভিক্টোরিয়ান কুটির চোগিয়ালের সুক-লা-খাং প্রাসাদে তখন নতুন রাজার অভিষেক চলছিল। তার ছেলে তেনজিং তোপগ্যাল ওয়াংচুক সিসুম নামগ্যালকে (২৯) নতুন দেনজোং (সিকিম) চোগিয়াল হিসেবে ‘অনানুষ্ঠানিকভাবে’ বরণ করা হচ্ছিল।
প্রাসাদের ড্রইং রুমে সাধারণ মানুষ, প্রবীণজন, ভুটানের রাজপরিবারের আত্মীয়-স্বজন এবং ১০ জন আইন প্রণেতা – যাদের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী নর বাহাদুর ভাণ্ডারির মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন ছয়জন – এরা একে একে অভ্যর্থনা কক্ষে প্রবেশ করে সিংহাসনে বসা ওয়াংচুককে ঐতিহ্যবাহী ‘খাদাস’ বা স্কার্ফ দিয়ে বরণ করে নিচ্ছিলেন এবং তাকে সিকিমের ১৩তম চোগিয়াল হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছিলেন।
সিকিমের জাতীয়তাবাদী উষ্ণতায় বাতাস ছিল ভরপুর। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গার ৬৪টি মঠ থেকে আসা বিশিষ্ট বৌদ্ধ লামারা নতুন ‘সম্রাটের’ সাফল্য কামনা করে মন্ত্র আওড়াচ্ছিলেন। সিকিমের নিষিদ্ধ জাতীয় পতাকা উড়িয়ে স্কুল শিক্ষার্থীরা শ্লোগান দিচ্ছিল: ‘দেনজোং চোগিয়াল দীর্ঘজীবী হোন’। ওই অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সিকিমের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ভিম বাহাদুর গুরুং। তখন সেখানকার অবস্থা স্মরণ করে এই কথাগুলো বলছিলেন তিনি।
গুরুং জাতিগত নেপালি রাজনীতিবিদ। চোগিয়ালের প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত করা এবং রাজ্য ধ্বংস করার পেছনে সিকিমের যে ৩২ জন রাজনৈতিক নেতা ভূমিকা রেখেছিলেন, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। পরে অবশ্য তিনি স্বতস্ফূর্তভাবে চোগিয়ালের স্বাধীনতার দাবিকে সমর্থন করেছিলেন।
নব্বই বছর বয়সী গুরুং সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বললেন, “ওয়াংচুককে তেরোতম দেনজোং চোগিয়াল হিসেবে অভিষেকের ঘটনাটা ছিল ঐতিহাসিক এবং আগের চোগিয়ালের বিরোধিতা করার অবস্থানকে আমার শুধরাতে হয়েছিল”।
কিন্তু হ্যারোতে-শিক্ষিত চশমা পরা ওয়াংচুক হলেন একজন ‘অনীহ’ চোগিয়াল, যিনি চুপচাপ থাকেন, এবং নীরব জীবনযাপন করেন। শুধু পরিবারের ঘনিষ্ঠ স্বজনদের সাথেই দেখা করেন তিনি। তার ঘনিষ্ঠ অল্প কিছু মানুষই শুধু জানেন তিনি কোথায় আছেন। গ্যাংটকে যখন আসেন, তখনো ওয়াংচুক প্রাসাদের সীমানার মধ্যেই তার দিন কাটে।
ওয়াংচুক মাঝে মাঝে বৌদ্ধ ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্যদের সাথে প্রকাশ্যে আসেন। সুক-লা-খাং প্রাসাদের চত্বরে সিকিমের মানুষের সাথে এ সময় দেখা করেন তিনি।
ওয়াংচুকের বয়স এখন ৬৭। তিনি দার্জিলিংয়ের সেন্ট পল স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। এরপর ইংল্যাণ্ডের হ্যারোতে যান। সেখানে লণ্ডনের ইলিং স্কুল অব বিজনেস থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন অন্তত ৩৭ বছর তিনি মেডিটেশান করে কাটিয়েছেন। এর মধ্যে কখনো কখনো তিনি ভুটান আর নেপালের বিভিন্ন গুহাতেও মেডিটেশান করেছেন।
চোগিয়াল পরিবারের সদস্যরা প্রকাশ্যে চোগিয়ালের শাসন বা চোগিয়ালের রাজকার্য বা তার পরিবারের বিষয়ে কথা বলতে ভয় পান। রাজা থেকে ভিক্ষু বনে যাওয়া এই ব্যক্তির গোপনীয়তা তারা কঠোরভাবে রক্ষা করেন। চোগিয়াল কোথায় আছেন, সে তথ্য পরিবারের কেউই জানান না।
পরিবারের এক ঘনিষ্ঠ সদস্য এসএএমকে বলেন, “মানুষের এটা বোঝা উচিত যে, নামগ্যাল পরিবার তাদের রাজ্য হারিয়েছে এবং তাদের গোপনীয়তাকে শ্রদ্ধা করা উচিত অন্যদের। চোগিয়ালের যখন কোন কাজ করার দরকার পড়ে, তখন তিনি নিজেই মানুষের সাথে যোগাযোগ করেন। এর বাইরে তার সাথে যোগাযোগের কোন উপায় নেই, এমনকি তার মোবাইল ফোনেও নয়”।
কোমলভাষী, গম্ভীর ওয়াংচুক, যাকে প্রায় রাতারাতি শাসকের ভূমিকা নিতে হয়েছিল, তিনি ‘অভিষেক অনুষ্ঠানকে’ ‘অপ্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান’ হিসেবে বাতিল করে দিয়েছিলেন। নতুন মুকুটধারী চোগিয়াল বলেছিলেন, “এই উত্তরাধীকারটা স্বয়ংক্রিয়”। তিনি খুব ভালো করেই জানতেন, তার প্রতিটি কথা বহু দূরের নয়াদিল্লীতে পরিস্কারভাবে শোনা যাচ্ছে।
তার পরিবারের ওই সদস্য বলেছেন, “চোগিয়াল নীরবে সিকিম সফর করেন আবার নীরবেই চলে যান”। সিকিমের বহুবিভক্ত রাজনীতিতে ওয়াংচুকের ক্ষমতা বড়জোর একজন গ্রামের মোড়লের মতো। সিকিমের রাজনীতিবিদদের কাছে ‘চোগিয়াল একটা ভুলে যাওয়া অতীত”, যাকে কার্পেটের নিচে ঠেলে দিতে চান তারা।
ক্ষমতাসীন সিকিম ক্রান্তিকারি মোর্চা সরকারের এক সিনিয়র রাজনীতিক বললেন, “সাবেক ক্ষমতাসীন শ্রেণীর হাতেগোনা রাজপন্থী এবং রাজ্যের কট্টর লেপচা ও ভুটিয়া সংখ্যালঘুদের মধ্যে তিনি একটা অস্পষ্ট ঐক্যের প্রতীক মাত্র। এর বেশি কিছু নয়”।
তিনি আরো বললেন, “ভারতীয় সংবিধান অনুসারে অবশ্য ১৩তম চোগিয়ালের অভিষেক অনুষ্ঠানের কোনো আইনি মর্যাদা নেই”।
১৯৭৫ সালে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সাথে ২২তম রাজ্য হিসেবে সংযুক্ত হওয়ার আগে পূর্ব হিমালয়ের এই ক্ষুদ্র রাজ্যটিতে ৩৪১ বছর শাসন করেছিল নামগ্যাল রাজবংশ।
ওই রাজনীতিবিদ বললেন, ওয়াংচুক তার নিজের রাজ্যেই অনেকটা বহিরাগতের মতো এবং মানুষের সাথে যেহেতু তার যোগাযোগ খুবই সীমিত, তাই সিকিমের খুব কম মানুষই জানে যে চোগিয়াল আসলে কে।
সম্রাটপন্থীরা সংখ্যায় কম হলেও ব্যক্তিগত পরিসরে সুযোগ পেলেই তারা ১৯৭৫ সালে অবৈধভাবে সিকিমকে ভারতের সাথে যুক্ত করার প্রসঙ্গটি তোলেন। ১৯৪৭ সালে যখন ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ছেড়ে যায়, সিকিম তখন সার্বভৌম দেশ। কিন্তু ১৯৫০ সালে তারা নিজেদেরকে ভারতের সুরক্ষার অধীনে নিয়ে যায়।
রাজপন্থীদের অনেকেই সর্বশেষ চোগিয়াল – পালদেন থোনদুপ নামগ্যালের সিদ্ধান্তের ভালো মন্দ দিক নিয়ে খোলামেলা মন্তব্য করেন। তার সিদ্ধান্তের কারণেই সিকিম শেষ পর্যন্ত ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সাথে যুক্ত হয়।
এদের কেউ কেউ বলেন যে, নামগ্যালেরা যদি ১৯৪৭ সালেই রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আরো বাস্তববাদী হতেন, তাহলে ভালো হতো এবং সে ক্ষেত্রে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সাথে আরও মর্যাদার সাথে তারা যুক্ত হতে পারতেন।
৬৭ বছর বয়স্ক নির্জনবাসী নামগ্যালকে যারা জানেন, তারা তাকে জানেন মৃদুভাষী ও গম্ভীর হিসেবে। রাজ পরিবারের ঘনিষ্ঠ সিকিমের সাবেক এক আমলা বললেন, “চোগিয়াল হওয়ার জন্য ওয়াংচুক কখনই প্রস্তুত ছিলেন না… তার বড় ভাই ক্রাউন প্রিন্স তেনজিংয়ের সিংহাসনের উত্তরাধীকার হওয়ার কথা। কিন্তু ১৯৭৮ সালে এক মর্মান্তিক গাড়ি দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। গ্যাংটকের প্রাসাদের নিচে পাহাড় বেয়ে উঠতে থাকা দ্রুতগামী একটি ট্রাককে পাশ কাটাতে গিয়ে তার মার্সিডিজ গাড়িটি গভীর খাদে পড়ে যায়”।
তাদের কাছে ওয়াংচুকের অভিষেক ছিল স্বর্গ-থেকে পাওয়া একটি সুযোগ, যেটার মাধ্যমে তারা তাদের ক্ষোভকে জাগিয়ে তুলতে পারবে, ভারত সরকারকে বিব্রতকর অবস্থানে ফেলতে পারবে এবং একই সাথে চীনের কাছাকাছি হতে পারবে।
চীন দেড় দশক আগেও সিকিমকে সংযুক্তির ভারতীয় সিদ্ধান্তের স্বীকৃতি দেয়নি এবং এটাকে তারা ‘অবৈধ’ বলেছিল। চীনা মানচিত্রেও ভারত আর সিকিমের সীমানারেখাকে আন্তর্জাতিক সীমানা হিসেবে দেখানো হয়েছে। তবে, ২০০৫ সালে চীন সরকার অবশেষে সিকিমকে ভারতের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
এমবিএ ডিগ্রিধারী ওয়াংচুক কিছুকাল সম্রাটের মর্যাদা উপভোগের পর পারিবারিক বিভিন্ন ব্যবসায়িক বিষয়গুলোর দেখাশোনা করেন। এর মধ্যে রয়েছে এলাচের চাষ, রিয়েল স্টেট, হোটেল ও দেশের বাইরে অংশীদারিত্বের ব্যবসায়। এরপর তিনি ধীরে ধীরে জনজীবন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ধর্মের দিকে মনোনিবেশ করেন।
রাজার ওই আত্মীয় এসএএমকে বলেন, “সিকিমের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়ানোর বিষয়টিকেও প্রতিরোধ করেছেন ওয়াংচুক”। তিনি আরও বলেন, “চোগিয়াল একজন কঠিন, রাশভারি ব্যক্তি… তার ব্যাপারে আগাম কিছু বলা যায় না”।
ওয়াংচুকের বাবা ভারত সরকারের কাছে যে ১১০ কোটি রুপি ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিলেন, সেটার ব্যাপারেও উদাসীন ওয়াংচুক।
তার ওই আত্মীয় বলেন, “পাদেন নামগ্যাল যেহেতু ভারতের সাথে সংযুক্তির চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেছেন, তাই ক্ষতিপূরণের দাবির বিষয়টি এখানে আসে না”।
১২তম চোগিয়াল পালদেন থোনদুপ নামগ্যাল ভারতের সাথে রাজ্য যুক্ত করতে অস্বীকার করেছিলেন। জীবনের শেষ আটটি বছর তিনি নিঃসঙ্গতা ও অপমানের মধ্য দিয়ে কাটিয়েছেন। তার আমেরিকান স্ত্রী হোপ কুক তাকে ছেড়ে গিয়েছিলেন।
সূত্র : সাউথ এশিয়ান মনিটর